বাহাদুর শাহ জাফর দরগায় খনন কাজ চলছে। বহু যুগ আড়ালে থাকার পর সেখানে আবিষ্কৃত হয়েছে মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এবং অন্যতমা পত্নী জিনাত মহলের সমাধি।
ইকবালের এ ব্যাপারে উৎসাহের শেষ নেই।
সবাই কাজ শেষ করে সাইট ছেড়ে চলে গেছে। যাচ্ছি – যাব করে কাছের বটগাছের তলায় একটু জিরিয়ে নিতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে কেউ খেয়াল করেনি।
ঘুম ভাঙল এক মহিলার চিৎকারে – ‘বাদশাহ ঔরঙ্গজীব, সাহস থাকে তো সামনে এসে মোকাবিলা করুন? আপনার দাক্ষিণাত্য নীতির ফল কি সাংঘাতিক তা তো আপনি মানলেন না। ব্যাপারটা অমীমাংসিত রেখেই ‘ভোর হতে চলেছে’ অজুহাতে কাল কবরে ঢুকলেন। দারাসিকো আপনার থেকে অনেক যোগ্য ছিলেন। যেমন উদারচেতা, তেমনি সুশাসক। তাকে দেওরাইয়ে যুদ্ধে (১৬৫৯) পরাজিত করলেন, আবার নিজের ভাইকে হত্যাও করলেন?’
এই কথায় তেলে বেগুনে জ্বলতে – জ্বলতে একটু দূর থেকে দেখা গেল আসছেন ঔরঙ্গজীব।
ইকবাল ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারছে না। একবার নিজের হাতে চিমটি কাটছে, একবার নিজের চোখ রগড়াচ্ছে। সে যে কোথায় রয়েছে, এসব কি হচ্ছে, এসব ভাবার আগেই, শুনতে পেল, ঔরঙ্গজীব চেঁচাচ্ছেন – ‘হ্যাঁ, উদারচেতা? আমার মত নিষ্ঠাবান দেখেছেন? রোজ কোরান পাঠ করি। ধর্মের দিক দিয়ে আমি আন্তরিকভাবে নিষ্ঠাবান।’
[আরো পড়ুন – মনোযোগ কিভাবে বাড়ানো সম্ভব]
মহিলা উত্তর দিলেন – ‘কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন কার্যকরী করতে গিয়ে অনেক প্রজার আনুগত্য হারান নি কি?
মহামতি আকবরের কথা মনে করুন একবার! বহুদিনের প্রচলিত ‘জিজিয়া’ কর থেকে হিন্দু বা অমুসলিমদের রেহাই দিলেন। অমুসলিমদের, কারাবন্দীদের ইসলাম ধর্মগ্রহণে বাধ্য করবার প্রথা বন্ধ করলেন। শাসকের প্রধান কর্তব্য সাম্রাজ্যের ভিত শক্তপক্ত করা। তাই প্রভাবশালী হিন্দুদের মনসবদার করলেন; তোডরমল; মানসিংহের কথা মনে পড়ছে আপনার?’
জিনাত মহল দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ-র পনেরো জন স্ত্রীর অন্যতম ছিলেন। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ-র অযোগ্যতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে একদিন নিজেই রাজ্যের হাল ধরতে নেমে পড়েছিলেন। ইকবাল মনে মনে ভাবছে এই-ই কি সেই ‘জিনাত মহল’?
[আরো পড়ুন – টানটান ঐতিহাসিক কল্প-গল্প ‘পটচিত্রের রহস্য’]
নিজের মাথায় দুবার টোকা মেরে নিল সে। একদিকে ভয়, অন্যদিকে উৎসাহে তার মনের অভিব্যক্তি যে কি সাংঘাতিক হল তা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ। সে আস্তে আস্তে বট গাছের মগডালে উঠে গেল।
ঔরঙ্গজেব, জিনাতের আক্রমণে ততক্ষণে একটু ব্যাকফুটে।
সে তখন সাফাই গাইতে আরম্ভ করল – ‘আমি কি করব? সিংহাসনে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তো – অহোমরা পরাক্রমশালী হয়ে উঠল। আরাকানে ‘মগ’, উত্তরবঙ্গে ‘কোচ’ রা আমায় ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। মীরজুমলার কথা মনে পড়ছে কি? সে তো সাফল্য পেয়েছিল। অস্বীকার তো তুমি এটা করতে পারবে না।’
‘আরে থামুন, সে তো সাময়িক সাফল্য’- জিনাতের কড়া আক্রমণ।
ঔরঙ্গজেব ক্ষেপে গিয়ে বললেন – ‘অ—,তাই? বংশের ইতিহাস বিকৃত করছ? আমার মাতুলের নাম শোনো নি? শায়েস্তা খাঁ? তিনি যখন বাংলার সুবাদার, তখন তিনি চট্টগ্রাম দখল করলেন মগেদের পরাজিত করে। তিনি তো পর্তুগীজ জলদস্যুদের হাটিয়ে সন্দ্বীপ দখল করলেন।’
ঔরঙ্গজীব-এর কথা থামার আগেই জিনাত মহল শুরু করলেন- ভুলে গেলেন, আপনার শাসনকালে আফগান উপদলগুলো কেমন নাস্তানাবুদ করেছিল? মহম্মদ শাহ নামে একজনকে তাদের ‘রাজা’ করে সিন্ধু নদ পেরিয়ে হাজারা জেলা দখল করে নিল।’
ঔরঙ্গজীব ক্ষিপ্ত হয় পায়চারী করতে করতে চেঁচাচ্ছেন- ‘যশোবন্ত সিংহকে পাঠাইনি? তবেই তো আফগানরা উত্তর পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ বন্ধ করল’।
জিনাত বললেন – ‘সে কি জাঁহাপনা, ১৬৭২ সালের কথা ভুলে গেলেন?
আফ্রিদিরা আক্রমণ শুরু করলে যশোবন্ত সিংহ-র কেমন ল্যাজেগোবরে অবস্থা হল, মনে পড়েছে? অনেক মুঘল সৈন্য তাদের হাতে ধরা পড়েছিল। এরপর পেশোয়ার, বান্নু, কোহাট জেলার খটক উপজাতি বিদ্রোহ করল’- জিনাতের কথা শেষ হতে না হতেই ঔরঙ্গজীব শুরু করলেন- ‘১৬৭৪ সালের কথা ভুলে গেলে? নিজে গেছি উপজাতি দমনে। কাবুলে আমীর খাঁ কে নিযুক্ত করে সম্পুর্ন শান্তি ফিরিয়েছি ।’
এবার জিনাতের বক্রোক্তি — ‘নিট ফল কি হল জাঁহাপনা? আফগানদের ভাতা, জায়গির,পুরস্কার ইত্যাদি দিয়ে বশ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক চাপ বেড়ে গেলো। রাজকোষ প্রায় শূন্য । দাক্ষিণাত্যে ক্ষমতা বাড়ল। যে রাজপুতদের সঙ্গে মহামতি আকারের ছিল বন্ধুতার সম্পর্ক, তারা আপনার সময়ে শত্রু হয়ে গেলো। এখনকার বই—টই গুলো ঘাঁটেন? ঐতিহাসিকরা কী লিখছে পড়েন? স্যার যদুনাথ সরকার বলে গেছেন “ঔরঙ্গজীবের উত্তর —পশ্চিম নীতি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সর্বনাশ করে গেছে মুঘল সাম্রাজ্যের আর রাজনৈতিক দিকে ক্ষতি হল সুদূরপ্রসারী।” রাজপুতরা শত্রু হওয়ায় আফগানদের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য রাজপুতদের আর পাশে পেলেন না আপনি। আবার অন্যদিকেও গণ্ডগোল পাকালেন আপনি। দাক্ষিণাত্যে থেকে পারদর্শী, দক্ষ মুঘল সেনাদের সীমান্ত দ্বন্দ্ব লাগালেন, ফলে শিবাজীর পথ প্রশস্ত হয়ে গেলো। শিবাজী গোলকুণ্ডা থেকে কর্ণাটক, মহীশুর আর বিজাপুর থেকে রায়পুর পর্যন্ত নিজের আধিপত্য বিস্তার করে ফেললো।’
‘দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর, গোলকুণ্ডা আমি অধিকার করিনি? তাঞ্জর, ত্রিচিনপল্লীও তো আমার আয়ত্তে এনেছিলাম।এর ফলে মুঘল সীমা সুদূর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।’ — ঔরঙ্গজীবের চাঁছাছোলা উত্তর।
জিনাতও নাছোড় — ‘শিবাজি? ওঁকে নিরস্ত্র করতে পারলেন কই ?
জীবনের ২৫ বছর দাক্ষিণাত্যে কাটিয়ে শিখদের বিদ্রোহ করার সুযোগ করে দিলেন। তাছাড়া রাজসভার মধ্যেও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব প্রকট হতে লাগল। দীর্ঘকাল যুদ্ধ করে, মারাঠাদের হাতে পরাস্ত দাক্ষিণাত্যে মুঘল সেনারা যুদ্ধ বিমুখ হয়ে গেলো। সেনাদের বেতন তিন বছর বাকী ছিল কেন? রাজকোষ শূন্য হয়েছিল বলে, তাই তো? যুদ্ধ বিদ্রোহ দমন করতে করতে তো সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ল? এমনি এমনি কি আর সাম্রাজ্য শেষ হয়ে গেল? এসবই তো মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ’ এমন সময় ঔরঙ্গজীব হাঁক দিল উজীর, সেনাপতি, যে যেখানে আছো এস, বলতে বলতে খাপ থেকে তার তলোয়ার ঝলসে উঠল। জিনাতের হাতেও তলোয়ার উঠল। পূব আকাশে ততক্ষণে সূর্য্যিদেব সবে উঁকি মেরেছেন। তাই এবার যে যার কবরে ঢুকে গেল। বটগাছের ওপর থেকে ঝুপ করে আওয়াজ হল। ইকবাল অজ্ঞান হয়ে সোজা গাছের নিচে।
গাছ থেকে পড়ে তার পা ভেঙে গেছে।
এখন তার সম্পূর্ণ বেডরেস্ট। তবে রোজ মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে যায় — আর জিনাত – জিনাত, ঔরঙ্গজীব – ঔরঙ্গজীব, বলে চীৎকার করতে করতে কি সব বলতে আরম্ভ করে। নার্স এসে রোজ ওষুধ দিয়ে তাকে চুপ করায়। ইকবাল একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারে না, সেদিন রাতের বেলা সে যা দেখেছিল, তা কি ছিল স্বপ্ন না সত্যি।
এই লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা