মুখবন্ধ
দশকের পর দশক ধরে ছাত্রছাত্রীদের পীড়ন করে চলেছে যে বিষয়টি তার নাম – ইতিহাস। সবার কাছে না হলেও অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের কাছে ইতিহাস মানে মুখ ব্যাজার করে সাল তারিখ মুখস্থ করার একটি বিষয়। ইতিহাস অতিতের দলিল হলেও, এটি কিন্তু মোটেও নিরস বিষয় নয়। সময়ের সরণি বেয়ে মানব সভ্যতার উত্থান-পতনের কাহিনী হল ইতিহাস। ‘পটচিত্রের রহস্য’ একটি পুর্নাঙ্গ গল্প। গল্পটি কাল্পনিক হলেও এর বিষয়বস্তু ভারতবর্ষের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র। এই কল্প – ঐতিহাসিক গল্পটি তিন সংখ্যার ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশিত হবে।
প্রথম পর্ব
ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন সাধুবাবা। মনে মনে ভাবেন, ‘সময় তো হয়ে গেছে; তবে এখনো দেখা নেই কেন? আমারও যে সময় আগত।’ কতকাল আর আত্মাটাকে শরীরের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারবেন – তাই নিয়ে নিজের মনেই সংশয়।
কিন্তু কার প্রতীক্ষায়? গত কয়েকদিন ধরেই সমস্ত ঘটনাতেই যেন তাঁর অভাব অনুভব করছেন সাধুবাবা। এই তো আজ দুপুরের ঘটনা; একটা বক প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত হয়ে দয়া নদীর ধারে নেমে গেল। দয়ার জলে পিপাসা মেটালো। মনে মনে ভাবলেন, এমন এক দিন ছিল যেদিন শুধু মানুষের জন্যই নয়, পশুপাখির জন্যেও রাস্তার মোড়ে মোড়ে জল রাখা থাকত। রাস্তার ধারে ধারে কত কূপ খনন করেছিলেন, কত গাছ রোপণ করেছিলেন। সেইসব গাছগাছালিতে পাখ-পখালির কূজনে আকাশ – বাতাস আলোড়িত হোত।
এসব ঘটনা কবেকার?
সাধুবাবা নিজের মনেই হেসে ফেললেন, আজ থেকে প্রায় দু’ – আড়াই হাজার বছর আগের কথা। ষোড়শ মহাজনপদ হল। তারপর হল মগধের উত্থান। মগধ রাজ্য সর্বপ্রথম এক অখণ্ড সাম্রাজ্য গঠন হল, হর্ষঙ্ক রাজ বিম্বিসারের হাত ধরে। এরপর অজাতশত্রু, তারপর নন্দবংশ, তারও পর মৌর্যবংশ। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিন্দুসার, এরপর মহান সম্রাট অশোক।
পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যুদ্ধের সাফল্য সম্রাটকে রাজ্যজয়ের নেশা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অশোক? কলিঙ্গ যুদ্ধের সাফল্য তাঁকে যুদ্ধের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলল। রাজ্যজয় অবশ্য করেননি তা বলা যাবে না। তাঁর অহিংস নীতি দিয়ে, তাঁর ‘ধম্ম’ দিয়ে ভারত ও ভারতের বাইরে বহু দেশের হৃদয় জয় করে নিলেন। নিজের ছেলে মহেন্দ্র এবং মেয়ে সংঘমিত্রাকে সিংহলের রাজা তিস্য – এর আমন্ত্রণে ধর্মপ্রচারের জন্য পাঠালেন।
আজ কত কথাই মনে পড়ছে সাধুবাবার।
কলিঙ্গ যুদ্ধ না হলে কি আর এসব হোত? মনের এত বড় পরিবর্তন – সেতো যুদ্ধের বীভৎসতা দেখে, ভাবলে অবাক লাগে, এই রাজাই নিজের ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে বসার আগেই পিতা বিন্দুসারের রাজত্বকালে তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমন করেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধে এক লক্ষ সৈন্য প্রাণ হারায়। আহত সৈন্যদের আর্তনাদ, অসহায়তা হাজার হাজার মৃত সৈন্যের ছিন্নভিন্ন দেহ, অশোককে এক অন্য মানুষে পরিণত করল। সেসব ২৬১ খৃষ্ট পূর্বাব্দের ঘটনা।
দয়া নদীর সাদা জল অসংখ্য আহত-নিহতের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল। এসব দৃশ্য সম্রাট অশোককে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল। তিনি যে মৌর্য সাম্রাজ্যের পরিধির ব্যাপক বিস্তার করেছিলেন, সেসব তাঁর কাছে মূল্যহীন হয়ে গেল। প্রবল ঝড়ের তাণ্ডবে চারদিক যেমন খন্ড-বিখন্ড হয়ে যায়, অশোকের মনও তেমন চূর্ণ – বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের নৃশংসতায়।
এই সাধুবাবাই সেদিন অশোকের হাত থেকে তরোয়ালটা নামিয়ে দিয়ে অহিংসার বীজটা বপন করে দিয়ে এসেছিলেন। ইতিহাসে এর কোনো সাক্ষ্য নেই। কিন্তু সাধুবাবা নিজে অন্তত; তাই মনে করেন। নিজের দু’একজন যা শিষ্য আছে তাদেরও তাই বলেন।
এক শিষ্য কৌতূহলী হয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিল – ‘সম্রাট অশোক? সে তো আড়াই হাজার বছর আগেকার ঘটনা। সেটা কি আপনার পূর্বজন্মের ঘটনা? তা যদি না হয় তবে আড়াই হাজার বছর ধরে কোন শক্তিবলে আপনি বেঁচে রয়েছেন?’
সাধুবাবা শুধু হাসেন। মনে মনে ভাবেন যোগবলে যা সম্ভব আধুনিক বিজ্ঞান তার কাছে হার মানবে। কিন্তু এবার সময় ঘনিয়ে এসেছে …
প্রথম পর্ব সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা