বন ছেড়ে বেরিয়ে আমাদের মানুষ হতে প্রায় তিন লক্ষ বছর লেগেছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে মানুষকে সভ্য করেছিল যে ঘটনা, সেটি হয়ত আজ বিস্ময় জাগায় না, কিন্তু ভেবে দেখবার বিষয় যে, এই ঘটনা না হলে, মানুষ কখনো মুখ তুলে আকাশ দেখার অবকাশই পেত না।
সেটি হল উদ্বৃত্ত – খাদ্য, শ্রম ও সময়ের উদ্বৃত্ত। মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত হলো নদীতীরে এসে। মানুষ কৃষিকাজ শিখল, মানুষ পণ্য পরিবহন শিখল, আর শিখল সময় মাপতে। ওই আকাশের তারা দেখে, সূর্যের চলাফেরা, জোয়ার ভাঁটা, চন্দ্রকলার হ্রাস বৃদ্ধি দেখে। মানুষ ভাবতে লাগল সবকিছু চক্রাকারে ফিরে ফিরে আসে, গ্রীষ্মের পর আসে শীত, রাতের পর দিন, তাহলে এই ছন্দ মাপলেই আমরা সময় মাপতে পারব।
শুরু হল বিজ্ঞানের জয়যাত্রা।
মানুষ তার এই বাড়তি সময়ে দুটি জিনিষ শিখল, লিপি আর প্রশ্ন। শুরু হল পঠনপাঠন ও শিক্ষার প্রচলন। এই প্রশ্ন তুলতে তুলতেই একদিন সে জিজ্ঞেস করলো “এই পৃথিবীটা কি দিয়ে তৈরি?” “আমরা কোথা থেকে এলাম?” “মৃত্যুর পর কি আছে?” “ভবিষ্যৎ কিভাবে দেখবো?” “কে আমাদের সৃষ্টিকর্তা?” খুলে গেল জ্ঞানের নতুন দরজা। জন্ম নিল রসায়ন, দর্শন, থিওসফি, জ্যোতিষ। শুধুমাত্র ব্যবহারিক প্রয়োগমূলক জ্ঞান নয়, কৌতূহলের তৃষ্ণা মেটাতে শুরু হল অনুসন্ধান।
মহর্ষি কণাদের কাছে, এই সৃষ্টি রহস্যের যে প্রশ্নটি সবথেকে বড় হয়ে দাঁড়াল, সেটি হল আমাদের জগত কি দিয়ে তৈরি? এর উপাদান কি? খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে তৈত্তিরীয় উপনিষদে (Taittirīya Upanishad) বলা হল পাঁচটি মুল উপাদানের কথা।
ঠিক সমসাময়িক কালে প্রাচীন গ্রীসেও আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল ওই মৌলগুলো।
ওরাও ওদের মত করে ৫ টি মৌলকে বিশ্বের মুল উপাদান হিসেবে ধারণা করে নিল। চিন দেশে কখন থেকে এই পঞ্চতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল, ঠিক জানা যায় না। তবে সেখানেও এই রকমই পাঁচটি মূল পদার্থের কথার উল্লেখ মেলে উ-যিং বা পাঁচ agent হিসেবে। কি কি ছিল এই সকল মৌলগুলি? কেমন ছিল তখনকার বিজ্ঞান? কিভাবে দেখতেন তাঁরা এই জগতকে? চলুন, ফিরে যাওয়া যাক ২৫০০ বছর আগে।
গ্রীকেদের এই পাঁচটি তত্ত্বের ধারণা সক্রেতিসের (Socrates) আগে থেকেই চলে এসেছে, এমনকি, নবজাগরণের পূর্বেও তাদের এই ধারণাই তাদের বিজ্ঞানের ভার বহন করেছে।
কি কি ছিল এই পাঁচ তত্ত্ব?
আগুন, মাটি বা ধরিত্রী, জল, বায়ু ও এথার বা ইথার। এম্পেডক্লেস ও অ্যারিষ্টটল কাঠ পুড়িয়ে দেখান যে কিভাবে কাঠের থেকে চারটি মৌল পাওয়া যায়। কাঠ পোড়ালে আগুন ওঠে, আর ওঠে ধোঁয়া (বায়ু)। পড়ে থাকে ছাই, আর কিছু জলের কণা বেরোতে দেখা যায়। এখান থেকে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, প্রত্যেক বস্তু এই ৪টি মূল উপাদানে তৈরি।
পরে হেরাক্লিটাস, থালেস, আনাক্সিমেনেসের মত দার্শনিকও তাদের মতকে সমর্থন করেন। আনাক্সিমেনেস আরও দাবি করেন যে এরা পরস্পর পরিবর্তনশীল। এদের মুল উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন প্লেটো আর অ্যারিস্টটল তার বই “On Generation and Corruption” এ এদের চরিত্রায়ন করেন। তিনি বলেন,
- আগুন শুষ্ক ও উষ্ণ
- বায়ু আর্দ্র ও উষ্ণ
- জল আর্দ্র ও শীতল
- মাটি শুষ্ক ও শীতল
তিনি ওই বইতে আরও একটি মৌলের উল্লেখ করেন, এথার বা ইথার। তার যুক্তি ছিল যে পৃথিবীর বুকে এই চারটি মৌল অবিশুদ্ধ ও সহজেই পরিবর্তনশীল (জল আগুন নিভিয়ে দেয়, আগুন মাটি গলিয়ে দেয়, মাটি জল শুষে নেয় আর বায়ু এদেরকে উড়িয়ে দেয়)। স্বর্গীয় নক্ষত্রমণ্ডলী নিশ্চয়ই এইসব মৌলে তৈরি হতে পারে না। তাহলে নিশ্চয়ই একটি পঞ্চম মৌল আছে “ইথার”, যা দিয়ে ওই স্বর্গ তৈরি।
[আরো পড়ুন – একটি ঐতিহাসিক কল্পপ্রবন্ধ; স্বপ্ন না সত্যি]
নবজাগরণের সূচনায় এই মৌলগুলির বিবৃত ধর্ম নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। প্রক্লাস, অ্যারিস্টটলের উষ্ণ-শীতল, শুষ্ক-আর্দ্র ধর্মাবলীকে বাতিল করে নতুনভাবে তাদের ধর্মের পর্যালোচনা করেন।
- আগুন – তীক্ষ্ণ সূক্ষ্ম গতিশীল
- বায়ু – ভোঁতা সূক্ষ্ম গতিশীল
- জল – ভোঁতা স্থূল গতিশীল
- মাটি – ভোঁতা স্থূল স্থিতিশীল
চিনদেশে অতি প্রাচীন কাল থেকেই প্রকৃতির সাথে সমন্বয়ের দর্শন তাদের সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে আছে। লাও জির দর্শনে এই “Harmony and Peace” এর প্রচারই হয়েছে। এই দর্শনের অন্যতম অংশ এই উ-যিং (Wu Xing) বা পাঁচ মৌল বা পাঁচ দশা। আজও চিনের প্রাত্যাহিক জীবনে এই পঞ্চভূতের উপাসনা করা হয়।
কি কি এই পাঁচ মৌল?
Wood বা কাঠ, Fire বা আগুন, Earth বা ধরিত্রী, Metal বা ধাতু ও Water বা জল। বছরের ৩৬০ দিনকে পাঁচটি স্পষ্ট ভাগে (প্রত্যেক ভাগ ৭২ দিনের) ভাগ করা হয়েছে এবং এই পাঁচ মৌলকে এদের প্রতিনিধি ধরা হয়েছে, বৈশিষ্টের সাথে সামঞ্জস্য দেখে।
বছরের শুরুতে বসন্ত, নবজাগরণের সময়, নবজন্মর সময়। তাই উড বা কাঠ বা বৃক্ষ। তারপর গ্রীষ্ম বা আগুণের সময়। তারপর অন্তর্বর্তী সময় যার প্রতিনিধি মাটি, যখন শুষ্কতা চরমে পৌঁছায়। তারপর কৃষিকাজের সময় বা হেমন্তের সময় যখন মাঠে কাস্তে চলে, তখন ধাতু রাজত্ব করে। তারপর আসে শীত, ঠাণ্ডা জলের মত। এই পাঁচটি দশা নিয়ে সারা বছরের সময়কাল মাপা হয়।
[আরো পড়ুন – পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী হাতিয়ার]
এদের মধ্যে আন্তর্সম্পর্ক কি?
ঠিক যেমনটা rock paper scissor (lizard Spock) খেলাটিতে একের অপরের সাথে সম্পর্ক। এদের নিজেদের মধ্যে দুটি চক্র কাজ করে। একটিকে বলে মা-পুত্র সম্পর্ক, যেখানে একে অপরকে সৃষ্টি, বিকাশ ও প্রতিপালন করে, অপরটি পিতামহ-পৌত্র সম্পর্ক, যেখানে একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ, সীমাবদ্ধ বা ধ্বংস করে।
মা-পুত্র সম্পর্ক – কাঠ আগুন জ্বালায়, আগুন ছাই (মাটি) তৈরি করে, মাটি ধাতু আকরিকের জন্ম দেয়, ধাতু পাত্র জল ধরে রাখে, জল কাঠ বা উদ্ভিদকে জন্মাতে সাহায্য করে।
পিতামহ-পৌত্র সম্পর্ক – বৃক্ষ মাটি ফুঁড়ে ওঠে, মাটি জল শুষে নেয়, জল আগুন নেভায়, আগুন ধাতু গলায় আর ধাতুর অস্ত্র কাঠ কাটে।
প্রথম পর্বের সমাপ্তি
দ্বিতীয় পর্বে – প্রাচীন ভারতীয়দের চোখে পঞ্চভুত ও আধুনিক বিজ্ঞানে পঞ্চমৌল
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা