সহজে ব্যাকরণ সিরিজ (পঞ্চম পর্ব) – সন্ধি
সহজে ব্যাকরণের নতুন পর্বে সবাইকে স্বাগত।
আশা করি সকলে ভালো আছো। আজ ব্যাকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা কিছু গল্প-গুজব করবো। বিষয়টি অতি পরিচিত তোমাদের কাছে। অনেক ছোটোবেলা থেকেই তোমরা পাঠ্যক্রমে পড়ে আসছো সন্ধি। তবু যেন মনের গভীরে এই বিষয়টি ততটা বসেনি। আশা করি আজকের ক্লাসের পরে পুরো বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। চলো শুরু করি।
আসলে কি জানো তো, আমরা মানে বিশেষত আমাদের জিভ খুবই অলস, খুউউব কুঁড়ে। একটু বেশি অক্ষর বা বেশি ভারী শব্দ কিংবা টানা বড়ো শব্দ উচ্চারণ করতেই হাঁপিয়ে যায়। তাই কায়দা করে কাজ হাসিল করার চেষ্টায় সে একটা ফন্দি এঁটেছে। বড়ো বড়ো শব্দগুলোকে ছোটো করে নিলেই চাপ পড়ে না। এই বড়ো বড়ো শব্দকে সংক্ষিপ্ত করার দুটো পদ্ধতির কথা ব্যাকরণে জানা যায় – একটি হল সন্ধি আর দ্বিতীয়টি সমাস।
আজকে আমরা সন্ধি নিয়েই কথা বলবো। পরে কোনো একদিন সমাস নিয়ে তোমাদের দু-চার কথা বলা যাবে।
সন্ধি কথার অর্থ হল মিলন।
সাধারণত শব্দকে শ্রুতিমধুর করা এবং শব্দের উচ্চারণকে সহজ করার জন্যেই সন্ধি ঘটে থাকে।
যদি প্রশ্ন করো যে সন্ধি কাকে বলে?
তাহলে এর উত্তরে বলতে হয় ‘পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ধ্বনি পারস্পরিকভাবে মিলিত হয়ে যদি নতুন কোনো অর্থবোধক শব্দ তৈরি করে তবে সেই সংযুক্তির প্রক্রিয়াকে বলে সন্ধি’।
এখানে একটা জিনিস নিয়ে তোমাদের মনে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে।
তোমরা হয়তো ছোটোবেলায় ব্যাকরণে জেনে থাকবে বর্ণের সঙ্গে বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে।
কিন্তু এই ব্যাখ্যা একেবারেই ঠিক নয়।
বর্ণের সঙ্গে বর্ণের নয়, বরং ধ্বনির সঙ্গে ধ্বনির মিলনকে সন্ধি বলে।
পাশাপাশি থাকা দুটি শব্দের মধ্যে প্রথমটির শেষের ধ্বনি আর পরেরটির প্রথম ধ্বনিদুটি পরস্পর মিলিত হয়ে সন্ধি ঘটায়। যেমন হিম্ + আলয় = হিমালয়। এখানে প্রথম পদ ‘হিম্’-এর ম-এর সঙ্গে পরপদ ‘আলয়’-এর আ ধ্বনির সন্ধি ঘটেছে। এক্ষেত্রে বলে নেওয়া দরকার সন্ধিতে যে দুটি পদ থাকে তার প্রথমটিকে বলে পূর্বপদ আর পরেরটিকে বলে উত্তরপদ বা পরপদ।
এখন যদি প্রশ্ন করো যে সন্ধি করা হয় কেন? বা সন্ধির বিশেষ কোন প্রয়োজনীয়তা আছে? খুব সংক্ষেপে বললে দুটি বিশেষ কারণে সন্ধি করা হয়ে থাকে –
১. শব্দের উচ্চারণকে সহজ সরল করা।
২. শব্দ তথা ভাষাকে শ্রুতিমধুর করা।
বাংলায় সন্ধি এবং সমাস যতটা ব্যবহৃত হয়, তার থেকেও আমরা সংস্কৃত ভাষার ক্ষেত্রে এর প্রচুর ব্যবহার দেখতে পাবো। সংস্কৃতে তো বিশাল বড়ো বড়ো পদ তৈরি হয়ে যায় সমাসের মাধ্যমে, সন্ধির মাধ্যমে। যাইহোক এবারে বন্ধুরা তোমরা জেনে নাও বাংলায় মূলত তিন প্রকার সন্ধি আমরা দেখে থাকি। যেমন –
১. স্বরসন্ধি
২. ব্যঞ্জনসন্ধি
৩. বিসর্গসন্ধি
সংস্কৃত ভাষাতেও কিন্তু এই তিনপ্রকার সন্ধি দেখা যায়।
আসল কথা হল বন্ধুরা বাংলা ব্যাকরণের অধিকাংশ বিষয়ই সংস্কৃত ভাষা থেকেই ধার করে তৈরি হয়েছে। তাহলে কোনটা কি প্রকার সন্ধি হবে জেনে নেওয়া যাক। স্বরধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির মিলন ঘটলে তাকে আমরা স্বরধ্বনি বলি। ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনির মিলনকে আমরা ব্যঞ্জনসন্ধি বলে থাকি। আর যে সন্ধিতে সাধারণত ‘ঃ’ চিহ্নের বদলে সন্ধিযুক্ত হয়ে ‘র’ বা ‘স’ আসে তাকে বিসর্গ সন্ধি বলে। একে একে বিশদে আলোচনা করে নিই এসো।
স্বরসন্ধি
উপরে যে সন্ধির উদাহরণগুলি দেওয়া হল সেগুলির দিকে ভালো করে লক্ষ করলে দেখতে পাবে বন্ধুরা এই সন্ধিগুলিতে সবই স্বরধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির মিলন ঘটেছে। যেমন দেখো পরম + ঈশ = পরমেশ – এখানে পূর্বপদ ‘পরম’-এর শেষ ধ্বনি ‘অ’ এর সঙ্গে পরপদ ‘ঈশ’-এর প্রথম ধ্বনি ‘ঈ’-এর মিলন ঘটেছে ‘এ’তে পরিণত হল। এরকমভাবে স্বরসন্ধির কিছু নিয়ম বের করা যায় যা থেকে উদাহরণগুলির সাহায্যে সন্ধির কারণগুলি বুঝে নেওয়া যেতে পারে।
সন্ধির সূত্রগুলি এরকম –
সাধারণত এই নিয়মের বাইরেও অনেক প্রকারের স্বরসন্ধি ঘটে থাকে। তাই এবারে সেই বিশেষ ক্ষেত্রগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাক। যেমন ধরো –
এইরকম আরো বহু উদাহরণ তোমরা যে কোনো ব্যাকরণের বইতে পাবে।
আবারও বলি ব্যাকরণে উদাহরণই শেষ কথা, উদাহরণই প্রধান। তাই যত বেশি উদাহরণে চোখ বোলাবে, ততই তোমাদের ধারণা পরিস্কার হবে।
উপরোক্ত স্বরসন্ধিগুলিতে যে নিয়ম খাটে তা অনেকটা এইরকম –
আশা করি স্বরসন্ধির ধারণা তোমাদের পরিস্কার হয়েছে। এবারে আমরা চলে আসবো ব্যঞ্জনসন্ধির আলোচনায়।
ব্যাঞ্জনসন্ধি
ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির বা অপর কোনো ব্যঞ্জনধ্বনির মিলনকে বলা হয় ব্যঞ্জনসন্ধি। এই ব্যঞ্জনসন্ধির ক্ষেত্রেও কিছু সাধারণ নিয়ম কার্যকরী হয়। আমরা আগে কিছু উদাহরণ দেখে নিই, তারপর কোন সূত্রে সেগুলি ঘটছে তা দেখা যাবে।
এইরকমভাবে দেখা যাচ্ছে ব্যঞ্জনসন্ধির ক্ষেত্রেও কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সন্ধিগুলির দিকে খেয়াল রেখে এবারে তোমরা নিয়মগুলির দিকে চোখ রাখো –
সন্ধির উদাহরণের সঙ্গে ক্রম মিলিয়েই এই সূত্রগুলি এখানে দেওয়া হল তোমাদের বোঝার সুবিধের জন্য। এবারে কিছু অন্যরকমের ব্যঞ্জনসন্ধির দিকে তাকানো যাক –
তোমরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো উদাহরণের পাশে সূত্রগুলি দেওয়া আছে। মোটামুটিভাবে ব্যঞ্জনসন্ধি এভাবেই ঘটে থাকে। আবারও বলবো উদাহরণকে বেশি গুরুত্ব দাও, সূত্রকে নয়।
আরো পড়ুন → ধ্বনির ধারণা | বর্ণ | বাক্য
এই মুহূর্তে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শব্দের মধ্যে এমনভাবে সন্ধি ঘটে যে তার কোনো বিশেষ নিয়ম থাকে না। যেখানে নিয়মের বালাই নেই অর্থাৎ অনিয়মের সন্ধিকে ব্যাকরণে বলা হয় নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি। এই নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধিও আবার স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি, বিসর্গসন্ধি এই তিনরকম হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘তাসের দেশ’-এ লিখেছিলেন গান – ‘চলো নিয়মমতে, চলো নিয়মমতে…’। এরা যেন মূর্তিমান সেই নিয়ম ভাঙার দল।
দেখে নিই চলো নিয়ম ভাঙার মজা কেমন সন্ধি ঘটায়।
এরপরে সবশেষে আমরা বিসর্গ সন্ধি নিয়ে দু’চার কথা বলে আলোচনা শেষ করবো।
বিসর্গ সন্ধি
আসলে বিসর্গ হল র এবং স-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। অর্থাৎ যে প্রকার সন্ধিতে শব্দ মধ্যস্থ র কিংবা স-এর বদলে সন্ধিযুক্ত পদে বিসর্গ আসে তাকে বিসর্গ সন্ধি বলা হয়। ফলে বিসর্গ সন্ধির প্রকারভেদ দুইরকম – র-জাত বিসর্গ সন্ধি এবং স-জাত বিসর্গ সন্ধি।
উদাহরণগুলির দিকে ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পাবে বিসর্গের বদলে শব্দের মধ্যে র এবং স বসেছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই পূর্বপদের শেষে বিসর্গটি থাকবে। তবে এখানেও কিছু কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন –
১. কোনো কোনো সময় বিসর্গের সঙ্গে র-ধ্বনির সন্ধি ঘটলে বিসর্গটি লোপ পেয়ে আগের হ্রস্বধ্বনিটি দীর্ঘ হয়ে যায়। উদা: – নিঃ + রব = নীরব , নিঃ + রস = নীরস।
২. নিপাতনে সিদ্ধ বিসর্গসন্ধির ক্ষেত্রে তো ব্যতিক্রম থাকবেই। উদা: – মনঃ + কষ্ট = মনঃকষ্ট, শিরঃ + পীড়া = শিরঃপীড়া। এখানে লক্ষণীয় যে বিসর্গটি সন্ধির পরেও লোপ পাচ্ছে না।
আশা করি এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সন্ধির যে ব্যাপ্ত এলাকা তার ধারণাটুকু পরিস্কার করে বোঝানো গেছে। আজকের মতো এটুকুই। আবার কথা হবে সহজে ব্যাকরণের পরবর্তী কোনো নতুন পর্বে।
পঞ্চম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বিশেষণ
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখাটি, অডিও, ভিডিও বা অন্য কোন ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতিঃ
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা