ইতিহাস– নবম শ্রেণি – শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ (দ্বিতীয় পর্ব)
শিল্পবিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
তৎকালীন সময়ের সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে এই শিল্পবিপ্লবের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। এই অধ্যায়ের প্রথম পর্বে আমরা শিল্পবিপ্লবের গোড়ার কথা নিয়ে আলোচনা করেছি, তোমরা চাইলে এই পর্বটি পড়ার আগে, শিল্পবিপ্লবের গোড়ার কথা পর্বটি পড়ে নিতে পারো।
সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব দেখে নাও এই ভিডিও থেকে
শিল্পবিপ্লবের সামাজিক প্রভাব
শিল্পবিপ্লবের ফলে সামাজিক চরিত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি হল –
নতুন সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব ও শ্রেণি বৈষম্য
শিল্পবিপ্লবের আগে সমাজ মূলত পরিচালিত হত ভূস্বামী এবং অভিজাতবর্গের দ্বারা। সাধারণ মানুষ কৃষিকাজের সাথে নিয়োজিত থাকতেন, অন্য কাজের ফাঁকে, কুটিরশিল্প রূপে শিল্পদ্রব্য উৎপন্ন হত।
শিল্পবিপ্লবের ফলে যন্ত্রনির্ভর শিল্পব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমাজে মূলত দুটি শ্রেণি দেখা যায় – পুঁজিপতি মালিক এবং শোষিত শ্রমিক।
পুঁজিপতি মালিক – ধনী ব্যক্তিরা তাদের বিপুল অর্থ নিয়োগের মাধ্যমে শিল্পব্যবস্থা (কারখানা স্থাপন, শ্রমিক নিয়োগ, বাজার তৈরি ইত্যাদি) স্থাপন করে, প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে শুরু করেন।
শোষিত শ্রমিক – শিল্পব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল শ্রমিক, কিন্তু তারা মুনাফার ভাগীদার ছিল না। বরং তাদের দশা ছিল দুর্দশায় ভরা। তাদের মজুরি ছিল সামান্য, কাজের সময়ের কোন ঠিক ছিল না, কাজের কোন নিরাপত্তা ছিল না – মালিক পক্ষ চাইলেই তাদের বরখাস্ত করতে পারত।
এইভাবে ধীরে ধীরে সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য বেড়ে উঠতে থাকে।
গ্রাম থেকে শহরে শহরে স্থানান্তর
শিল্পবিপ্লবের ফলে কাজের আশায় দলে দলে শ্রমিক গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত হতে শুরু করে। এর ফলে গ্রামগুলি ধীরে ধীরে জনশূন্য হতে শুরু করে এবং শহরগুলি মাত্রারিতিক্ত জনবহুল হয়ে যায়।
ঘেটো – শ্রমিকরা কাজ করার জন্য শহরে এলে তাদের জনজীবন অতি নিম্নমানের হয়। শ্রমিকরা শহরের একটি অংশে, অপরিসর স্থানে, বস্তি বানিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। তারা অনৈতিক জীবনে ক্রমশ অভস্ত্য হয়ে ওঠে। এই স্থান সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অংশগুলিকে ঘেটো বলা হত। এই ঘেটো শব্দটি প্রথম ইতালির ভেনিস শহরে ইহুদিদের জন্য ব্যবহার হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শ্রমিক – দরিদ্র মানুষ অধ্যুষিত অঞ্চলকে ঘেটো বলে উল্লেখ করা হত।
শিল্পবিপ্লবের রাজনৈতিক প্রভাব
শিল্পবিপ্লবের ফলে সামাজিক পরিবর্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়।
পুঁজিপতিদের ক্ষমতাবৃদ্ধি
আগে দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভিজাত শ্রেণি প্রধানত গুরুত্ব পেত। শিল্পবিপ্লবের ফলে পুঁজিপতিরা এই স্থান দখল করে নেয়। সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণির সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে। এরবদলে শিল্পপতি, মহাজন (যারা সুদের কারবার করেন), বনিক সম্প্রদায় শাসক শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
তোমাদের নিশ্চয় মনে আছে ফরাসী বিপ্লবের সময়ে তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্গত ব্যবসায়ীর ক্ষোভের কারণ ছিল যে অর্থনৈতিক ভাবে তারা অভিজাতদের থেকে কোনো অংশে দুর্বল না হলেও সমাজে তারা অভিজাতদের সমান সম্মান পেতেন না। বলা যায় শিল্পবিপ্লব ব্যবসায়ীশ্রেণিদের সেই কাঙ্ক্ষিত সম্মান এনে দেয়।
শ্রমিকদের রাজনীতিতে প্রবেশ
এই পরিবর্তনের মধ্যে শ্রমিকরাও অন্তর্ভুক্ত হয়। শিল্পবিপ্লবের ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আদর্শ জনপ্রিয় হয়। তারা ধীরে ধীরে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার দাবী করতে শুরু করে। সর্বপ্রথমে ইংল্যান্ডের শ্রমিকরা একজোট হয়ে ‘চার্চিস্ট আন্দোলন’ শুরু করে। ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]
আন্তর্জাতিকতাবাদের উন্মেষ
উন্নত পরিবহণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বাণিজ্যিক কার্য-কলাপ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিভিন্ন দেশ ও জাতিবর্গের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে আন্তর্জাতিকতাবাদের উন্মেষ ঘটে। আবার, শিল্পোন্নত দেশগুলি নিজের দেশের পণ্য বিক্রির জন্য বাজার খুঁজতে গিয়ে ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়ে।
শিল্পবিপ্লবের অর্থনৈতিক প্রভাব
শিল্পবিপ্লবের সর্বাধিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে।
সাম্রাজ্যবাদের সূচনা
শিল্পোন্নত দেশগুলি নিজেদের পণ্য বিক্রি করার জন্য নতুন করে উপনিবেশ গড়ে তোলে এবং সেই সকল বাজারে নিজেদের পণ্য বিক্রয় করার উপর জোর দেয়া শুরু করে। এর ফলে নতুন করে বাজার দখলের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের সূত্রপাত হয়।
ফ্যাক্টারি প্রথার সূত্রপাত
আমরা আগেই জেনেছি যে শিল্পবিপ্লবের পূর্বে কুটির শিল্পই ছিল শিল্পোৎপাদনের প্রধান উপায় এবং কুটিরশিল্পের ফলে শিল্পোৎপাদন ছিল সময় এবং ব্যায়সাপেক্ষ। শিল্পবিপ্লবের সময় কাল থেকে শিল্পে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়।
এর ফলে শিল্পোৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই আধুধিক যন্ত্রগুলি ছিল অতি ব্যয়সাপেক্ষ। তার ফলে এই সকল আধুনিক যন্ত্র কেনার মূলধন ছোট ব্যবসায়ীদের ছিল না। তাই এই ফ্যাক্টারি প্রথার সূত্রপাত হয়। এই ব্যবস্থায় একই ছাদের তলায় বিশাল জায়গা জুড়ে শিল্পোৎপাদন শুরু হয়। এই ফ্যাক্টারিগুলিতে মূলধন বিনিয়োগ করতেন মালিকপক্ষ বা পুঁজিপতিরা। পুঁজিপতিরা বিপুল মূলধন বিনিয়োগ করে, পর্যাপ্ত কাঁচামাল, আধুনিক যন্ত্রপাতির এবং শ্রমিকদের সাহায্যে দ্রুত উৎপাদন শুরু করেন। সময়ের সাথে সাথে এই ফ্যাক্টারিগুলিই শিল্প বিপ্লবের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
বাণিজ্যিক মুলধনের পরিবর্তন
শিল্পবিপ্লবের আগে পুঁজিপতিরা তাদের মূলধন বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতেন; যা ‘বাণিজ্যিক মূলধন’ নামে পরিচিত ছিল। শিল্পবিপ্লবের সময়কাল থেকে পুঁজিপতিরা শিল্পোৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ শুরু করেন। শিল্পে নিয়োজিত এই মূলধনকে বলা হত ‘শিল্প মূলধন’। বলা যায় যে শিল্পবিপ্লবের ফলে বাণিজ্যিক মূলধন ক্রমশ শিল্প মূলধনে রূপান্তরিত হয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
শিল্পবিপ্লব ও নারীর অবস্থান
শিল্পবিপ্লব নারীদের জীবনেও পরিবর্তন আনে। শিল্পবিপ্লবের আগে নারীরা মূলত নিজগৃহে, কৃষি খামারে প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করতেন। শিল্পবিপ্লবের ফলে কলকারখানায় প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এই সময় থেকে তারা কলকারখানায় ছোট কাজগুলিতে নিয়োজিত হতে শুরু করেন। মূলত বুনন ও বস্ত্রশিল্পে তাদের চাহিদা ছিল বেশি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মালিকরা মহিলা শ্রমিক অধিক পছন্দ করতেন কারণ স্বভাবে তারা নম্র ছিলেন এবং পুরুষ শ্রমিক অপেক্ষা তাদের কম মজুরি দেওয়া হত। কিন্তু সমস্ত বাঁধা অগ্রাহ্য করে নারীদের এই পরিবর্তনে অংশগ্রহণ পরবর্তী সময়ে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → শিল্প সমাজের সমাজতান্ত্রিক সমালোচনা
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-His-4-2