বাংলা – নবম শ্রেণি – কলিঙ্গ দেশে ঝড়বৃষ্টি (পদ্য)
কলিঙ্গ দেশে ঝড়বৃষ্টি কবিতার প্রেক্ষাপট এবং সারাংশের আলোচনা আগে JUMP ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। এই পর্বে কলিঙ্গ দেশে ঝড়বৃষ্টি কবিতার প্রতিটি লাইনের সরলার্থ বিস্তারিত আলোচনা করা হল। এই পর্ব পড়ার আগে, অবশ্যই প্রথম পর্বটি পড়ে নিতে হবে।
কলিঙ্গ দেশে ঝড় বৃষ্টি কবিতার প্রথম পর্বটি পড়ো।
কলিঙ্গ দেশে ঝড় বৃষ্টি পদ্যাংশের সরলার্থ
মেঘে কৈল অন্ধকার মেঘে কৈল অন্ধকার।
দেখিতে না পায় কেহ অঙ্গ আপনার।।
আমরা জানি যে, সাধারণত ঝড় আসার আগে চারদিক কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। পদ্যাংশ অনুসারে কলিঙ্গ দেশও একটি প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন হতে চলেছে। ‘কৈল’ শব্দটির অর্থ করিল। কবি বলেছেন, চারদিক কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। মেঘের অন্ধকার এতটাই গাঢ় যে মানুষজন তাদের নিজ অঙ্গ দেখতে পাচ্ছে না।
ঈশানে উড়িল মেঘ সঘনে চিকুর।
উত্তর পবনে মেঘ ডাকে দুর দুর।।
‘ঈশান’ কথার অর্থ উত্তর পূর্ব কোণ। কবি বলেছেন যে কলিঙ্গ প্রদেশের উত্তর পূর্ব কোণে ঘন মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে যা থেকে ‘চিকুর’ অর্থাৎ চুলের ন্যায় বিদ্যুৎ ঠিকরে বেরোচ্ছে। উত্তর প্রান্তে বাতাস – মেঘ দুর দুর শব্দে ডাকছে।
নিমিষেকে জোড়ে মেঘ গগন-মণ্ডল।
চারি মেঘে বরিষে মুষলধারে জল।।
নিমেষের মধ্যে সমস্ত মেঘ, সমগ্র গগন মন্ডল অর্থাৎ আকাশকে জুড়ে একটা ঘন কালো মেঘের আকার দেয়। চারি মেঘ, অর্থাৎ পুরাণমতে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্র দেবের চারটি মেঘ (যথাক্রমে সম্বর্ত, আবর্ত, পুষ্কর এবং দ্রোণ) মুষলধারে বৃষ্টিপাত আরম্ভ করে।
কলিঙ্গে উড়িয়া মেঘ ডাকে উচ্চনাদ।
প্রলয় গণিয়া প্রজা ভাবয়ে বিষাদ।
চারদিক থেকে মেঘ উড়ে এসে কলিঙ্গ দেশে ‘উচ্চনাদে’ বা উচ্চস্বরে গর্জন (মেঘের ডাক) শুরু করে। আবহাওয়ার এই ‘প্রলয়’ অর্থাৎ ধ্বংসাত্মক রূপ দেখে কলিঙ্গবাসী বুঝতে পারে যে তাঁদের বিপদ আসস্ন, আর এই ভাবনা তাঁদের মনে ‘বিষাদ’ অর্থাৎ বিষন্ন ভাবের সঞ্চার করে।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
হুড় হুড় দুড় দুড় বহে ঘন ঝড়।
বিপাকে ভবন ছাড়ি প্রজা দিল রড়।।
এদিকে ‘হুড় হুড় দুড় দুড়’ শব্দে ঘন ঝড় বয়ে চলে। ফলে বিপদে পড়ে কলিঙ্গবাসি তাদের ‘ভবন’ বা ঘর ছেড়ে পালিয়ে (রড়) যায়।
ধুলে আচ্ছাদিত হইল যে ছিল হরিত।
উলটিয়া পড়ে শস্য প্রজা চমকিত।।
গাছপালার সাধারণ রঙ হল সবুজ কিন্তু প্রবল ঝড়ের ফলে সবুজ রঙের সকল উদ্ভিদ ধুলোতে ঢাকা পড়েছে। শুধু তাই নয়, যেখানে শস্য সঞ্চয় করে রাখা ছিল সেগুলিও ঝড়ের প্রাবল্যে উলটে পড়েছে। ঝড়ের এই বিধ্বংসী রূপ দেখে কলিঙ্গবাসী চমকে উঠেছে।
চারি মেঘে জল দেয় অষ্ট গজরাজ।
সঘনে চিকুর পড়ে বেঙ্গ – তড়কা বাজ।।
অষ্ট কথার অর্থ হল আট ও গজ কথার অর্থ হাতি। ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী, এই আট গজরাজ আট দিকের (যথা উত্তর, উত্তর পূর্ব, পূর্ব, দক্ষিণ পূর্ব, দক্ষিণ, দক্ষিণ পশ্চিম, পশ্চিম, উত্তর পশ্চিম) রক্ষাকর্তা। এনাদের নাম হল কুমুদ, ঐরাবত, পুন্ডরীক্ষ, পুস্পদন্ড, অঞ্জন, বামন, সুপ্রতীক ও সার্বভৌম। আমরা জানি ব্যাং লাফিয়ে লাফিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। কবি এখানে ঘন ঘন বাজ পড়াকে ব্যাঙের লাফের সাথে তুলনা করেছেন। কবি বলতে চেয়েছেন যে, ব্যাঙ যেভাবে লাফায়, তেমনভাবেই লাফিয়ে লাফিয়ে ঘন মেঘ থেকে বাজ পড়ছে।
করি-কর সমান বরিষে জলধারা।
জলে মহী একাকার পথ হইল হারা।।
‘করি’ অর্থে হাতি এবং ‘করি-কর’ অর্থে হাতির শুঁড়। হাতি যেভাবে তার শুঁড়ের সাহায্যে জল বর্ষণ করে তেমনভাবে আকাশ থেকে সমানে বর্ষণ হয়ে চলেছে। ‘মহী’ কথার অর্থ পৃথিবী, প্রবল জলবর্ষণে, সারা কলিঙ্গ প্রদেশের পথ জলে ডুবে গেছে। তাই আলাদা করে আর পথের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না, পথ জলের মধ্যে একাকার অর্থাৎ মিশে গেছে।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
ঘন ঘন শুনি চারি মেঘের গর্জন।
কারো কথা শুনিতে না পায় কোনো জন।।
পূর্বে উল্লেখিত চার মেঘের ঘন ঘন গর্জন (মেঘের ডাক) শোনা যাচ্ছে। এই গর্জন এতটাই প্রবল যে কলিঙ্গবাসী একে অপরের কথা শুনতে পারছেন না।
পরিচ্ছিন্ন নাহি সন্ধ্যা দিবস রজনী।
কলিঙ্গে সোঙরে সকল লোক যে জৈমিনি।।
অনেকটা সময় ধরে ঝড়-বৃষ্টি চলছে তাই আলাদাভাবে দিন, সন্ধ্যা, রজনী বা রাত আর বোঝা যাচ্ছে না। কলিঙ্গবাসী আতঙ্কিত হয়ে ঋষি জৈমিনির নাম ‘সোঙরে’ বা স্মরণ করছেন। প্রসঙ্গত জৈমিনি একজন বিখ্যাত ঋষি, ইনি পূর্ব মীমাংসা গ্রন্থের রচয়িতা। কথিত আছে যে ঝড় বৃষ্টির সময় জৈমিনির নাম স্মরণ করলে, ঝড়-বৃষ্টির বেগ কমে যায়। আমরা বিপদে পড়লে যেমন ভগবানকে স্মরণ করি তেমনভাবেই কলিঙ্গবাসী তাদের এই বিপদের সময়ে জৈমিনিকে স্মরণ করছেন।
হুড় হুড় দুড় দুড় শুনি ঝন ঝন।
না পায় দেখিতে কেহ রবির কিরণ।
কলিঙ্গ প্রদেশে ‘হুড় হুড় দুড় দুড়’ শব্দ করে প্রবল ঝড় চলছে, তাই এই সময়ে কেউ ‘রবির কিরণ’ অর্থাৎ সূর্যের আলো দেখতে পাচ্ছে না।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌতবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবনবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]
গর্ত ছাড়ি ভুজঙ্গ ভাসিয়া বুলে জলে।
নাহি জানি জলস্থল – কলিঙ্গ – মন্ডলে।।
‘ভুজঙ্গ’ কথার অর্থ সাপ। আমরা জানি যে সাপ, গর্তে বাস করে কিন্তু প্রবল বৃষ্টির ফলে সাপেরা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে জলে ‘বুলে’ বা ভ্রমণ করছে। প্রবল বৃষ্টিতে জল – স্থল সবই একাকার হয়ে গেছে।
নিরবধি সাত দিন বৃষ্টি নিরন্তর।
আছুক শস্যের কার্য হেজ্যা গেল ঘর।।
সাত দিন ধরে নিরন্তর বা একটানা বৃষ্টি চলছে। ‘আছুক’ কথার অর্থ হল যা কিছু আছে, এই প্রবল বৃষ্টিতে কলিঙ্গবাসীর ঘরে যা কিছু ছিল তা ‘হেজ্যা’ বা হেজে বা জলে ভিজে পচে গেছে।
মেঝ্যাতে পড়য়ে শিল বিদারিয়া চাল।
ভাদ্রপদ মাসে যেন পড়ে থাকা তাল।।
ভাদ্র মাসে সাধারণত তাল গাছে তাল পাকে। এই সময়ে পাকা তাল গাছ থেকে শব্দ করে মাটিতে পড়ে। এদিকে কলিঙ্গ দেশে বৃষ্টির সময় আকাশ থেকে শিল পড়ছে, এই শিলগুলি এতটাই বড় যে তা ঘরের চাল ফুটো বা ‘বিদীর্ণ’ করে মাটিতে পড়ছে। কবি এই ঘটনাকে ভাদ্র মাসে তাল পড়ার সাথে তুলনা করেছেন।
চন্ডীর আদেশ পান বীর হনুমান।
মঠ অট্টালিকা ভাঙ্গি করে খান খান।।
আমরা পূর্বকথায় জেনেছি যে মা চণ্ডীর আদেশে বীর হনুমান তাঁর প্রবল পরাক্রমে কলিঙ্গ প্রদেশ ধ্বংস করার জন্য কলিঙ্গ দেশে গেছেন। প্রসঙ্গত, পুরাণ মতে বীর হনুমান বায়ুর দেবতা পবনের পুত্র। ঝড়ের প্রাবল্যে কলিঙ্গ দেশের বিভিন্ন মঠ ও অট্টালিকা ভেঙে পড়ছে।
চারিদিকে বহে ঢেউ পর্বত-বিশাল।
উঠে পড়ে ঘরগুলা করে দল মল।।
সাত দিন একটানা বৃষ্টির ফলে কলিঙ্গ দেশে নদীগুলি সমুদ্রের আকার ধারণ করছে। এই জলে পর্বতের ন্যায় বিশাল ঢেউ উঠছে। যার ফলে ঘর-বাড়িগুলি যেন নিজের জায়গা ছেড়ে ওঠা নামা করছে।
চন্ডীর আদেশে ধায় নদনদীগণ।
অম্বিকামঙ্গল গান শ্রীকবিকঙ্কণ।।
মা চণ্ডীর আদেশে নদনদী গণ ধেয়ে কলিঙ্গ দেশে আসে। অর্থাৎ, কলিঙ্গ দেশ আরো বিপদের সম্মুখীন হয়। মুকুন্দ চক্রবর্তী বা শ্রীকবিকঙ্কণ তাঁর অম্বিকামঙ্গল কাব্যে এই কথা বলেন।
কলিঙ্গ দেশে ঝড় বৃষ্টি কবিতার সরলার্থের পাঠ্য↓
পর্ব সমাপ্ত
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX_Ben-Kolinga-2