mohabidroher-coritro
Madhyamik

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি

ইতিহাসদশম শ্রেণি – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (পর্ব – ১)

গত পর্বে আমরা ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানবো।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ছিল আধুনিক ভারতের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় রেজিমেন্টে শুরু হওয়া, এই বিদ্রোহ অত্যাচারী ঔপনিবেশিক শাসকদের ধমনীতে বইয়ে দিয়েছিল আতঙ্কের চোরাস্রোত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতের শাসনক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটেন। দিল্লিতে বিদ্রোহী সিপাহীরা অশীতিপর মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘ভারত সম্রাট’ হিসেবে ঘোষণা করে।

1857 এর মহাবিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ

ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, কানপুরের পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের দত্তকপুত্র নানাসাহেব ও তাঁতিয়া টোপি, অযোধ্যায় বেগম হজরতমহল, বিহারে কুনওয়ার সিং, বরেলিতে বাহাদুর খান, ফৈজাবাদে মৌলভি আহমাদুল্লাহ প্রমুখ দেশীয় রাজন্যবর্গ বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন। কাজেই বুঝতে পারছো, এই বিদ্রোহ অঞ্চল ও সম্প্রদায় ভেদে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদ্রোহীরা ঔপনিবেশিক প্রশাসনকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়।

বিদ্রোহী বলপূর্বক দমনের পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

এত ব্যাপক যে বিদ্রোহের পরিধি তাকে নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যে নানান মতামত থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এই বিবিধ মতামতের মধ্যে যেগুলি বিশেষ করে প্রণিধানযোগ্য সেরকম কিছু মতামতের সঙ্গে আজ তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেব।

সিপাহী বিদ্রোহ

কিছু কিছু পণ্ডিতের মতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল শুধু সিপাহীদেরই বিদ্রোহ। রবার্টস, জন কে, জন সিলি প্রমুখ ইউরোপীয় ছাড়াও দাদাভাই নওরোজি, রাজনারায়ণ বসু, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ আহমেদ খান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গও এই মতকে সমর্থন করেছেন। এঁদের যুক্তি ছিল যে দেশীয় রাজশক্তি এই বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও আন্দোলনের পুরোভাগে কিন্তু ছিল সিপাহীরাই। শিক্ষিত ভারতীয়রা তো বিদ্রোহ সম্পর্কে নিস্পৃহ অবস্থান নিয়েছিল। একথা যদিও ঠিক যে দিল্লি ও লখনউয়ের মত স্থানে বিদ্রোহের নেতৃত্বে সিপাহীরাই ছিল কিন্তু মহাবিদ্রোহকে শুধু সিপাহীদের বিদ্রোহ বললে সেটা বিদ্রোহের ব্যাপ্তিকে কোথাও ছোট করে।

জাতীয় বিদ্রোহ

ঐতিহাসিক হোমস, ডাভ, ম্যালেসন, জে. বি. নর্টন, আউট্রাম এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের টোরি দলের সদস্য ডিসরেলি সিপাহী বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ আখ্যা দিয়েছেন। সাম্প্রতিক কালে ডঃ রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়, রণজিৎ গুহ, সুপ্রকাশ রায় প্রমুখও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। এঁদের প্রধান যুক্তি হল সিপাহী বিদ্রোহ সিপাহীরা শুরু করলেও পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন অংশের জনগণ এতে যোগদান করেছিল। এই একই কারণে চিন্তাবিদ কার্ল মার্ক্সও এই বিদ্রোহের মধ্যে ভারতবাসীর শৃঙ্খলমুক্তির সম্ভাবনা দেখেছিলেন। তাছাড়া বিদ্রোহীদের বাহাদুর শাহকে ‘ভারত সম্রাট’ ঘোষণা করার মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিদ্রোহের সাফল্যের জন্য তারা একটি জাতীয় প্রতীককে সামনে রাখা প্রয়োজন মনে করেছিল।


jump magazine smart note book


ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম

বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকার তাঁর ‘দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’ গ্রন্থে প্রথম সিপাহী বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে অধ্যাপক সুশোভন সরকার ও হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জীও এই একই মত প্রকাশ করেছেন।

সামন্তশ্রেণীর বিদ্রোহ

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, রজনীপাম দত্ত, এম. এন. রায় প্রমুখ বামপন্থী পণ্ডিতের মতে সিপাহী বিদ্রোহ ছিল সামন্তশ্রেণীর বিদ্রোহ। সিপাহীদের থেকে পরবর্তীকালে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেশীয় রাজন্যবর্গের হাতে চলে যাওয়ার কারণেই তাদের এই ধারণা হয়েছিল। তাঁদের মতে, এই সামন্তশ্রেণীর প্রতিনিধিরা ঔপনিবেশিক শাসনে তাদের ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের আশায় বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। এর ফলে সিপাহী বিদ্রোহ একটি প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র পরিগ্রহ করে। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই একে মৃতপ্রায় সামন্তশ্রেণীর ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে উপরিউক্ত কোনো মতই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার যেমন বলেছেন যে, তথাকথিত ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ – প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়। আধুনিক গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়, সমগ্র বাংলাদেশ ও দাক্ষিণাত্যের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিদ্রোহের আঁচ থেকে দূরে ছিল। পাঞ্জাব, রাজপুতানা, সিন্ধুপ্রদেশেও সিপাহী বিদ্রোহ তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

যেসব বিশেষজ্ঞ এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহের পর্যায়ভুক্ত করতে চাননি তাঁদের যুক্তি হল যে এই বিদ্রোহে অংশ নেওয়া সব মানুষের লক্ষ্য একরকম ছিল না। সেই যুগে স্বাধীনতা সম্পর্কে সকলের ধারণাও স্বচ্ছ ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসনের বিপদ সম্পর্কেও সেভাবে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ এই দেশব্যাপী অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামাও ঘটিয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক প্রতিবাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভারতীয়রা সচেতন হয়।


মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।↓

মহাবিদ্রোহের চরিত্র

এতক্ষণ সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব সম্পর্কে তোমাদের একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এখন তোমাদের বলব কাদের স্বার্থে এই বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল আর কাদেরই বা এতে সুবিধা হল। এ নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কের অন্ত নেই। এরিক স্টোকস এই বিদ্রোহে সামন্তশ্রেণীর নেতৃত্বের স্থানে উঠে আসা দেখে একে সমাজের উচ্চকোটির বিদ্রোহ বলেছেন। আবার সিপাহী বিদ্রোহের প্রায় সমসাময়িক কেউ কেউ একে মোগল-মুসলমানি ষড়যন্ত্রও বলতে ছাড়েননি। ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র প্রমুখের গবেষণায় আবার ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে নিম্নবর্গের মানুষের নেতৃস্থানীয় ভূমিকার কথা উঠে এসেছে। সাঁওতাল বিদ্রোহ কিন্তু এই আবহেই সংঘটিত হয়। আর তা যে কিভাবে প্রতিবাদের এক বিকল্প ভাষা নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিল সে তো তোমাদের আগেই বলেছি।

মহাবিদ্রোহের সাথে জাতীয়তাবোধের সম্পর্ক

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সঙ্গে জাতীয়তাবোধের সম্পর্ক একইসঙ্গে গভীর ও জটিল। ঐতিহাসিক পানিক্করের মতে, সিপাহীরা শুধু তাঁদের স্বার্থে নয় সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। সুশোভন সরকারও বলেছেন যে, বিদ্রোহীরা ‘সাবেকি ঐক্যে’ বিশ্বাসী ছিল।

অর্থাৎ, সিপাহী বিদ্রোহের জাতীয়তাবাদী চরিত্রকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তাতে এটা হলফ করে বলা যায় না, যে এই বিদ্রোহ সচেতন জাতীয়তাবোধের ফসল। যেমন যে বাংলার ব্যারাকপুরে সিপাহী বিদ্রোহের সূত্রপাত সেই বাঙালি সমাজের বৃহত্তর অংশ কিন্তু এই বিদ্রোহ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছিল। শিক্ষিত ভদ্রলোক সম্প্রদায় ছিল বিদ্রোহ সম্পর্কে উদাসীন। অধ্যাপক বরুণ দে মনে করেন যে বাংলায় বিদ্রোহের প্রাবল্য ও ধারাবাহিকতার অভাবের এটাই একমাত্র কারণ। নাগরিক ভদ্রলোকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রগুলোও তাই বিদ্রোহ সম্পর্কে নীরবতার রাস্তা বেছে নেয়। প্রমোদ সেনগুপ্তের মতে, বিদ্রোহ নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিস্পৃহ অবস্থানের কারণে তাদের শ্রেণিস্বার্থ।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

ইংরেজি মাধ্যমে পাঠরত নাগরিক ছাত্রসমাজ নিজেদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সক্রিয় ব্রিটিশ বিরোধিতা থেকে বিরত থেকেছিল। মজার ব্যাপার হল যে শ্রেণিস্বার্থ এই পর্বে তাদের ব্রিটিশ বিরোধিতা থেকে বিরত করেছিল সেই একই শ্রেণিস্বার্থ পরবর্তীকালে তাদের ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। কালক্রমে উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়দের মনে ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোয় অংশগ্রহণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এসবেরই ফলশ্রুতি ছিল জাতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে কংগ্রেসের আবির্ভাব। তাহলে বুঝতেই পারছ, কোনো গণআন্দোলনের পিছনে জাতীয়তাবোধের ভূমিকা নিরূপণের একাধিক মাপকাঠি থাকতে পারে।

বিদ্রোহ দমনের পর ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ লা নভেম্বর এলাহাবাদের দরবারে মহারানী ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং ‘মহারানীর ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

এই ঘোষণাপত্রে মহারানীর শাসনে ভারতীয়দের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই প্রতিশ্রুতি আসলে ভারতীয়দের মন জয়ের একটি প্রচেষ্টা ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতীয়দের অবস্থান কিছুমাত্র বদলালো না। উপরন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিবর্তে ‘ভারত শাসন আইন’ প্রণয়ন করে ভারতের শাসনভার সরাসরি ইংল্যান্ডের রানীর হাতে তুলে দেওয়া হল।


আরো পড়ো → মহারানীর ঘোষণাপত্র [টীকা]

তাই বলা যায়, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ দমনের মধ্য দিয়ে ভারতের ঔপনিবেশিক পরাধীনতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → সভা সমিতির যুগ

লেখক পরিচিতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এম ফিল পাঠরত রাতুল বিশ্বাস। ইতিহাসচর্চার পাশাপাশি লেখা-লিখিতেও সমান উৎসাহী রাতুল।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X_hist_4a