ইতিহাস– নবম শ্রেণি – বিশ শতকে ইউরোপ (তৃতীয় পর্ব)
মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেকয়েকটি ভয়াবহ ঘটনার নিদর্শন রয়েছে, তার মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অন্যতম। ঔপনিবেশিক ক্ষমতা দখল, কাঁচামাল ও পণ্য বিক্রয় এবং নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত প্রতিযোগিতা বিশ্বের প্রধান শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে বিবাদের প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন অষ্ট্রিয়ার যুবরাজ সেরাজেভো ফার্দিনান্ড একজন সার্বিয়া নিবাসীর দ্বারা হত্যা হলে, অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সূচনা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ
অস্ট্রিয়া সার্বিয়া আক্রমণ করলে রাশিয়া সার্বিয়ার সমর্থনে সেনা সমাবেশ করে।
অপরদিকে জার্মানি তার বন্ধুরাষ্ট্র অষ্ট্রিয়ার সমর্থনে সেনা মোতায়েন করে এবং রাশিয়া ও ফ্রান্স এই দুই দেশকে চরমপত্র দেয়। চরমপত্রে কাজ না হলে জার্মানি প্রথমে ১লা আগস্ট রাশিয়া এবং ৩রা আগস্ট ফ্রান্স আক্রমণ করে।
ফ্রান্স ও জার্মানির বিবাদে বেলজিয়াম জড়িয়ে পড়লে মিত্রদেশ ইংল্যান্ড জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
অস্ট্রিয়া ও জার্মানির সমর্থনে তুরস্ক সাম্রাজ্য যুদ্ধে যোগ দান করে।
প্রথমিকভাবে নিরপেক্ষ থাকলেও ইটালি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সাথে যুদ্ধে যোগদান করে।
অস্ট্রিয়া ও জার্মানি দুটি দিকে যথা পূর্ব রণাঙ্গন (রাশিয়া) এবং পশ্চিম রণাঙ্গন (ফ্রান্স ও বেলজিয়াম) যুদ্ধ করে।
পূর্বপ্রান্তে টানেনবার্গের যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে, অস্ট্রিয়া ও জার্মানির বাহিনী বিধ্বস্ত করে এবং ইউক্রেন, ক্রিমিয়া ইত্যাদি স্থান দখল করে। কিন্তু রাশিয়ায় রুশবিপ্লব সংঘটিত হলে বলসেভিক সরকার যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যেতে অসম্মত হয় এবং জ্রামানির সাথে ব্রেস্ট লিটোভস্কের সন্ধির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়।
অপরদিকে পশ্চিম রণাঙ্গনে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের যৌথ বাহিনীর সাথে মার্নে ও সমের যুদ্ধে জার্মানির প্রথামিক পরাজয় ঘটে, কিন্তু এর পরের প্রত্যাঘাতে জার্মানি বেলজিয়ামের কিছু অংশ দখল করে নেয়।
এরপর পূর্ব রণাঙ্গনের সেনাবাহিনী, পশ্চিম রণাঙ্গনের যুদ্ধে যোগ দিলে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার বল ব্রদ্ধি পায় এবং তাদের সেনাবাহিনী ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যোগ দেয় এবং যুদ্ধে মিত্রশক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
জার্মানির অভ্যন্তরে অভ্যুত্থানের ফলে কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম সিংহাসনচ্যুত হন। ১৯১৮ সালের ১১ই নভেম্বর জার্মানি আত্মসমর্পণ করে এবং প্রথমবিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে পৃথিবীতে বহু মানুষ মারা যান এবং বিপুল সম্পত্তির বিনাশ হয়। যুদ্ধের ভয়াবহতায় মানব সমাজে ব্যপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ বিশ্বশান্তির পক্ষে আবেদন রাখতে শুরু করেন।
চোদ্দ দফা নীতি
মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জানুয়ারি বিশ্ব শান্তির লক্ষে কিছু নীতির ঘোষণা করেন, এগুলিই চোদ্দ দফা নীতি বা Fourteen Points নামে খ্যাত।
এই নীতিগুলির মূল্য ভিত্তি ছিল –
ক) প্রতিটি জাতির নিজ আত্মনীয়ন্ত্রনের অধিকার। এর সূত্র ধরে ইউরোপে অনেকগুলি নতুন রাস্ট্রের জন্ম হয়।
খ) তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, এর সূত্র ধরেই ভবিষ্যতে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা পায়।
ভার্সাই চুক্তি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি আত্মসমর্পন করলে মোট ৩২টি দেশের প্রতিনিধিরা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে একত্রিত হন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্ব শান্তি রক্ষা।
এই সম্মেলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল চার রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে; যথা – মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন, ইটালির প্রধানমন্ত্রী অর্লান্ডো, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ এবং ফরাসী প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেসো।
এই সম্মেলনে মোট পাঁচটি সন্ধি সাক্ষরিত হয়, এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল জার্মানির সাথে সন্ধি। বিজয়ী দেশগুলি জার্মানিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করে, জার্মানির উপর বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল জার্মানির জনগণের প্রতি অপমানজনক।
রাজনৈতিক শর্তাবলি
ক) জার্মানি পশ্চিম সিমান্তের আলসাস ও লোরেন ফ্রান্সকে ফিরিয়ে দেবে।
খ) সার উপত্যকা ১৫ বছরের জন্য ফ্রান্সের অধিনে রাখা হয়।
গ) বেলজিয়ামকে ইউপেন, ম্যালমেভি এবং মরিসনেট ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঘ) মেমেল বন্দর লিথুয়ানিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঙ) জার্মানির বিভিন্ন উপনিবেশ কেড়ে নেওয়া হয়।
চ) পোল্যান্ড যাতে সমুদ্র ব্যবহার করতে পারে, তাই জার্মানির মধ্যদিয়ে একটি রাস্তা পোল্যান্ডকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এটি পোল্যান্ড করিডোর নামে খ্যাত।
সামরিক শর্তাবলি
জার্মানিকে নিয়ন্ত্রনে রাখার উদ্দেশ্যে, জার্মানির উপর বিভিন্ন সামরিক শর্তাবলি আরোপ করা হয়।
ক) জার্মানির জল, স্থল ও বিমান বাহিনী ভেঙে দেওয়া।
খ) জার্মানির সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে ১ লক্ষ করে দেওয়া হয়।
গ) জার্মানির যুদ্ধ জাহাজগুলি ইংল্যান্ডকে দিয়ে দেওয়া হয় এবং জার্মানিতে ট্যাঙ্ক, বোমারূ – বিমান, কামান নিষিদ্ধ হয়।
ঘ) রাইন নদীর পূর্ব তীর বেসামরিক অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
অর্থনৈতিক শর্তাবলি
ক) যুদ্ধের জন্য জার্মানিকে দায়ী করে ৬৬০ কোটি পাউন্ডের ক্ষতিপুরনের দাবী রাখা হয়।
খ) জার্মানির অধিকাংশ বানিজ্যপোত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দখলে চলে যায়।
গ) জার্মানির কয়লা সমৃদ্ধ সার অঞ্চল ফ্রান্সের দখলে যায়।
ভার্সাই চুক্তির মুল্যায়ন
বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত চুক্তি হল এই ভার্সাই চুক্তি। বিজিত জার্মানির উপর নানারকম কঠিন ও অনৈতিক দাবী চাপিয়ে জার্মানিকে একপ্রকার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শেষ করে দেবার চক্রান্ত করা হয়। এর ফলে যেমন বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দার দিকে এগিয়ে যায়, তেমনি জার্মানি হিটলারের মত একনায়ক শাসকের রাজত্বকালের দিকে ত্বরান্বিত হয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
জাতিসংঘ
মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের চোদ্দ দফা নীতিকে মান্যতা দিয়ে, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে এপ্রিল জাতিসংঘ বা লিগ অফ নেশনস গড়ে ওঠে।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি জাতিসংঘের প্রথম অধিবেশন আয়োজন করা হয়।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → অর্থনৈতিক মহামন্দা (১৯২৯) এবং তার প্রভাব
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX_His_5-c