ইতিহাস – দশম শ্রেণি – সমাজসংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা (পর্ব – ৩)
গত পর্বে আমরা শিক্ষা সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা (পর্ব – ২) আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা উনিশ শতকের বাংলা – সমাজ সংস্কার নিয়ে আলোচনা করবো।
ব্রাহ্মসমাজসমূহের উদ্যোগ
ঊনবিংশ শতাব্দী একদিকে ভারতবর্ষকে যেমন দিয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন, তেমনি ভারতীয়দের চিন্তাভাবনার পরিবর্তনেও এই শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ এক্ষেত্রে রাজা রামমোহনের উদ্যোগে তৈরি হওয়া ব্রাহ্ম আন্দোলন তথা ব্রাহ্মসমাজের সতীদাহপ্রথা বিরোধী আন্দোলন ও বিধবা বিবাহ আন্দোলন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য৷
রাজা রামমোহন রায় প্রথম থেকেই ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে বা তার ভাবধারা প্রসারের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন আর তারই ফল হল ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা৷
রামমোহন রায়ের এই উদ্যোগের জন্য তাকে আধুনিক ভারতের জনক বা ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করা হয়৷
১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হয়৷
এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সমাজে চলতে থাকা জাতপাত, উচ্চ-নীচ শ্রেণীর ভেদাভেদ ইত্যাদিকে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত করে নতুন এক ধর্ম একেশ্বরবাদের প্রচলন, অর্থাৎ ঈশ্বর এক এবং তিনি সবার জন্যই সমান৷ সেখানে কোনও জাতপাতের ভেদাভেদ নেই৷
একইসঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠার ফলে স্ত্রীজাতির চূড়ান্ত অপমান, অবহেলা যা সমাজে প্রচলিত ছিল তার অবলুপ্তি ঘটে এবং স্ত্রীশিক্ষা এক অন্যমাত্রা পায়৷ ব্রাহ্মসমাজ কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রচলিত বহুবিবাহ ও গৌরিদান প্রথা ইত্যাদি বিভিন্ন কুপ্রথার তীব্র নিন্দা করে এবং রামমোহন রায় বিধবা বিবাহে সমর্থন জানান৷ এ বিষয়ে তিনি অনেকগুলো প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন৷
1833 সালে তাঁর মৃত্যুর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজ কোনোমতে টিকেছিল৷
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তত্ত্ববোধিনী সভা এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্ম দেন৷ তার মূল উদ্দেশ্য ছিল বেদান্তের মূল বক্তব্যকে তরুণ সমাজের কাছে তুলে ধরা৷
সতীদাহ প্রথা- বিরোধী আন্দোলন
রাজা রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড় অবদান অসহায় নারীদের রক্ষার্থে সতীদাহপ্রথা নিবারণ৷
সেই সময় বাংলায় গৌরিদান প্রথা প্রচলিত ছিল তারই অন্যতম নিদর্শন, স্বামী মারা গেলে তার স্ত্রীদের সহমরণে যেতে হত অর্থাৎ স্বামীর সাথে জ্বলন্ত চিতায় একটি জলজ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে ফেলা হত৷
এই জঘন্য প্রথার বিরোধিতা করে 1817 খ্রিস্টাব্দে প্রথম কলম ধরেন তথা আন্দোলনের সূত্রপাত করেন রাজা রামমোহন রায়৷
পরবর্তীকালে 1828 খ্রীষ্টাব্দে উইলিয়াম বেন্টিংক-এর সহযোগিতায় এই জঘন্য প্রথার অবসান হয়৷
রামমোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্ম আন্দোলনে নতুন জোয়ার নিয়ে আসেন কেশব চন্দ্র সেন৷
কেশব চন্দ্র সেনকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধি দিয়েছিলেন৷
পরে 1865 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, একদিকে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ও তার আদি ব্রাহ্মসমাজ তারা একেশ্বরবাদী হলেও ছিলেন হিন্দু ধর্মের অনুগামী৷ অন্যদিকে কেশব চন্দ্র সেন ও তার অনুগামীরা পরিচিত হন ‘ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজ’ নামে৷
সেখানে শুধু ধর্ম সংস্কার নয়, সমাজ সংস্কারও ছিল তাদের কর্মসূচির অন্তর্গত৷
1872 সালে সরকারি সাহায্যে কৃষ্ণচন্দ্রের উদ্যোগে পাস হয় ‘তিন আইন’ যেখানে বহুবিবাহ, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ হয় অর্থাৎ বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং অসবর্ণ বিবাহ অর্থাৎ ভিন্ন জাতের মধ্যে বিবাহ আইনিভাবে বৈধ হয়৷
এই পর্বটি বুঝে নাও এই ভিডিও থেকে↓
বিধবা বিবাহ আন্দোলন
ভারতীয় নারীদের জীবনের আরেকটি ঘৃণ্য অভিশাপ ছিল বৈধব্য জীবন৷ খুব অল্প বয়সেই বিধবাদের যে মারাত্মক অত্যাচার সহ্য করতে হত তার সীমা ছিল না৷ এই জঘন্য প্রথাকে বিলুপ্ত করার জন্য বিদ্যাসাগর ভারতীয় নারী প্রগতির কাঠামো রচনায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তিনি পরাশর সংহিতা, বেদ, উপনিষদ ইত্যাদি বিভিন্ন গ্রন্থের বিভিন্ন তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করলেন বিধবাদের বৈধব্য জীবন পালন করাই একমাত্র কর্তব্য নয় সে দরকারে পুনরায় বিবাহ করতে পারে৷ এরজন্য তাকে গোটা সমাজের কাছে অসম্ভব অত্যাচার, অপমান সহ্য করতে হয়েছিল, তাঁর স্বজনদের কাছ থেকে তিনি বারে বারে বিদ্ধ হয়েছিলেন৷
শেষ পর্যন্ত লর্ড ক্যানিং-এর সহযোগিতায় 1856 সালের 26 শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়৷
শুধু আইন পাশ করেই বিদ্যাসাগর থেমে থাকেননি তিনি 1876 খ্রিস্টাব্দে ভবসুন্দরী নামের এক বাল্যবিধবার সঙ্গে তার নিজের ছেলের বিবাহও দিয়েছিলেন৷
জানা যায় 1856 থেকে 1860 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পঁচিশটি বিধবা বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল৷
যদিও রক্ষণশীল সমাজ এই আইনকে সমর্থন করেনি, এবং ভারতীয়দের অশিক্ষা, দারিদ্র্য এবং পুরুষশাসিত মনোভাব বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে সেইসময়ে অনেকাংশে ব্যর্থ করে৷
ইয়ং বেঙ্গল বা ‘নব্যবঙ্গ’ গোষ্ঠী
ইংরেজি শিক্ষিত নব্য ভারতীয়ের দল ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে প্রাচীন ভারতীয় ভাবধারা ও রীতি-নীতি, কুসংস্কার সমস্ত কিছুকে প্রবলভাবে বিরোধিতা করতে শুরু করেছিল ৷
আর এদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং তার সমর্থিত দল যারা ইয়ং বেঙ্গল বা ‘নব্যবঙ্গ’ গোষ্ঠী নামে খ্যাত৷
হিন্দু কলেজের অধ্যাপক ডিরোজিও ছিলেন প্রবল যুক্তিবাদী এবং তিনি ছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য, ইতিহাস এবং দর্শনে পন্ডিত৷
তিনি খুব সহজেই হিন্দু কলেজে পড়তে আসা তরুণদের তাঁর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন৷
ডিরোজিও সবসময় তার ছাত্রদের সমস্ত কিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে ভাবনা চিন্তা করার কথা শিখিয়েছেন এবং হিন্দু সমাজে প্রচলিত পৌত্তলিকতা, জাতিভেদ, কুসংস্কার ,রক্ষণশীলতা এ সমস্ত কিছুর বিরোধিতা করতে শিখিয়েছিলেন৷
ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কার আন্দোলনে এই নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী বা ইয়ং বেঙ্গলীয়দের ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ এই ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যদের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামতনু লাহিড়ী, রসিক নাথ মল্লিক,দক্ষিণারজ্ঞন মুখার্জী,রাধানাথ শিকথার প্রমূখ৷
ডিরোজিওর ছাত্ররা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য তথা হিন্দু সমাজে চলা রক্ষণশীল আচার-আচরণগুলিকে সমালোচনা করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন৷
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
উল্লেখ্য ডিরোজিওর বিভিন্ন লেখা ‘পার্থেনন’, ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘হেরোস’, ‘ক্যালকাটা গেজেট’, ‘ক্যালকাটা ম্যাগাজিন ‘, ‘ইন্ডিয়ান ক্যালিডোস্কোপ’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷
ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল৷ বাল্যবিবাহ রদ, বিধবা বিবাহ প্রচার, বহুবিবাহ রদ করার জন্য সমান উদ্যোগে অংশগ্রহণ করেছিল৷
কিন্তু কিছু কিছু ইয়ং বেঙ্গলীয়রা হিন্দু রক্ষণশীল সমাজকে বিরোধিতা করার জন্য সর্বসমক্ষে মদ খাওয়া, গোমাংস খাওয়া, ব্রাক্ষ্মণের পৈতে ছেঁড়া বা গঙ্গাজলের পবিত্রতা অস্বীকার করা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল ফলত রক্ষণশীল সমাজে প্রবল অসন্তোষ শুরু হয়৷
দীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষে রক্ষণশীলতার নামে যে বিপুল অন্যায়-অবিচার,পৌরোহিত্যের শোষন চলে আসছিল ইয়ং বেঙ্গলীয়রা চেয়েছিল তার প্রতিকার করতে৷
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদেরকে জীবনও সমাজ-প্রক্রিয়ার প্রতি যুক্তিসিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করার শিক্ষা দিয়েছিলেন৷ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছাত্ররা যেন সম্পূর্ন মুক্ত চিন্তার অধিকারী হয় এবং অতি অবশ্যই যেন সুতীক্ষ্ম যুক্তিবোধ ও চিন্তার মুক্ততা দিয়ে সব কিছুকে বিচার-বিশ্লেষণ করে তবে কোনো মতামতকে গ্রহণ করে৷
ফলশ্রুতি রয়েছে এই সকল কারণে ডিরোজিওকে বাংলা রক্ষণশীল সমাজ একঘরে করে দেয় এমন কি অবস্থা এতটাই সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিল এই বিশৃংখল পরিস্থিতিতে অসুস্থ ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজের অধ্যাপকের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়৷
ইয়ং বেঙ্গলীয়দের এই আন্দোলন উনবিংশ শতাব্দীর বিতর্কিত অধ্যায়৷ একদিকে তারা তাদের মুক্ত চিন্তা ও প্রতিবাদী পদক্ষেপের জন্য যেমন মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তেমনি আবার তাদের প্রতিবাদের চরিত্রের ধরনের জন্য তাদের তৎকালীন সমাজের বিরূপতারও শিকার হতে হয়৷
কিন্তু একথা পরিশেষে বলতে হয়,ডিরোজিও তাঁর শিষ্যদের সঠিকভাবে শিক্ষিত করে তুলতে পারেননি৷ ইয়ং বেঙ্গলীয়রা প্রাচ্যের পুরনো ধ্যান-ধারনাকে যুক্তির জালে ছিঁড়তে পেরেছিল ঠিকই কিন্তু তারাই পাশ্চাত্য সভ্যতার সম্পূর্ন অন্ধ অনুকরণ করেছিল ফলত,তাদের পদক্ষেপ যথেষ্ট যুগান্তকারী হওয়া সত্তেও বিফলে যায়৷
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ধর্ম সংস্কার
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-His-2-c