vat-bishode-alocona
Class-12

ভাত গল্পের বিশদে আলোচনা

বাংলাদ্বাদশ শ্রেণি – ভাত (বিশদে আলোচনা)

এর আগে ভাত গল্পের সারসংক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা ভাত গল্পের বিশদে আলোচনা করব।

ভাত গল্পের বিশদে আলোচনা

বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক মহাশ্বেতা দেবীর বেশিরভাগ রচনাতেই ফুটে উঠেছে নিম্নবিত্ত এবং নিম্নবর্গের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, তাদের আজীবন দারিদ্র্য-যন্ত্রণার কথা। তিনি সবসময়েই একটি শ্রেণিহীন, শোষণহীন এবং সমানাধিকার প্রাপ্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতেন।

ভাত গল্পের আলোচনা শুনে নাও এই লিঙ্ক থেকে↓

১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় মহাশ্বেতা দেবী ত্রাণের কাজে সরাসরি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ফলে তখনই তিনি বাংলার নিরন্ন মানুষের যন্ত্রণা একেবারে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন। দু-মুঠো ভাতের জন্য মানুষের হাহাকার আর তার চরম করুণ পরিণতির ছায়া তাঁর বহু গল্পেই দেখা যায়। সমাজের শোষিত, বঞ্চিত সম্প্রদায়ের মধ্যে খাদ্য সমস্যা আজও এক অমীমাংসিত সমস্যা। স্বাধীনতার পরেও খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের সমস্যা পূরণ হয়নি সমাজের এই স্তরের মানুষদের আর এই মৌলিক চাহিদাগুলি না পাওয়ার প্রতিকারে রাষ্ট্রের কাছে সুরাহাও মেলে না। সামান্য ভাত খাওয়ার তীব্র আশায় এই মানুষগুলির ঠিক কী পরিণতি হতে পারে, আমাদের আলোচ্য ‘ভাত’ গল্পটি তার এক জ্বলন্ত চিত্র তুলে ধরে।

মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পের প্রধান চরিত্র উৎসব নাইয়া, লোকে তাকে উচ্ছব বলেই ডাকে।

মাতলা নদীর বিধ্বংসী জলের তোড়ে সে তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হারিয়ে ফেলে। নিঃসঙ্গ সহায়-সম্বলহীন উচ্ছব তারপরে খাবারের সন্ধানে গ্রামের আত্মীয় বাসিনীর মনিবের বাড়িতে এসে ওঠে। এখানে নাকি ভাতের ছড়াছড়ি। ফলে খাবারের অভাব হবেনা। বাদা থেকে এই বাড়িতে চাল আসে। বাসিনীর পরিচয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে কাঠ কাটার কাজ পায় উচ্ছব। সেই বাড়ির কর্ত্রী বড়ো পিসিমাকে ব্রাহ্মণ রাঁধুনি বলেছিল যে উচ্ছব কেবল ভাতের বিনিময়ে এখানে পরিশ্রম করবে।


দ্বাদশ শ্রেণি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

এই বড় পিসিমা আজীবন অবিবাহিত থেকে গিয়েছেন। লোকের মুখে শোনা যায়, তাঁর বিয়ের বয়সে এ বাড়ির বুড়ো কর্তার স্ত্রী মারা যান এবং তখন এত বড় সংসার সামলানোর জন্যেই নাকি তাঁর আর বিয়ে হয়নি। বর্তমানে তিনিই এই সংসারের নিয়ন্তা। আবার অনেকে নাকি বড়ো পিসিমাকে বলতে শুনেছে যে শিবই তাঁর পতি দেবতা আর তাই অন্য কাউকে তিনি বিবাহ করেননি। বাসিনীর সঙ্গে উচ্ছবকে দেখে প্রথমে বড়ো পিসিমা কাজে নিতে চাননি, কারণ মন থেকে দশ পয়সাও তাঁরা কাউকে সাহায্য করতে পারেন না, চোদ্দো দফা খাটিয়ে তবে বাদার চালের ভাত দিতে পারবেন।


সেই বাড়িতে তখন মুমূর্ষু বুড়ো কর্তাকে বাঁচানোর জন্য হোম-যজ্ঞের তোড়জোড় চলছে। বড়ো পিসিমার বাবাই এই বুড়ো কর্তা, তাঁর যকৃতে ক্যান্সার ধরা পড়েছে বলে তাঁর আর বাঁচার আশা নেই। ডাক্তার বহুদিন আগেই জবাব দিয়ে দিয়েছে আর সেই জন্যেই বুড়ো কর্তাকে বাঁচানোর জন্য বড়োবাড়িতে সেদিন তান্ত্রিকের আগমন ঘটেছে হোমযজ্ঞের জন্য।

ইতিমধ্যে বুড়ো কর্তার মৃত্যু আসন্ন দেখে বড়ো পিসিমাকে এ বাড়ির বড়ো বউমা কিছুদিন ধরে বড়ো ইলিশ, পাকাপোনার পেটি, চিতলের পেটি, ডিমপোরা ট্যাংরা, বড়ো ভেটকি ইত্যাদি রান্না করে খাওয়াচ্ছে। বুড়ো কর্তার সেবা-যত্নেও তাঁর অবদান কম ছিল না।

এই যজ্ঞের জন্য তেঁতুল, অশ্বত্থ, বেল, ক্যাওড়া, বট ইত্যাদি গাছের কাঠ এসেছে কুড়ি সের করে আর সেগুলো এক মাপে কেটে রাখাই উচ্ছবের কাজ।

সেদিনের নিয়ম ছিল তান্ত্রিকের যজ্ঞ শুরুর আগেই বাড়ির খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে হবে। বাসিনী বড়ো পিসিমাকে জানিয়েছে যে কয়দিন ধরে উচ্ছব কিছুই খায়নি আর তাই সে আজ খাটা-খাটনির পর পেট ভরে ভাত খাবে বড়োবাড়িতে।

এখানে একেকজন একেক চালের ভাত খায়, বড়োবাবু খান কনকপানি চালের ভাত, বাড়ির মেজো ও ছোট ছেলে খায় পদ্মজালি চালের ভাত আর বাড়ির রাঁধুনি ও অন্যান্য চাকর-বাকরদের জন্য রাঁধা হয় মোটা সাপ্‌টা চালের ভাত।

তবে সেদিন নিরামিষ ডাল-তরকারি আর মাছের সঙ্গে রামশাল ও ঝিঙেশাল চালের ভাত রান্না করা হয়েছিল। বাসিনীর কাছে উচ্ছব যখন জানতে পারে যে বাদায় এদের চাল হয় প্রচুর, তখন বাসিনীর কাছে একমুঠো চাল খেতে চায় উচ্ছব। বহুদিন সে রান্না করা ভাত খায়নি, তাই ভাতের কথা শুনেই তাঁর মনটা আঁকুপাকু করে ওঠে। কিন্তু বাসিনী জানায় যজ্ঞ শেষ হওয়ার আগে কারো ভাত খাওয়ার নিয়ম নেই আর পিসিমা জানলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বড়োবাড়ির লোকেদের এরূপ অমানবিক আচরণের প্রতি রুষ্ট হয় উচ্ছব। বাসিনী তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে কাজের ফাঁকে ঠিক এসে ভাত দিয়ে যাবে, আপাতত সে উচ্ছবকে ছাতু খেতে দেয়।

এরপরেই উচ্ছবের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই দুর্যোগের দিনের ছবি।

মাতলা নদীর জলে ভেসে গিয়েছিল তাঁর ঘরবাড়ি, সেই বন্যাতে তাঁর পরিবারও গিয়েছিল ভেসে। চন্নুনী, চন্নুনীর মা অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে উচ্ছব, তাঁর ভিটেমাটিও হারিয়ে যায় জলের তোড়ে। কিছুদিন বন্যার্তদের জন্য বরাদ্দ রিলিফের খিচুড়ি খেয়ে দিন কাটে উচ্ছবের, পরে সেই রিলিফ দেওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। সেই সব দিনে চাল চিবিয়ে খেয়েও ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করেছে সে।

কিছুদিন পরে তাঁর গ্রামের আত্মীয় বাসিনীর সঙ্গেই কলকাতায় কাজের সন্ধানে চলে আসে উচ্ছব। তার আগে গ্রামে সতীশ মিস্ত্রির জমিতে কাজ করতো সে, সেই খেতের হরকুল, পাটনাই, মোটা ধানে মড়ক লাগতে দেখে কান্নায় আকুল হয়ে উঠেছিল উচ্ছব। খেতের ধান নষ্ট হতে দেখে উচ্ছব গ্রামের সাধন দাসকে জানিয়েছিল যে লক্ষ্মী আসার আগেই তার ভাসান হয়ে যাচ্ছে, গ্রামের লোকেরা এবারে খুবই সমস্যায় পড়বে। উচ্ছব ভাবতে থাকে আজ যদি তাঁর ছেলে-মেয়েগুলি অন্তত বেঁচে থাকতো, তাহলেও তাঁর মনের জোর থাকত।

সকলে মিলে একযোগে ভিক্ষে করে অন্তত দুমুঠো চাল ফুটিয়ে খেতে পারতো। এইসব ভাবতে ভাবতে কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ে উচ্ছব। পিসিমা তাই তাঁকে মুখঝামটা দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ সারতে বলেন। উচ্ছব পিসিমাকে জানায় যে তাঁর খুব খিদে পেয়েছে, কিন্তু সেই কথা শুনে পিসিমা স্পষ্টই জানিয়ে দেন যে ভাত রান্না হয়ে গেলেও এখন কারো ভাত খাওয়া যাবে না, একেবারে যজ্ঞ শেষ হলে তখন সকলেই খেতে পারবে।

উচ্ছব বাসিনীকে বলে যে এটা পিশাচের বাড়ি, অভুক্ত গরীব মানুষকে দিয়েও এরা খাটিয়ে নেয় দুটো ভাত দেওয়ার লোভ দেখিয়ে। আর এদিকে মুমূর্ষু বুড়ো কর্তার আরোগ্যের জন্য আয়োজিত বিরাট যজ্ঞ তাঁর কাছে অপচয়, বাড়াবাড়ি ব্যাপার বলেই মনে হয়। সামান্য ছাতু খেয়ে উচ্ছবের খিদে মেটেনি। যজ্ঞ শেষ হলেই সে ভাত খেতে পাবে এই আশায় তাঁর প্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

শুধু ভাত খাওয়ার জন্য উচ্ছব একেবারে উন্মাদের মত হয়ে যায়।

যজ্ঞ শুরু হলে উচ্ছব কাছের শিবমন্দিরে গিয়ে মন্দিরের বারান্দায় শুয়ে পড়ে। যখন তাঁর ঘুম ভাঙে উচ্ছব বড়োবাড়িতে গিয়ে জানতে পারে যজ্ঞের পরেও বিরাশি বছর বয়সে বুড়ো কর্তা মারা যান। পিসিমা তান্ত্রিকের কথায় প্রভাবিত হয়ে যজ্ঞের সময় তিন ছেলের উঠে চলে যাওয়াকে দোষারোপ করতে থাকেন।

বুড়ো কর্তার মৃত্যুতে সমগ্র বাড়িটাই শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে, পিসিমার নির্দেশে বাসিনী সব রান্না করা খাবার ফেলে দিতে যায়।

উচ্ছব তা টের পেয়ে মোটা চালের ভাতের একটা বড় ডেকচি নিজে যেচে বাসিনীর কাছ থেকে নিয়ে উচ্ছব জানায় যে সে নিজে গিয়ে এই ভাত অনেক দূরে ফেলে আসবে। বাড়ি থেকে বেরিয়েই সে দৌড় লাগায় উর্ধ্বশ্বাসে। খিদের তাড়নায় উচ্ছব আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর অবস্থার বর্ণনা দেন এভাবে –

‘…তার চোখ দুটি বাদার কামটের মতোই হিংস্র। দাঁতগুলো বের করে বাসিনীর দিকে চেয়ে এমন মুখভঙ্গি করে যে, বাসিনী সেই ভয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে।’

স্টেশনের দিকে দৌড়ে গিয়ে সেখানে বসেই উচ্ছব খাবলা খাবলা করে পুরো এক হাঁড়ি ভাত খেয়ে ফেলে। ভাতের ছোঁয়ায় সে যেন স্বর্গসুখ অনুভব করে। ভাতের গন্ধে তাঁর আর আনন্দের সীমা নেই। ডেকচিতে মুখ ডুবিয়ে সে ভাত খেতে থাকে। স্ত্রী, সন্তানদের কথা চিন্তা করে সে আরো খেতে থাকে। খাওয়া শেষ হলে উচ্ছব ভাবে এরপর ভোরের ট্রেন করে সে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে। ইতিমধ্যে খাওয়ার পর ডেকচির কানা জড়িয়ে মাথা ঠেকিয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে উচ্ছব।

কিন্তু পরেরদিন সকালে পিতলের ডেকচি চুরির অপরাধে স্টেশন থেকে উচ্ছবকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

বাদার খোঁজ আর শেষ হয় না উচ্ছবের।

সামান্য দু-মুঠো ভাতের জন্য উচ্ছবের জীবনের এমন করুণ পরিণতিই এই গল্পের মুখ্য উপজীব্য। মহাশ্বেতা দেবীর ‘বান’, ‘সাঁঝ সকালের মা’ ইত্যাদি গল্পেও একইভাবে এই নিরন্ন মানুষের দিগন্তবিস্তারি ক্ষুধার কথা পরম মমতায় লেখিকার কলমে উঠে এসেছে। একইসঙ্গে সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রতি প্রতিপত্তিশালী মানুষদের আচরণের এক স্পষ্ট বাস্তব ছবিও এই গল্পে আমরা দেখতে পাই। এই গল্পের উচ্ছব যেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মত মনে মনে বলতে থাকে –

‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে
কারা যেন আজও ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায়।
আর, আমরা সারারাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে
প্রার্থনায়, সারারাত।’

সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XII_Beng_Vat_2