ভূগোল – দশম শ্রেণি – ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ (সপ্তম পর্ব)
ভারতীয় পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
আগের পর্বে আমরা ভারতের জনসংখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা ভারতীয় পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হল দুটি স্থানকে সরাসরি বা অন্য কোনো মাধ্যমের সাহায্যে যুক্ত করা।
আমরা সকলেই বাস, ট্রেন, ট্রাম, নৌকো, বিমান, স্টিমার ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের যানবাহনের সাথে বহুলভাবে পরিচিত। রোজকার যাতায়াতে যে কোনো জায়গায় যাওয়ার জন্য এসব যানবাহনে আমরা চড়েছি। সহজভাবে বলতে গেলে এটাকেই আমরা পরিবহন ব্যবস্থা বলে থাকি।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
অপরদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হল কোনো জায়গায় সরাসরি না গিয়ে অন্য উপায়ে তথ্য বা জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যকাতিগত এবং গণযোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বারা যখন কোনো সংবাদ ও তথ্য পরবেশিত হয়, তাকেই যোগাযোগ ব্যবস্থা বলা হয়। বর্তমানে ফোন, ইন্টারনেট, জিপিএস এবং ডাক ব্যবস্থা যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম।
ভারতীয় পরিবহন ব্যবস্থার গুরুত্ব
পরিবহন ব্যবস্থা ভারতের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
১) পরিবহন ব্যবস্থার ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। দেশের ভিতর একস্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য পরিবহনের জন্য সড়কপথ, রেলপথ ও জলপথ পরিবহন ব্যবস্থাকে বিশেষভাবে কাজে লাগানো হয়েছে।
২) ভারতের বিভিন্ন শিল্পগঠনে বনজ, খনিজ, প্রাণীজ ও কৃষিজ কাঁচামাল শিল্পকেন্দ্রে নিয়ে যেতে এবং শিল্পজাত দ্রব্য বাজারে পাঠাতে পরিবহন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৩) পরিবহন ব্যবস্থা যাত্রী চলাচলের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে, তার ফলে দেশ বিদেশের মানুষের যাতায়তের মাধ্যমে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যার আদান প্রদান ঘটে। এর ফলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতি ঘটে ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
পরিবহনের বিভিন্ন মাধ্যম
ভৌগোলিক পরিবেশের পার্থক্যের জন্যে ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচ ধরণের পরিবহন ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। যথাক্রমে – স্থলপথ, জলপথ, আকাশপথ, পাইপলাইন এবং রজ্জুপথ। স্থলভাগে যে পথ নির্মাণ করা হয়, তাকে স্থলপথ বলে। দুই ধরণের স্থলপথ হয় যথা সড়কপথ এবং রেলপথ। এর মধ্যে সড়কপথ পরিবহন ব্যবস্থা সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রধান। সড়কপথ পরিবহনে খুব সহজেই যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা যায়। গ্রামের সঙ্গে শহরের সংযোগ রক্ষা করা এবং দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যে সড়কপথের গুরুত্ব খুব বেশি।
ভারতের সড়কপথ
যেসব সড়কপথ বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত রয়েছে এবং দেশের ওসব অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করার প্রধান ভূমিকা পালন করে, সেই সড়কপথকে জাতীয় সড়কপথ বলা হয়। ভারতের প্রাচীনতম ও ব্যস্ততম জাতীয় সড়কপথ হল গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড বা শেরশাহ সুরি মার্গ।
ভারতের দীর্ঘতম জাতীয় সড়কপথ NH-7 বারাণসী থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত।
সোনালি চতুর্ভুজ এবং উত্তর-দক্ষিন ও পূর্বপশ্চিম সড়কপথ করিডর হল ভারতের বৃহত্তম জাতীয় সড়ক নির্মাণ প্রকল্প।
দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই এবং মুম্বাই দেশের চারটি প্রান্তে থাকা এই চারটি মেট্রো সিটি বা মহানগরকে সংযুক্তকারী ছয়টি চ্যানেলবিশিষ্ট জাতীয় সড়কপথকে সোনালি চতুর্ভুজ প্রকল্প হিসেবে নামকরণ করা হয়। এই চতুর্ভুজের মোট দৈর্ঘ্য হল ৫৮৪৬ কিমি।
ভারতের রেলপথ
ভারতে প্রথম রেলপথের সূচনা হয়েছিল ১৮৫৩সালে মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত মোট ৩৩.৬ কিমি রাস্তা জুড়ে। ভারতীয় রেল যাত্রী পরিবহনে বিশ্বে প্রথম এবং পণ্য পরিবহনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
ভারতের রেলপথ মোট ১৬টি ভাগে আঞ্চলিকভাবে বিভক্ত, যথা – মধ্য রেল, পূর্ব রেল, দক্ষিণ-পূর্ব রেল, উত্তর রেল, উত্তর-পূর্ব রেল, উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল, দক্ষিণ রেল, দক্ষিণ-মধ্য রেল, পশ্চিম রেল, পূর্ব-মধ্য রেল, পূর্ব-উপকূল রেল, উত্তর-মধ্য রেল, উত্তর-পশ্চিম রেল, দক্ষিণ পূর্ব-মধ্য রেল, দক্ষিণ-পশ্চিম রেল, পশ্চিম-মধ্য রেল।
উত্তর রেল হল ভারতের দীর্ঘতম রেলপথ অঞ্চল।
ভারতীয় রেলের মোট দৈর্ঘ্যকে ভারতের জীবনরেখাও বলা হয়। ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় রেলের দৈর্ঘ্য সম্প্রসারণ হয়েছিল ৬৪৬০০ কিলোমিটার, যা এশিয়ার মধ্যে দীর্ঘতম এবং বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। ভারতের প্রথম মেট্রো রেল চালু হয় কলকাতা শহরে।
ভারতের জলপথ
জলপথ পরিবহন ব্যবস্থা ভারতের একটি অন্যতম প্রধান পরিবহন মাধ্যম। ভারত নদীপ্রধান দেশ হওয়ায় খুব সহজেই জলপথকে মাধ্যম করে পণ্য পরিবহনের আদর্শ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ভারতের জলপথকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ১) অভ্যন্তরীণ জলপথ এবং ২) সামুদ্রিক জলপথ।
দেশের অভ্যন্তরে কয়েকটি খাল কেটে বিভিন্ন নদনদীকে সংযুক্ত করে যে জলপথ গড়ে তোলা হয়, তাকেই অভ্যন্তরীণ জলপথ বলে। ভারতের প্রধান নদীপথ হল গঙ্গা নদী ও তার শাখানদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জলপথ। হুগলী নদীর মোহনা থেকে পাটনা পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ কিমি রাস্তা জলপথে যাত্রীবাহী স্টিমার চলাচল করে থাকে। দক্ষিণ ভারতীয় নদীগুলির মধ্যে কৃষ্ণা, কাবেরী, পেন্নার প্রভৃতি নদীতে স্থায়ীভাবে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের কাজ হয়।
ভারতের বেশকিছু খাল জলপথ পরিবহনের জন্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
এদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ইডেন খাল, দুরগাপুর খাল, ওড়িশার কোস্ট ক্যানেল, হরিদ্বার ও কানপুরের মধ্যে বিস্তৃত গঙ্গাখাল, কৃষ্ণা ও কাবেরী নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত বাকিংহাম খাল উল্লেখযোগ্য।
ভারতের তিনদিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা হওয়ার ফলে সহজেই দীর্ঘ উপকূল বরাবর অনেক বন্দর গড়ে উঠেছে। সমুদ্রে শিপিং লাইন এর মাধ্যমে ভারতের এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে পণ্য পরিবহন এবং বিদেশ থেকে আন্তর্জাতিক স্তরের পণ্য আমদানি এবং রপ্তানি হয়।
ভারতের আকাশপথ
যাত্রী পরবহনের একটি আধুনিক, দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হল আকাশপথ। বর্তমানে যাত্রী পরিবহন ছাড়াও হালকা মুল্যবান দ্রব্য, পচনশীল দ্রব্য পরিবহনে আকাশপথ ব্যবহৃত হয়।
ভারতের বিভিন্ন শহরে বিমানবন্দর গড়ে উঠেছে, দ্রুত পরিবহনের জন্য।
বিমান পরিষেবা প্রধানত দুইপ্রকারের, যথা- জাতীয় বিমানবন্দর এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
ভারতের কয়েকটি বিখ্যাত হল – ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (দিল্লি), নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (কলকাতা), বেঙ্গালুরু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (বেঙ্গালুরু), সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (আমেদাবাদ) ইত্যাদি।
অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম
ক) ভারতের মেট্রোরেল ব্যবস্থা
যে কোনো মেট্রো সিটিতে শহরের মধ্যে দ্রুত পরিবহনের জন্যে মাটির নীচে সুড়ঙ্গ কেটে যে এই রেলপথ তৈরি হয়, তাই এর আরেক নাম পাতালরেল বা ভূগর্ভ রেল। ভারতে প্রথম মেট্রোরেল চালু হয় কলকাতায় ১৯৮৪ সালে। বর্তমানে দক্ষিণেশ্বর থেকে নিউ গড়িয়া পর্যন্ত মেট্রো রেল বিস্তৃত।
সল্টলেক থেকে হাওড়া পর্যন্ত ইস্ট-অয়েস্ট মেট্রো সম্প্রসারণের প্রকল্প গৃহীত হয়েছে যেটি হবে ভারতের প্রথম জলের নীচ দিয়ে স্থাপিত মেট্রো রেল। দিল্লি মেট্রো বর্তমানে সর্বাধুনিক মেট্রোরেল পথ, এটি স্থাপিত হয় ২০০২ সালে। দিল্লির ইয়োলো লাইন রেলপথ ভারতের দীর্ঘতম ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ।
বেঙ্গালুরু শহরে মেট্রোরেল পরিষেবা চালু হয় ২০১১ সালে। এটি ভারতের প্রথম মেট্রোরেল যেখানে ট্রেনের মধ্যে Wi-Fi পরিষেবা পাওয়া যায়।
খ) রজ্জুপথ
ভারতের পাহাড়ি এলাকায় দুর্গম অঞ্চলে যাতায়তের জন্যে রজ্জুপথ ব্যবহার হয়। এছাড়াও পার্বত্য শহরে পর্যটনের একটি বিশেষ আকর্ষণ হল রজ্জুপথ।
গ) পাইপলাইন
প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল, জল প্রভৃতি তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ পরিবহনের জন্যে বিশেষভাবে পাইপলাইন ব্যবহার হয়ে থাকে।
যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম
১) ইন্টারনেট ও ইমেল
পৃথিবীর সমস্ত কম্পিউটারকে টেলিফোন লাইন টাওয়ারের মাধ্যমে যুক্ত করার ফলে যে বিশাল একটি সংযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হয় তাকেই ইন্টারনেট বলে। এই ব্যবস্থায় কোনোরকম তারের উপস্থিতি ছাড়াই দ্রুত খুব কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্য পৌঁছে দেওয়া যায়।
এই ব্যবস্থায় কম্পিউটারের মাধ্যমে ইমেলে সংবাদ, বার্তা, ছবি, গান, ব্যবসা সংক্রান্ত চিঠিপত্র পাঠানো যায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে টাকার লেনদেন, ব্যাঙ্কিং পরিষেবা, রেল ও বিমানের টিকিট পরিষেবা এবং আরও অসংখ্য জরুরি কাজ হয়ে থাকে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট, চ্যানেল, খবর ইত্যাদি ইন্টারনেটের মাধ্যমেই সুদূরপ্রসারী সাহজ্য করছে শিক্ষা সংস্কৃতি, ব্যবসা বাণিজ্যকে।
২) মোবাইল ফোন
এটি একটি তারবিহীন সহজেই ব্যবহারযোগ্য একটি যন্ত্র। উপগ্রহ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার মাধ্যমে মোবাইলের সাহায্যে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে সাথে সাথেই যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব।
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে মোবাইল ফোন একটি সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার। বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীকে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সবচেয়ে আধুনিক যুগ বলা হয়ে থাকে।
সমাপ্ত।
লেখিকা পরিচিতি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্রী শ্রীপর্ণা পাল। পড়াশোনার পাশাপাশি, গান গাইতে এবং ভ্রমণে শ্রীপর্ণা সমান উৎসাহী।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-geo-6-g