বিষয়: ভৌতবিজ্ঞান – দশম শ্রেনি –অধ্যায়: রাসায়নিক গণনা
রাসায়নিক গণনার কি প্রয়োজন?
রসায়নের বিভিন্ন বিক্রিয়া পরীক্ষাগারে সম্পাদনের সময়ে আমাদের সেই বিক্রিয়ার গতিবিধি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরী করতে হয়। তার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে রসদের অপচয় রোধ।
আমরা একটা উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা আর একটু বুঝে দেখার চেষ্টা করি।
ধরা যাক, x gm NH3-এর সাথে y gm HCl বিক্রিয়া করবে। তার জন্য একটি আবদ্ধ পাত্রে গ্যাসদুটিকে ধরে রেখে সামান্য ঠান্ডা করতে হবে। এদের ঠান্ডা করার জন্য জন্য শীতক যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া হবে। এখন আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে বিক্রিয়াটি শেষ হলো কিনা। কারণ বিক্রিয়া শেষ হওয়ার পরেও শীতক যন্ত্র চালিয়ে রাখলে বিদ্যুতের অপচয় হবে। বিক্রিয়া শেষ হওয়ার পূর্বেই যন্ত্র বন্ধ করে দিলে বিক্রিয়ক গ্যাসের অপচয়। তাই আমাদের আগেভাগেই গণনা করে দেখে নিতে হবে যে ঐ x gm NH3 কতক্ষনে y gm HCl এর সাথে বিক্রিয়া করবে। আর সেই অনুযায়ী আমাদের শীতক যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে।
[আরো পড়ুন – ভৌত বিজ্ঞান – প্রথম অধ্যায়: পরিবেশের জন্য ভাবনা]
রাসায়নিক গণনা করতে গেলে কি কি তথ্যের প্রয়োজন হয়?
রাসায়নিক গণনার ক্ষেত্রে সবথেকে আগে যে দুটি ধারণা আমাদের কাছে স্পষ্ট হওয়া জরুরি তা হল –
১. শমিত সমীকরণ
২. পারমাণবিক ভর
শমিত সমীকরণ কাকে বলে?
শমিত সমীকরণের সাহায্যে আমরা একটি বিক্রিয়ার বামপার্শ্বে মোট পরমাণুর সংখ্যা ও ডানপার্শ্বে মোট পরমাণুর সংখ্যা সমান দেখি। বিক্রিয়ার বামপার্শ্ব বিক্রিয়ার শুরুর অবস্থাকে ও ডানপার্শ্ব বিক্রিয়ার শেষের অবস্থাকে নির্দেশিত করে। এখন আমরা জানি যে পরমাণুকে ধ্বংসও করা যায় না, আবার সৃষ্টিও করা যায় না। সে ক্ষেত্রে আমাদের বিক্রিয়ার পূর্বে যে পরমাণু যতগুলি করে থাকবে, বিক্রিয়ার শেষেও সেই পরমাণুগুলি ততগুলি করেই বিদ্যমান থাকবে।
Ca(OH)2 + HCl = CaCl2 + H2O
এই সমীকরণটি অশমিত। কারণ বিক্রিয়ার বাম দিকে 1টি Ca, 1টি Cl, 3টি H ও 2টি O বর্তমান। কিন্তু ডানদিকে বিক্রিয়ার বাম দিকে 1টি Ca, 2টি Cl, 2টি H ও 1টি O বর্তমান। অর্থাৎ কিছু পরমাণু অদৃশ্য হয়ে গেছে (যেমন O এবং H) আবার কিছু পরমাণু আবির্ভুত হয়েছে (যেমন Cl)। এরকম হওয়া অসম্ভব।
তাই বিক্রিয়াটিকে শমিত করে পাই –
Ca(OH)2 + 2HCl = CaCl2 + 2H2O
উপরের বিক্রিয়ার বাম দিকে 1টি Ca, 2টি Cl, 4টি H ও 2টি O বর্তমান। বিক্রিয়ার শেষেও ডান দিকে একই সংখ্যক পরমাণু বর্তমান। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা বিদ্যমান। আমরা বাস্তব ক্ষেত্রে পরমাণুগুলিকে হাতে ধরে গুনতে পারবো না. আর পারলেও সেগুলি অণুর অংশ হিসাবে বর্তমান। সেক্ষেত্রে আমাদের যার সাহায্য নিতে হয় তা হল ভরের নিত্যতা সূত্র।
[আরো পড়ুন – জীবন বিজ্ঞান | দ্বিতীয় অধ্যায় – জীবনের প্রবাহমানতা (কোশ বিভাজন)]
ভরের নিত্যতা সূত্র কি?
যেমন আগের উদাহরণ থেকে দেখতে পাই যে Ca-এর ভর বিক্রিয়ার আগে ছিল 40। বিক্রিয়ার পরেও তা হল 40। কারণ Ca-এর পারমাণবিক গুরুত্ব 40 এবং এটি 1টি মাত্রই পরমাণু আছে। Cl এর ভর 35.5, বিক্রিয়ার আগে দুটি পরমাণু ছিল। সুতরাং মোট ওজন 35.5×2= 71। বিক্রিয়ার শেষেও তাই হল। কিন্তু এরা এক পরমাণুর অংশ ছিল না, বিক্রিয়ার পরে হয়েছে। তাহলে CaCl2 এর মোট ওজন 40+71=111।
O এর পারমাণবিক ভর 16, H এর 1। বিক্রিয়ার আগে মোট O-এর ভর ছিল 16×2=32। H-এর ভর ছিল 1×4=4। O ছিল Ca(OH)2 এর অংশ। 2টি H ও তারই অংশ ছিল, বাকি দুটি H, HCl এর অংশ ছিল। তাহলে HCl এর আণবিক গুরুত্ব 1+35.5=36.5। Ca(OH)2 এর আণবিক গুরুত্ব 40+(16+1)x2= 40+34=74। উৎপাদিত জলের আণবিক ভর দাঁড়াচ্ছে 2×1+16=18।
এখন যদি বিক্রিয়া শমিত না হয়, বিক্রিয়কের মোট ভর হবে 74+36.5=110.5। বিক্রিয়াজাতের মোট ভর হবে 111+18=129, অর্থাৎ বিক্রিয়া শেষে নতুন ভরের আবির্ভাব হয়েছে। এরকম ভৌতিক কান্ডকারখানা ভৌতবিজ্ঞানে সম্ভব নয়। অপরদিকে আমরা যদি শমিত সমীকরণের ভরের গণনা করি, বিক্রিয়কের মোট ভর বেরোয় 74+2×36.5= 74+73= 147। বিক্রিয়াজাতের মোট ভর পাওয়া যায় 111+2×18= 111+36= 147। অর্থাৎ ভরের নিত্যতা সুরক্ষিত হয়েছে।
জড় পদার্থ সৃষ্টিও হয় না আবার ধ্বংসও হয় না। বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জড় পদার্থের রূপান্তর হয় মাত্র। কিন্তু এই পরিবর্তনে মোট ভরের কোন পরিবর্তন হয় না। একে ভরের নিত্যতা সূত্র বলে।
তার মানে পরীক্ষাগারে যদি 74 গ্রাম Ca(OH)2 এর সাথে 73 গ্রাম HCl মেশানো হয় তাহলেই বিক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হবে এবং কোনো উপাদানের অপচয় হবে না।