পুটু একটা বইয়ে ইনকা সভ্যতার কথা পড়েছিল। কিন্তু পুটুর কৌতূহল নিরসন করার মত তথ্য সেই বই এ ছিলনা। পুটু ইন্টারনেটের সাহায্যে কয়েকটি ওয়েবসাইট ঘেঁটেই ইনকা সভ্যতা সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জোগাড় করে ফেলল।
উপরের ঘটনাটা খুব স্বাভাবিক একটি পরিস্থিতি। আজকাল আমরা কোন অতিরিক্ত তথ্যের দরকার পড়লে আমরা ইন্টারনেট থেকে দেখে নিই। ইন্টারনেটের জমানায় আজ তথ্য আর কোন মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বন্দী নেই। বরং তা আজ গোটা পৃথিবীর জন্যই উন্মুক্ত।
1450 সাল অবধি কিন্তু তথ্য ভান্ডার সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না।
বরং তা ছিল কিছু ধনী মানুষ এবং মূলত ধর্মীয় স্থানের করায়ত্ত। মাথায় রাখতে হবে ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রচলন শুরু হবার আগে অবধি তথ্যের প্রধান উৎস ছিল বই। প্রাচীন এবং মধ্যযুগে বই মুদ্রণের জন্য কোন উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল না।
সাধারণত বই হাতে লেখা হত এবং হাতে লেখার মাধ্যমেই তার প্রতিলিপি (copy) তৈরী করা হত।
ভেবে দেখুন আপনি একটা বই লিখলেন। এবার তা সবার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য আপনাকেই আবার তার প্রতিলিপি তৈরি করতে হবে। আপনি নিশ্চয় ভাবছেন, আরে আমি লিখবো কেন? আমি কয়েকজনকে নিযুক্ত করে নেব, আমার হয়ে তারাই বই লিখবে।
ভুল ভাবছেন! কারণ অধিকাংশ মানুষ তো লেখা – পড়াই জানেন না। বই ছাড়া পড়াশোনার ব্যাপ্তি খুবই কঠিন। আর তাই তো শিক্ষা ও জ্ঞান ছিল কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সমাজ ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি দ্বারা আচ্ছন্ন।
কিন্তু দিন পাল্টায়, এক মানব কোন ব্যাপক পরিকল্পনা ছাড়াই, আবিস্কার করে ফেলেন চলমান মুদ্রণ যন্ত্র বা ছাপাখানা। সৃষ্টি হল ইতিহাস।
মুদ্রনের গোড়ার কথা
মানব সভ্যতায় মুদ্রণ অর্থাৎ কৃত্রিম উপায়ে লেখার হরফ তৈরি করা অভ্যাস অনেক পুরানো। সাধারণত এই কাজে ব্লক প্রিন্টিং ব্যবহার করা হত। কাঠ বা ধাতুর কোন কাঠামো কেটে তাতে হরফ তৈরি হত। এর পর তাতে কালি লাগিয়ে কাগজ বা সমগোত্রীয় কিছুর উপর ছাপ দেওয়া হত। এই ব্লক ব্যাপারটা আরো ভালো বোঝার জন্য আমরা আধুনিক স্ট্যাম্পের কথা ভাবতে পারি।
কিন্তু এক্ষেত্রে একটা সমগ্র পাতার একটি ব্লক তৈরি করা হত। সুতরাং এই পদ্ধতি ছিল ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ। তাই যে বই সবাই জানে এবং পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করবে (যেমন বাইবেল) সেই রকম বই-ই ছাপা হত।
[আরো পড়ুন – JUMP ম্যাগাজিনের বিজ্ঞানের ইতিহাস বিভাগ]
গুটেনবার্গের কথা
আনুমানিক 1398 খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির মাইনৎস শহরে গুটেনবার্গ জন্মগ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত গুটেনবার্গ ছিল তাঁর পারিবারিক নাম; তাঁর সম্পূর্ণ নাম ছিল ইয়োহাসেন গুটেনবার্গ (Johannes Gutenberg)। তাঁর বাল্যকাল সম্পর্কে খুব একটা বেশি তথ্য জানা যায় না। মনে করা হয় তাঁর বাবা ছিলেন একজন স্বর্ণকার, এবং তাঁর কাছ থেকেই গুটেনবার্গ স্বর্ণকারের কাজ শিখেছিলেন।
কর্মজীবন
তিনি স্বর্ণকার রূপে কিছুদিন কাজ করেন। এরপর ভাগ্য অন্বেষণ করার জন্য স্ট্যাসবুর্গে আসেন।
এখানের আচেন শহরের গির্জা ছিল বিখ্যাত এবং তীর্থযাত্রীদের একটি অদ্ভুৎ কুসংস্কার ছিল। তীর্থযাত্রীরা আয়নার সাহায্যে পবিত্র বস্তুর প্রতিফলন বাস্ক বন্দী করে বাড়ি ফেরত নিয়ে যেতেন। গুটেনবার্গ এই আয়না ব্যবসায় লাভের সম্ভাবনা দেখেন এবং ধার নিয়ে আয়না বানানো শুরু করেন। কিন্তু বিধি বাম, সেই বছর আচেন শহরে ভয়াবহ প্লেগের (ইঁদুর বাহিত ছোঁয়াচে মারন রোগ) প্রকোপ দেখা যায়এবং গির্জা একবছরের জন্য বন্ধ হয় (বুঝতে পারছেন তো, লকডাউন সেই যুগেও প্রচলিত ছিল)। ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন গুটেনবার্গ।
ধার করা টাকা ফেরত দেবার উদ্দেশ্যে তিনি বই ছেপে রোজগারের পরিকল্পনা করেন এবং 1440 সালে ছাপাখানার ধারণা আবিস্কার করেন। কিন্তু ছাপাখানার জন্ম হয় আরো কিছু সময় পরে।
ছাপাখানার জন্ম
1448 খ্রিস্টাব্দে গুটেনবার্গ আবার অর্থ ধার করেন এবং যার থেকে ধার নিচ্ছেন তাকে ব্যবসার অংশীদার বানিয়ে ছাপাখানা শুরু করেন।
আমরা ব্লক প্রিন্টিং-এর কথা গোড়ায় পড়েছি। তিনি কিন্তু এক নতুন ধারণা জন্ম দেন। তিনি ধাতুর দণ্ডের উপর এক একটি অক্ষর খোদাই করেন। এইখানে তাঁর স্বর্ণকারের অভিজ্ঞতা তিনি কাজে লাগান। এই খোদাই করা অক্ষরগুলি আলাদা আলদা করে জোড়া যেত।
সুতরাং, এই রকম অক্ষর জুড়ে জুড়ে একটা পাতা তৈরি করার পরে, কাগজে তার ছাপ নেওয়া হত এবং তারপরে সেই অক্ষরগুলি আলাদা করে আবার ব্যবহার করা যেত।
মুদ্রণ শিল্পে এটা ছিল একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এর ফলে অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলি বই মুদ্রণ করা সম্ভব হতো আর এর ফলে ছাপার অক্ষর গুলিও অনেকটাই স্পষ্ট হতো।
গুটেনবার্গ বাইবেলের কিছু অংশ নিয়ে সংক্ষিপ্ত বাইবেল ছাপেন। তিনি এর 180টি প্রতিলিপি তৈরি করেছিলেন বলে মনেকরা হয়।
তারপর…
গুটেনবার্গ সাহেব কিন্তু চতুর ব্যবসায়ী ছিলেন না। তাঁর ছাপাখানা গন্যমান্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা শুরু করলে, তাঁর অংশীদার বেঁকে বসেন। তিনিই ছাপাখানার আসল মালিক দাবী করে আদালতে যান। মামলায় গুটেনবার্গ হেরে যান। ছাপাখানার মালিকানা তাঁর হাত থেকে চলে যায়।
পরে তিনি আরো একটি ছাপাখানা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাতে আগুন লাগে এবং তা ধ্বংস হয়ে যায়। হতাশাগ্রস্থ গুটেনবার্গ শেষ জীবনে কিছুটা শান্তি পেয়েছিলেন। তৎকালীন আর্চবিশপের নেক নজরে পড়েন গুটেনবার্গ। সরকার থেকে তাঁর জন্য কিছু ভাতা ঘোষিত হয় এবং কর থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। এর কিছু কাল পরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
[আরো পড়ুন – JUMP ম্যাগাজিনের প্রবন্ধ বিভাগ।]
মানব সভ্যতায় ছাপাখানার প্রভাব
গুটেনবার্গ আবিষ্কৃত ছাপাখানা পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দিয়েছিল। ছাপাখানা আবিষ্কার হবার পরে, জ্ঞানের দ্রুত বিস্তার হয়। ইউরোপে নবজাগরণ ঘটে। মানবসভ্যতা এগিয়ে যায়।
শেষে একটা মজার তথ্য বলি।
‘Press’ এই শব্দটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কাজের সাথে যারা যুক্ত তারা নিজেদের প্রেস-এর লোক বলে পরিচিতি দেন।
তা এই press কথাটির উৎপত্তি কিন্তু ছাপাখানা থেকে। গুটেনবার্গ সাহেবের আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে অক্ষর জুড়ে প্লেট বানানোর পরে, তাতে কালি লাগিয়ে মোক্ষম চাপ দিতে হত। ফলে ছাপা কাগজ বেরিয়ে আসতো। এই চাপ শব্দের ইংরাজি রূপান্তর হল press।
আগে সংবাদমাধ্যম বলতে শুধুমাত্র ছাপা কাগজকেই বোঝাত। খবর লেখার পরে ছাপাখানাতেই তা কাগজের উপর ফুটে উঠত। তাই খবরের আসল ঠিকানা ছিল ছাপাখানা বা প্রেস বা মোক্ষম চাপের জায়গা।
ঋণস্বীকার
1 – Roar.media
2. Wikipedia
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা