sonnyasi-fokir-bidroho
Madhyamik

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ

ইতিহাসদশম শ্রেণি – প্রতিরোধ বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (পর্ব – ৫)

গত পর্বে আমরা মুন্ডা বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে জানবো।

যদিও আদি ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে বিদেশি শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে মূলতঃ আদিবাসীরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, এই পর্বে ধর্মীয় ভাবাবেগসঞ্জাত কিছু বিক্ষিপ্ত আন্দোলনও সংঘটিত হয়েছিল। এই আন্দোলনগুলির চরিত্র নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, তবে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনকে গণমুখী করে তুলতে ধর্ম কিভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, তা বুঝতে গেলে আমাদের এই আন্দোলনগুলি সম্পর্কে একটু বিশদে জানতেই হবে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০)

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনালগ্নে সংঘটিত একটি ধর্মাশ্রয়ী কৃষক আন্দোলন। সন্ন্যাসী ও মাদারি ফকিরেরা ব্রিটিশ সরকারের অত্যধিক রাজস্ব আদায়, ধর্মানুষ্ঠানে যোগদানে বাধা প্রদান প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ

১) ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০) পরবর্তী বাংলার অর্থনীতির ভগ্নপ্রায় দশা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

১৭৬৫ সালের দেওয়ানী লাভের মধ্য দিয়ে স্থানীয় জমিদারবর্গের হাত থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার চলে যায় বহিরাগত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে।

কোম্পানির হাতে তখন বাংলার দায়িত্বহীন ক্ষমতা। অনাহার ও মহামারির দরুণ ব্যাপক হারে লোকক্ষয় হলেও নির্দয় কোম্পানি বাহাদুর রাজস্ব মুকুল করেনি। ফলে ঋণের দায়ে বহু কৃষক সর্ব্বস্বান্ত হয়। এই দরিদ্র, ভূমিহীন, কপর্দকশূন্য কৃষকেরা কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।


jump magazine smart note book


২) অন্যদিকে সন্ন্যাসীদের তীর্থে যাওয়ার ওপর সরকার তীর্থকর বসালে তাদের ধর্মীয় স্বাভিমানে আঘাত লাগে।

৩) এই সন্ন্যাসীদের মধ্যে অনেকেরই দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে কিছু জমিজমা ছিল। কোম্পানির খেয়াল খুশি মত রাজস্বের হার বৃদ্ধিতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা দরিদ্র কৃষকদের কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।

৪) ফকিরদের দরগায় যাবার ওপরেও বিধিনিষেধ চাপানো হয়েছিল। ফলে তাদের মধ্যেও ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

৫) সন্ন্যাসী-ফকিরদের মধ্যে যারা ব্যবসাবাণিজ্যে নিযুক্ত ছিল তাদের কাছ থেকে ইংরেজ কর্মচারীরা রেশম, কাপড় ইত্যাদি ব্যবসাজাত দ্রব্য প্রায়ই কেড়ে নিত।

৫) কোম্পানি প্রবর্তিত নতুন ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার হাত ধরে যে নতুন মহাজন-জমিদার শ্রেণী গড়ে উঠছিল তারা যাতে এক নতুন গ্রামীণ প্রভাবশালী গোষ্ঠী তৈরি করতে না পারে তাই সন্ন্যাসী-ফকিরেরা এই ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের বিস্তার ও পরিণতি

১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় প্রথম সন্ন্যাসী-ফকিরেরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ক্রমশ বিদ্রোহের আগুন কোচবিহার, রংপুর, মালদা, দিনাজপুর সহ উত্তর ও পূর্ববঙ্গের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় চার দশক ধরে এই সন্ন্যাসী-ফকিরেরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যায়। সংখ্যায় তারা ছিল প্রায় ৫০,০০০।

ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, মজনু শাহ, চিরাগ আলি শাহ, মুশা শাহ, কৃপানাথ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান করেন।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল


বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী’ প্রভৃতি উপন্যাসে এই সময়ের এক আলেখ্য পাওয়া যায়। বিদ্রোহীরা সাময়িকভাবে ব্রিটিশ শাসকবর্গের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করতে সমর্থ হয়েছিল। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের যুদ্ধে তারা সাফল্য লাভ করে এবং ইংরেজ সেনাপতি টমাস নিহত হন।

১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে অপর এক ইংরেজ সেনাপতি এডওয়ার্ডসও বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ভবানী পাঠক ইংরেজদের আক্রমণে নিহত হন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে মজনু শাহেরও মৃত্যু হয়। এরপর নেতৃত্বের বিদ্রোহটি স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহ দমনে লেফটেন্যান্ট মরিসন ও ম্যাজিস্ট্রেট হ্যামিলটন বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

ব্রিটিশ শাসনে গ্রামীণ সমাজের ওপর চিরায়ত ধর্মীয় অনুশাসনের কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে পড়লে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুদের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয় তারই ফলশ্রুতি ছিল এই বিদ্রোহ। বিদ্রোহী সন্ন্যাসী-ফকিরেরা অনেকসময়ই ব্রিটিশদের অনুগত জমিদারদের ঘরবাড়ি লুঠ করে দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বিলি করে দিত।

স্বভাবতই তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস একে ‘পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব’ বলেছেন। তবে সন্ন্যাসী-ফকির ছাড়াও সাধারণ দরিদ্র মানুষদের যে বিরাট অংশ এই বিদ্রোহে যোগদান করেছিল তা স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষ ব্যতীত সম্ভব ছিল না।


jump magazine smart note book


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

উইলিয়াম হান্টার যেমন একে কৃষক বিদ্রোহ আখ্যা দিয়েছেন। লেস্টার হ্যাচিনসন আবার মনে করেন যে এই বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল বিদেশি শত্রুর হাত থেকে নিজের দেশ ও ধর্মকে রক্ষা করা।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ওয়াহাবি আন্দোলন ও ফরাজি আন্দোলন


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X_hist_3e