জীবন বিজ্ঞান – দশম শ্রেণি – বংশগতি (প্রথম পর্ব)
অনেক সময় বলা হয়ে থাকে যে ছেলেকে অবিকল বাবার মতো দেখতে হয়েছে, আবার অনেক সময় বলা হয় যে পিসীর মতো দেখতে হয়েছে ভাইঝিকে। এর কারণ জানতে হলে আমাদের বংশগতি সম্পর্কে জানতে হবে।
প্রথমেই দেখা যাক, বংশ বলতে কি বোঝায়?
গতি কথার অর্থ হল ধারা বা প্রবাহ।
তাই তোমার বংশের ধারা তোমার মধ্যে প্রবাহমান। কিভাবে কোন বৈশিষ্ট্য, কোন অসুখ বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয় তা আমরা খুব সহজভাবে এই অধ্যায়ে বোঝার চেষ্টা করবো।
বংশগতির ইংরাজি হল Heredity। বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এক জনু থেকে অন্য জনুতে সঞ্চারণকে বংশগতি বা Heredity বলা হয়। বিজ্ঞানের যে শাখায় বংশগতির অধ্যয়ন করা হয় তাকে জেনেটিক্স বলে।
এবার দেখা যাক জনু বা generation কি?
আমরা শুরুতেই একটা চার্ট দেখেছি, যেখানে তোমার পিতার দিক থেকে বংশ তালিকা দেওয়া হয়েছিল।
বংশতালিকা শুরু হয়েছিল, তোমার প্রপিতামহ থেকে,তোমার প্রপিতামহ একটি জনু তার পরবর্তী জনু হলেন তোমার পিতামহ আর তার পরবর্তী জনু তোমার পিতা এবং তার পরবর্তী জনু হলে তুমি।
এই বংশগতি সম্বন্ধে ধারণা করতে গেলে কয়েকটি পরিভাষা সম্পর্কে তোমাকে জানতে হবে।
a) বৈশিষ্ট্য বা Character –
আমাদের দেহের কোন বিশেষ গঠনকে আমরা বৈশিষ্ট্য বা Character বলি। যেমন চুলের রং, ত্বকের বর্ণ, চোখের মনির রং, উচ্চতা ইত্যাদি।
এই বৈশিষ্ট্য বা character কিভাবে এক জনু থেকে অন্য জনুতে সঞ্চারিত হয়?
এই সঞ্চারণ হয় জিন দ্বারা।
এই জিন কি? এটা কোথায় অবস্থান করে?
Gene হল DNA এর একটা অংশ।
DNA কোথায় থাকে?
DNA থাকে ক্রোমোজোমের মধ্যে।
ক্রোমোজোম কোথায় থাকে?
ক্রোমোজোম অবস্থান করে কোশের মস্তিষ্ক নিউক্লিয়াসে।
তাহলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হল যে কোশের নিউক্লিয়াসে ক্রোমোজোমের মধ্যে অবস্থিত DNA এর অংশ হল জিন।
জিন কি, এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে আমাদের DNA-এর গঠন সম্পর্কে আরো ভালো করে বুঝতে হবে।
DNA হলো একটি পলিনিউক্লিওটাইড অর্থাৎ বহু নিউক্লিওটাইড সমন্বিত একটি অণু। ডি – অক্সিরাইবোজ সুগার এবং পিউরিন অথবা পিরিমিডিন বেস একত্রে তৈরি করে নিউক্লিওসাইড। নিউক্লিওসাইডের সঙ্গে ফসফেট যুক্ত হয়ে তৈরী হয় নিউক্লিওটাইড অর্থাৎ একটি নিউক্লিওটাইডে ফসফেট, ডি – অক্সিরাইবোজ সুগার এবং পিউরিন অথবা পিরিমিডিন বেস থাকে।
দুটো নিউক্লিওটাইড পরস্পর ডাই এস্টার ফসফেটবন্ধনী দ্বারা যুক্ত হয়।
DNA এর মেরুদন্ড বা Backbone ডি অক্সিরাইবোজ সুগার আর ফসফেট দিয়ে তৈরি হয়।
DNA এর single strand বা একতন্ত্রী গঠনে যে Base গুলো সজ্জিত থাকে তার পর পর তিনটি বেস একটি ট্রিপলেট কোড অর্থাৎ সংকেত গঠন করে।
প্রতিটি কোড, এক একটি অ্যামিনো অ্যাসিডকে উপস্থাপিত করে এবং এই অ্যামিনো অ্যাসিড গুলি পরস্পর পেপটাইড বণ্ড দ্বারা যুক্ত হয়ে এক একটি পলিপেপটাইড চেন বা প্রোটিন গঠন করে।
যেমন ছবিতে আমরা দেখেছি DNAতে উপস্থিত TAC এই তিনটি Base, Transcription পদ্ধতিতে RNAতে AUG এই তিনটি Base পরপর সংশ্লেষিত করেছে। আবার এই তিনটি base Methione নামক অ্যামিনো অ্যাসিডকে সংশ্লেষ করে।
DNA তে উপস্থিত CAC, AAC এবং TCG এই ট্রিপলেট কোডগুলি যথাক্রমে ভ্যালিন, লিউসিন এবং সেরিন নামক অ্যামিনো অ্যাসিডকে সংশ্লেষ করে।
এইভাবে সংশ্লেষিত অ্যামিনো অ্যাসিড গুলি পর পর যুক্ত হয়ে একটি পলিপেপটাইড চেন তৈরি করে।
এইভাবে বিভিন্ন পলিপেপটাইড চেন তৈরি হয় এবং এই পলিপেপটাইড চেন গুলি আমাদের দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
b) লোকাস
দেহের কোন বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী জিন ক্রোমোজোমের যে বিন্দুতে অবস্থান করে তাকে লোকাস বলে। সকল সমসংস্থ ক্রোমোজোমের লোকাস এক।
সহজ ভাবে বুঝতে গেলে লোকাসকে এককথায় জিনের বাড়ি বা বাসস্থান বলা যেতে পারে।
নিশ্চয় ভাবছো যে, সমসংস্থ ক্রোমোজম কাকে বলে?
আমরা জানি আমাদের দেহকোশে ক্রোমোজোম সংখ্যা 46 বা 23 জোড়া। প্রতি ক্রোমোজোম জোড়া পরস্পরের সমসংস্থ।
যে দুটি ক্রোমোজোমের মধ্যে মধ্যে মিল (similarities) বেশী, পার্থক্য (variation) কম, সেই ক্রোমোজোম দুটিকে সমসংস্থ ক্রোমোজোম বলে । সন্তান এই এক জোড়া ক্রোমোজোমের একটি পিতার থেকে ও একটি মাতার থেকে লাভ করে।
c) অ্যালিল
কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রনকারী জিনের দুটি রূপ থাকে যা সমসংস্থ ক্রোমোজোম এর লোকাসে অবস্থান করে তাকে অ্যালিল বলে। এই অ্যালিলের দুটি রূপ এক হতে পারে বা ভিন্ন হতে পারে।
[Alternative form of gene is called Allele]
যেমন উচ্চতা – এই বৈশিষ্ট্যটির দুটি ভিন্নরূপ হল লম্বা ও বেঁটে। লম্বা বৈশিষ্ট্য A দ্বারা ও বেঁটে বৈশিষ্ট্য a দ্বারা প্রকাশিত করা হতে পারে।
এবার লোকাসে অবস্থিত দুটি জিন কি কি হতে পারে, দেখা যাক।
i) দুটিই লম্বা বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রন কারী জিন সমন্বিত অ্যালীল (AA)
ii) দুটিই বেঁটে বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রন কারী জিন সমন্বিত অ্যালীল (aa)
iii) একটি লম্বা ও একটি বেঁটেবৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রন কারী জিন সমন্বিত অ্যালীল (Aa/aA)
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে অ্যালিলদুটি এক বা ভিন্ন হতে পারে।
d) হোমোজাইগাস ও হেটারোজাইগাস জীব
হোমো কথার অর্থ হল ‘সম’। যে জীবের দেহে কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রনকারী জিনদুটি (যা সমসংস্থ ক্রোমোজোমের একই লোকাসে অবস্থিত) একই হয় তাকে হোমোজাইগাস জীব (AA) এবং যে জীবের ক্ষেত্রে কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য জিনের দুটি ভিন্নরূপ (যা সমসংস্থ ক্রোমোজোমের একই লোকাসে অবস্থিত) উপস্থিত থাকে তাকে হেটারোজাইগাস জীব বলা হয় (Aa) বলে। ‘হেটারো’ কথার অর্থ ‘ভিন্ন’, তাই এই প্রকার জীবকে হেটারোজাইগাস জীব বা সংকর জীব বলে।
e) প্রকট বৈশিষ্ট্য ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য
হেটারোজাইগাস জীবটি দুটি বিপরীত বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রনকারী জিন সমন্বিত, এই জীবের ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ পাবে সেটি প্রকট বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ প্রকাশিত বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যটি হলো প্রকট বৈশিষ্ট্য। যেমন Aa সমন্বিত জীবটি লম্বা। তাহলে এখানে প্রকট বৈশিষ্ট্যটি হল লম্বা, যার জন্য দায়ী A জিন।
আর সংকর জীবে যে বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশিত হয় না তাকে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য বলে। যেমন এই ক্ষেত্রে a দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বেঁটে বৈশিষ্ট্যটি।
মনে রাখতে হবে যে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য তখনই প্রকাশিত হয় যখন অ্যালিলের দুটি জিনই প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়, যেমন aa সমন্বিত জীব। যা সব সময়ই বেঁটে বৈশিষ্ট্য যুক্ত হবে।
f) ফিনোটাইপ
কোন জীবে যে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশিত হয় তাকে ফিনোটাইপ বলে। যেমন Aa সমন্বিত জীবটি লম্বা অর্থাৎ জীবটির ফিনোটাইপ হলো ‘লম্বা’।
g) জিনোটাইপ
‘Aa’ অ্যালিল সমন্বিত জীবটি বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য লম্বা হলেও, জিনের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় জীবটি সংকর।যেখানে a বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশিত হয়নি।
h) সংকরায়ন
আমরা বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা আগেই জেনেছি, যখন বিপরীত বৈশিষ্ট্যের এক বা একাধিক চরিত্র যুক্ত জীবের একই প্রজাতির মধ্যে নিষেক ঘটিয়ে জীব সৃষ্টির পদ্ধতিকে সংকরায়ন বলা হয়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, একটি সাদা বিড়ালের (bb) সাথে একটি কালো বিড়ালের (BB) নিষেক ঘটিয়ে সৃষ্ট কালো বিড়াল।
i) বিশুদ্ধ জীব – যখন একই প্রজাতির অন্তর্গত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের একটি জীবের সাথে ঐ একই বৈশিষ্ট্য যুক্ত অপর একটি জীবের মধ্যে বার বার নিষেক ঘটিয়ে একই বৈশিষ্ট্য যুক্ত জীব সৃষ্টি হয় তখন তাকে বিশুদ্ধ জীব বলা হয়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দুটি কালো বিড়ালের (BB) মধ্যে নিষেক ঘটিয়ে সৃষ্ট কালো বিড়াল (BB)।
অর্থাৎ আমরা আগেই জেনেছি যে BB ক্রোমোজম এবং Bb ক্রোমোজম সমন্বিত দুটি জীবের রঙই কালো হবে। কিন্তু Bb ক্রোমোজম সমন্বিত বিড়ালটির রঙ কালো হলেও, তার মধ্যে সাদা রঙ (b) প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য হিসাবে উপস্থিত রয়েছে। তাই এটি বিশুদ্ধ জীব হিসাবে গণ্য করা হবে না।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
k) সংকর জীব
যখন একই প্রজাতির অন্তর্গত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের একটি জীবের সাথে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের একটি জীবের মধ্যে নিষেক ঘটিয়ে জীব সৃষ্টি হয় তাকে সংকর জীব বলা হয়।
উদাহরণ – একটি কালো বিড়াল (BB) ও একাটি সাদা বিড়ালের (bb) মধ্যে নিষেক ঘটিয়ে সৃষ্ট কালো বিড়াল (Bb)।
প্রথম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → একসংকর জনন।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-LSc-3a