জীবনবিজ্ঞান – দশম শ্রেণি – জীবজগতের নিয়ন্ত্রন ও সমন্বয় (উদ্ভিদের চলন)
স্কুলে ক্লাস শেষ হয়ে গেলে তোমরা বাড়ি ফেরো, সারাদিনের ক্লান্তির ফলে নিশ্চয়ই তোমাদের খুব খিদে পায়। স্কুল থেকে ফেরার রাস্তাতেই খুব জোর খিদে পেয়ে যায়! কি তাই তো? কিন্তু বাড়িতে এলেই মা সঙ্গে সঙ্গে খেতে দেন না, বলেন পোশাক পরিবর্তন করে ভালো করে হাত – মুখ ধুয়ে আসার জন্য। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে খাবার টেবিলে বসার পরে, তবেই খাবার পাওয়া যায়!
আমরা হলাম মানুষ, এই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত প্রাণী। আমরা পায়ে হেঁটে চলে বেড়াই, খাবার সংগ্রহ করে খাই, দরকার মতো উদ্দীপনায় সাড়া দিই।
কিন্তু গাছেরা কি করে?
তাদের তো আর বাড়ি নেই, কিংবা তাদের জন্য তো আর খাবার কেউ তৈরি করে বসে থাকে না! উদ্ভিদদের নিজেদের খাবার নিজেদের খাবার নিজেদের তৈরি করতে হয়; যাকে আমরা সালোকসংশ্লেষ বলি, পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বা হ্রাস পেলে নিজেদের রক্ষা করতে হয়, আবার বেঁচে থাকার জন্য নানান প্রতিকূল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হয়।
নিশ্চয় ভাবছো যে উদ্ভিদ তো আর প্রাণীদের মতো চলে বেড়াতে পারে না, তাহলে এই প্রয়োজনীয় কাজ করে কিভাবে? এই প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর আমরা খুঁজবো এই আলোচনায়। তবে তার আগে তোমরা নিচের ভিডিওতে দেখে নিতে পারো যে কিভাবে মাত্র ২৫ দিনে একটা গাছ বীজ থেকে বেড়ে উঠে।
সংবেদনশীলতা (sensitivity)
প্রাণীদের মতো উদ্ভিদরাও পরিবেশের বিভিন্ন পরিবর্তন শনাক্ত করে, পরিস্থিতি অনুযায়ী যথাযথ সাড়াপ্রদান করে। এই সাড়াপ্রদানের ক্ষমতা বা বিশেষ ধর্মকে বলা হয় সংবেদনশীলতা।
এবার বোঝা যাক যে এই সংবেদনশীলতা তৈরি হয় কিভাবে?
পরিবেশের পরিবর্তন হলে জীব (এখানে কিন্তু উদ্ভিদ বা প্রাণী উভয়ের কথা বলা হচ্ছে) সেগুলি বুঝতে বা শনাক্ত করতে পারে, একে বলা হয় উদ্দীপক। এই উদ্দীপক থেকে সৃষ্টি শক্তি হল উদ্দীপনা।
যেমন – মানুষের ক্ষেত্রে পচা গন্ধ নাকে এলে আমরা সেই স্থান থেকে সরে আসি। এক্ষেত্রে পচা গন্ধ হল উদ্দীপক আর সরে আসার উচ্ছা হল উদ্দীপনা।
উদ্ভিদের জন্য উদ্দীপক প্রধানত দুই প্রকারের হয়।
বাহ্যিক উদ্দীপকঃ নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই উদ্দীপক বাইরে থেকে উৎপন্ন হয়। যেমন – যে কোনো লতানে গাছ (যেমন লাউ, কুমড়ো, মটর) কোনো শক্ত অবলম্বন পেলে তাকে জড়িয়ে বেড়ে ওঠে।
অভ্যন্তরীণ উদ্দীপকঃ এই উদ্দীপক উদ্ভিদের দেহের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয়। যেমন – জিব্বেরেলিন হরমোনের প্রভাবে গাছের মূল বৃদ্ধি পায়।
উদ্ভিদের সাড়াপ্রাদনের পদ্ধতি
প্রাচীনকালে মনে করা হত যে, পরিবেশের কোনো পরিবর্তন উদ্ভিদ শনাক্ত করতে পারে না, উদ্ভিদরা শুধুমাত্র বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক পদার্থ যেমন হরমোনের মাধ্যমে উদ্দীপনায় সাড়াপ্রদান ও সমন্বয় করে। কিন্তু বাঙালি বৈজ্ঞানিক আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর যুগান্তকারী পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে প্রাণীর উদ্ভিদের বিভিন্ন অনুভুতি রয়েছে। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু লজ্জাবতী ও বনচাঁড়াল উদ্ভিদের সাহায্য নিয়ে প্রমাণ করেন যে –
প্রাণীর মতো উদ্ভিদও তার ছন্দোবদ্ধ ক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং তাঁর সংবেদনশীলতা নিয়ন্ত্রণ করে।
এই উদ্দীপনায় সাড়াপ্রদানের কারণ হিসাবে তিনি বাহ্যিক বিভিন্ন উদ্দীপকের (যেমন – স্পর্শ, উত্তাপ ইত্যাদি) উদ্দীপনায় উদ্ভিদের অভ্যন্তরে কোশের পরিবর্তনকে চিহ্নিত করেন।
তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র ক্রেসকোগ্রাফ (crescograph) দ্বারা তিনি উদ্ভিদের চলন সংক্রান্ত পরীক্ষাটি করেছিলেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ভিদের অতি সামান্য চলন বা সাড়াপ্রদান পরিমাপ করা যায়।
উদ্ভিদের সাড়াপ্রদানের ব্যাখ্যা
মনে রাখতে হবে, উদ্ভিদের সাড়া প্রদান করার প্রক্রিয়া প্রাণীদেহের তুলনায় অত্যন্ত ধীর। এই চলন দুটি কারণে হয় –
বৃদ্ধিজ চলনঃ উদ্ভিদ দেহের বৃদ্ধির কারণে এই চলন সম্পন্ন হয়। এই চলন প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। যেমন পর্যাপ্ত আলো ও ভালো মৃত্তিকা পেলে উদ্ভিদ খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে।
প্রকরণ চলনঃ
কোশের রসস্ফিতির তারতম্যের জন্য উদ্ভিদের যে চলন লক্ষ্য করা যায়, তাকে প্রকরণ চলন বলা হয়। এই প্রকার চলন ত্রি-ফলক যুক্ত বনচাঁড়ালে লক্ষ্য করা যায়। একটি বড় পাতার তলায় দুটি ছোট পত্রক থাকে, তারা ক্রমান্বয়ে ওঠা-নামা করতে থাকে। তবে এই প্রকার চলন কেবল মাত্র দিনের বেলাই দেখতে পাওয়া যায়। নিচের ভিডিওতে এই প্রকার চলন দেখানো হল।
প্রসঙ্গত বনচাঁড়াল ও লজ্জাবতী এই দুটি উদ্ভিদ চলনের খুব দ্রুত সাড়া দেয়। এই ঘটনা উদ্ভিদ জগতে বিরল। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু এই কারণে তাঁর জগৎখ্যাত পরীক্ষার জন্য এই দুটি উদ্ভিদকে বেছে নিয়েছিলেন।
আমরা বুঝতে পারলাম যে পরিবেশের নানান পরিবর্তনের সাথে সাথে উদ্ভিদ নিজের পরিবর্তন ঘটায়। এবার আমরা বিস্তারিত জানবো উদ্ভিদের চলন সম্পর্কে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
চলন কাকে বলে?
যে প্রক্রিয়ায় জীব বিভিন্ন উদ্দীপকের সাহায্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক স্থানে স্থির থেকে তার দেহের অংশকে সঞ্চালন করে, তাকে চলন বলা হয়।
উদ্ভিদের চলন মূলত তিন প্রকার
ট্যাকটিক চলন (Tactic movement):
ট্যাকটিক কথার অর্থ হল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া। এই প্রকার চলনে বহিস্থ উদ্দীপকের প্রভাবে সমগ্র উদ্ভিদ দেহের স্থান পরিবর্তিত হয়। এই প্রকার চলনকে প্যারাটনিক চলনও বলা হয়।
ট্যাকটিক চলনেও কিছু প্রকারভেদ আছে, সেগুলি হলঃ
- ফটোট্যাকটিক (চলন যখন আলোর অভিমুখে হয়)
- কেমোট্যাকটিক (চলন যখন রাসায়নিক পদার্থের অভিমুখে হয়)
- থার্মোট্যাকটিক (চলন যখন উষ্ণতার অভিমুখে হয়)
- হাইড্রোট্যাকটিক (চলন যখন জলের অভিমুখে হয়)
- রিওট্যাকটিক (চলন যখন জলস্রোতের অভিমুখে হয়)
উপরিউক্ত ট্যাকটিক চলনগুলির মধ্যে একমাত্র ফটোট্যাকটিক চলন তোমাদের পাঠ্যাংশের অন্তর্গত। অন্য প্রকারগুলি তোমরা বিস্তারিত ভাবে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়বে।
ফটোট্যাকটিক চলনঃ নামের মধ্যে দিয়েই আমরা এই প্রকার চলনের ধরণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। আলোক উদ্দীপকের প্রভাবে উদ্ভিদের সামগ্রিক চলনকে ফটোট্যাকটিক চলন বলা হয়।
উদাহরণঃ ভলভক্স জাতীয় শৈবালগুলি আলোর উৎসের দিকে এগিয়ে যায়। নিচের ভিডিওটিতে ভলভক্সের চলন দেখানো হল।
ট্রপিক চলন (Tropic movement)
বহিস্থ উদ্দীপকের প্রভাবে যখন উদ্ভিদ, উদ্দীপকের গতিপথের অভিমুখে চালিত হয়, তখন তাকে ট্রপিক চলন বা দিক্নির্ণীত চলন বলা হয়। সাধারণত এই ধরনের চলনের ক্ষেত্রে উদ্ভিদের বক্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
প্রকারভেদ অনুযায়ী ট্রপিকচলনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
ফটোট্রপিক চলনঃ
আলোক উদ্দীপকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত চলনকে ফটোট্রপিক চলন বলা হয়। এই দ্বারা কান্ড আলোর দিকে (আলোক অনুকূল) ও মূল আলোর বিপরীত (আলোক প্রতিকুল) দিকে এগিয়ে যায়।
উদাহরণঃ প্রায় সব প্রকার উদ্ভিদের ক্ষেত্রেই এই প্রকার চলন দেখা যায়। এর একটা উদাহরণ হাতে কলমে করে দেখতে পারো। যেকোন টবে বসানো উদ্ভিদকে জানলার সামনে কিছুদিনের জন্য রেখে দিলে, দেখা যাবে উদ্ভিদের কাণ্ডটি আলোর অভিমুখে বক্র ভাবে চালিত হয়েছে।
জিওট্রপিক চলন
পৃথিবীর অভিকর্ষজ বলের দ্বারা যে চলন নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে জিওট্রপিক চলন বলা হয়। আমরা সবাই পৃথিবীর অভিকর্ষজ বল সম্পর্কে জানি, এই বলের দ্বারা পৃথিবী যে কোন বস্তুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এই অভিকর্ষ বলের জন্য উদ্ভিদের মূল (অভিকর্ষ অণুকুলবর্তী) পৃথিবীর দিকে ধাবিত হয় এবং কান্ড (অভিকর্ষ প্রতিকূলবর্তী) অভিকর্ষের বিপরীতে চালিত হয়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
হাইড্রোট্রপিক চলনঃ
জলের উৎসের গতিপথ দ্বারা যখন উদ্ভিদের বক্রচলন নিয়ন্ত্রিত হয় তখন তাকে হাইড্রোট্রপিক চলন বলে। আমরা জানি জল উদ্ভিদের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। তাই জলের উৎসমুখের দিকে চলন বা হাইড্রোট্রপিক চলন সকল উদ্ভিদের ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়।
একটা সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে বাড়িতে উদ্ভিদের হাইড্রোট্রপিক চলন পরীক্ষাটি করা যেতে পারে। প্রথমে কিছু ধনে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। নীচে জলের পাত্র রেখে, তার উপরে একটি ঝুড়ি রেখে তাতে ধনে বীজগুলি ছড়িয়ে দিতে হবে। কিছুদিন জল দিয়ে রেখে দেবার পর দেখা যাবে, বীজগুলি থেকে অঙ্কুরোদগম হয়েছে এবং মূল গুলি জলের দিকে ধাবিত হয়েছে।
ন্যাস্টিক চলন (Nastic movement)
ন্যাস্টিক কথার অর্থ ব্যাপ্তি। উদ্ভিদ যখন সরাসরি উদ্দীপকের গতিপথের দিকে না গিয়ে উদ্দীপকের তীব্রতার দ্বারা নিয়ত্রিত হয় তখন তাকে ন্যাস্টিক চলন বলা হয়। যেমন কাঁঠালিচাপা ফুল রাতের অন্ধকারে ফোটা।
অনেকের ট্রপিক চলন এবং ন্যাস্টিক চলন আলাদা করে বুঝতে অসুবিধা হয়। কারণ দুটো ক্ষেত্রেই উদ্ভিদ উদ্দীপকের উৎসের (যেমন আলো) দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু দুটো চলন সম্পূর্ণ আলাদা। ট্রপিক চলনের ক্ষেত্রে উদ্দীপকের তীব্রতার কোন ভুমিকা থাকে না, উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে উদ্ভিদ আলোর দিকে অগ্রসর হয়।
ন্যাস্টিক চলনের ক্ষেত্রে কিন্তু উদ্দীপকের তীব্রতার ভুমিকাই প্রধান। যেমন আলোর তীব্রতা কম থাকলে ফুল ফোটা।
ন্যাস্টিক চলনের প্রকারভেদ চার প্রকারের।
ফটোন্যাসটিক চলনঃ আলোর তীব্রতার উপর নির্ভর করে উদ্ভিদের বক্রচলন। যেমন সূর্যমুখি ফুল দিনের বেলায় ফোটে এবং আলোর তীব্রতার উপর ভিত্তি করে দিক পরিবর্তন করে।
থার্মোন্যাস্টিক চলনঃ থার্মো কথার অর্থ উষ্ণতা। উষ্ণতার তীব্রতার উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদের যে বক্রচলন হয়, তাকে থার্মোন্যাস্টিক চলন বলা হয়। যেমন উদাহরণ হিসাবে বলা যায় টিউলিপ ফুল সাধারণ উষ্ণতায় ফোটে কিন্তু উষ্ণতা হ্রাস পেলে তা আবার বন্ধ হয়ে যায়।
সিসমোন্যাস্টিক চলনঃ স্পর্শ, কম্পন ইত্যাদি বহিস্থ উদ্দীপনার প্রভাবে যে চলন দেখা যায়, তাকে সিসমোন্যাস্টিক চলন বলা হয়। যেমন লজ্জাবতী গাছের পাতা স্পর্শ করলে বন্ধ হয়ে যায়।
কেমোন্যাস্টিক চলনঃ রাসায়নিক তীব্রতার উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদ অঙ্গের যে চলন ঘটে তাকে কেমোন্যাস্টিক চলন বলে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, পতঙ্গভুক উদ্ভিদে যেমন ডায়োনিয়া পতঙ্গ বসলে, পতঙ্গের রাসায়নিক উদ্দীপনায় সাড়া দিয়ে পত্রফলকের কর্সিকাগুলি পতঙ্গকে ঘিরে ফেলে।
উদ্ভিদের চলন সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → উদ্ভিদ হরমোন।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-LSc-1a