german-natzi
WB-Class-9

জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান

ইতিহাসনবম শ্রেণি – বিশ শতকে ইউরোপ (ষষ্ঠ পর্ব)

আগের পর্বে আমরা ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, এই পর্বে আমরা জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পর জার্মানি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ের পর, মিত্রশক্তির বিভিন্ন দেশগুলি জার্মানির উপর ভার্সাই সন্ধির শর্তাবলি আরোপ করেছিল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই চুক্তি জার্মানির জন্য ছিল একটি বিশাল বোঝা। তৎকালীন জার্মান সম্রাট (কাইজার) দ্বিতীয় উইলিয়াম জার্মানির উপর সমস্ত দাবী প্রত্যাহার করে নিলে, জার্মানিতে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। এর পর জার্মানির শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একটি অস্থায়ী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, এটিই ভাইমার প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

ভাইমার প্রজাতন্ত্র

রাজতন্ত্রের পতনের পর জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ইবার্টের নেতৃত্বে জার্মানিতে এক অস্থায়ী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রধান কার্যালয় ছিল ভাইমার শহরে, তাই এই সরকারকে ভাইমার প্রজাতন্ত্র বলা হয়। এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরে বেশ কিছু সমস্যা দেখা যায়।

প্রথমত, ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির উপর বিপুল অর্থের ক্ষতিপূরণ চাপানো হয়, যা জার্মানির অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে দেয়। আবার জাত্যাভিমানি জার্মান নাগরিকদের কাছে বিশ্বের দরবারে এই অপমান সহ্য করা সম্ভব ছিল না, ফলে নতুন সরকারের প্রতি এক সর্বব্যাপী ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায়।

দ্বিতীয়ত, বলশেভিক আন্দোলনের অনুপ্রেরনায় কমিউনিস্ট আন্দোলন বৃদ্ধি পায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়।

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকট, বেকার সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমাগত ধর্মঘটের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া ইত্যাদি চরম আকার লাভ করে।

এই সময়ে জার্মানির অবস্থা এতটাই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে যে ১৯১৯ থেকে ১৯৩৩ এই ১৪ বছরের মধ্যে ১৯টি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়।

অ্যাডলফ হিটলার

জার্মানির এই অস্থির সময়ে অ্যাডলফ হিটলার নামে এক প্রাক্তন সেনাকর্মীর উত্থান ঘটে। জার্মান জাতীয়তাবাদে উদ্ভুদ্ধ হিটলার ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘জার্মান ওয়ার্কার্স’ পার্টিতে যোগ দেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তার উত্থান হয়। কিছুদিন পরেই এই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে নতুন নাম হয় ‘ন্যাশেনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা জার্মান উচ্চারনে নাৎসি পার্টি। এই দলের চিহ্ন ছিল সস্তিক চিহ্ন।

ক্রমশই হিটলারের দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই অবস্থায় হিটলার বলপূর্বক দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চাইলে তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়। জেলে বসে তিনি তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘মেইন ক্যাম্ফ’ বা ‘আমার সংগ্রাম’ বই লেখেন। এই বইটিকে নাৎসিদের বাইবেল বলা হয়।

জার্মানিতে নাৎসিবাদ ও নাৎসিদল

নাৎসিবাদ হল উগ্র জাতীয়তাবাদ। হিটলারের মতে, জার্মানদের শরীরেই কেবলমাত্র নার্ডিক রক্ত আছে, তাই তারাই একমাত্র আর্য জাতি। ফলে সকল জাতির মধ্যে আর্যরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তিনি বিশ্বাস করতেন, জার্মানরা একদিন পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে খ্যাতি লাভ করবে।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

হিটলার পরিচালিত নাৎসিদলের মূল লক্ষ্য ছিল শক্তিশালী জার্মান রাষ্ট্র গঠন। তাই অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক সময়ে দেশের মানুষের মধ্যে এই দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে, এই দল ছিল কমিউনিস্ট বিরোধী, ফলে কমিউনিস্টদের ব্যাপক ধর্মঘটে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বহু শিল্পপতি এই দলকে আর্থিক সাহায্য করতে শুরু করেন।

নাৎসি দলের সংগঠন ছিল মজবুত। দেশের বেকার যুবকদের নিয়ে হিটলার তাঁর আধা সামরিক বাহিনী ‘স্টর্ম ট্রুপার্স’ বাহিনী গড়ে তোলেন। এরসাথে ছিল, ‘এলিট গার্ডস’ যারা প্রধান নেতাদের জীবনরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সর্বাপেক্ষা কুখ্যাত বাহিনী ছিল গুপ্ত পুলিশবাহিনী বা গেস্টপো বাহিনী, এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন হিমলার।

নাৎসি দলের ক্ষমতালাভ

১৯৩০ সালের নির্বাচনে নাৎসিদল ৬০৮টি আসনের মধ্যে ২৩০টি আসন লাভ করে বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ হিটলারকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু বহুদলীয় সরকারের পক্ষে দেশের শাসনকার্য চালাতে অসুবিধা হবার ফলে পুনরায় নির্বাচন হয় কিন্তু এই নির্বাচনেও হিটলার সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে অসফল হন এবং পুনরায় অন্য দলের সঙ্গে সরকার গঠন করেন।

এই সময়ে দেশের শাসন কাজ সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করেন। এই বিশেষ আইনের ফলে হিটলারকে সংসদের অনুমোদন ছাড়াই দেশের শাসনকাজ পরিচালনার অধিকার দেওয়া হয়। এই আইনের বলে হিটলার দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতায় পরিণত হন।

জার্মানির সর্বনায়ক হিটলার

১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির রাষ্ট্রপতি হিন্ডেনবার্গের মৃত্যু হলে হিটলার জার্মানির রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এই দুটি পদ গ্রহণ করেন এবং নিজেকে জার্মানির সর্বেসর্বা বা প্রধান নেতা বা ‘ফ্যুয়েরার’ হিসাবে ঘোষণা করেন। তাঁর ক্ষমতা দখলের পরেই দেশ জুড়ে ইহুদি এবং কমিউনিস্টদের উপর অত্যাচার শুরু হয়। তাঁর নাৎসি বাহিনীর মাধ্যমে দেশের অন্য বিরোধীদের স্থব্ধ করে তিনিই হয়ে ওঠেন জার্মানির একনায়ক।

হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং অগ্রাসী নীতি পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → স্পেনের গৃহযুদ্ধ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

IX-His-5-6