ভৌতবিজ্ঞান – নবম শ্রেণি – অধ্যায়: দ্রবণ (তৃতীয় পর্ব)
আগের দুটি পর্বে আমরা দ্রবণের ধারণা এবং কলয়েড নিয়ে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা দ্রবণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
‘বিশুদ্ধ দ্রবণ’, এই শব্দটির সাথে আমরা ছেলেবেলা থেকেই পরিচিত। নুন-চিনির জল থেকে ধাতুসঙ্কর, সবই প্রকৃত বা বিশুদ্ধ দ্রবণ।
দ্রবণ কাকে বলে?
দুই বা ততোধিক পদার্থ অপর কোনো পদার্থে সম্পূর্ণরূপে মিশে গিয়ে যে সুসমসত্ত্ব মিশ্রণ তৈরী করে এবং কোনোভাবেই কোনো মেমব্রেন বা পর্দার দ্বারা যার উপাদান পৃথকীকরণ করা যায় না, তাকে দ্রবণ বলে।
এর আগে আমরা কলয়েড দেখেছি, এবং বুঝেছি যে কলয়েডকে অর্ধভেদ্য পর্দার দ্বারা পৃথকীকরণ সম্ভব। তার কারণ, কলয়েডের অণুর আকার (10–4– 10–7 সেন্টিমিটার) অর্ধভেদ্য পর্দার ছিদ্রের তুলনায় বৃহত্তর (10–7 সেন্টিমিটার) হয়। কিন্তু দ্রবণে, মিশে থাকা পদার্থের অণুর ব্যাস 10–7 সেন্টিমিটারের থেকে কম হওয়ায় সে অর্ধভেদ্য পর্দাকে ভেদ করে চলে যায়। তাই একে কোনো মেমব্রেন বা পর্দা দ্বারা পৃথকীকরণ সম্ভব নয়।
দ্রবণের দুটি অংশ, দ্রাব ও দ্রাবক।
দ্রাবক কাকে বলে?
দুই বা ততোধিক পদার্থ মিশে যখন দ্রবণ প্রস্তুত করে এবং দুটি পদার্থই যদি একই দশার হয়, তবে তাতে যার পরিমাণ ওজন বা আয়তন বেশি থাকে সেটিকে দ্রাবক বলে। যদি, উভয়ে ভিন্ন দশার হয়, তবে সেক্ষেত্রে দ্রবণ যেটির দশা ধারণ করে সেটিকে দ্রাবক বলা যেতে পারে।
দ্রাব কাকে বলে?
দুই বা ততোধিক পদার্থ মিশে যখন দ্রবণ প্রস্তুত করে এবং দুটি পদার্থই যদি একই দশার হয়, তবে তাতে যার পরিমাণ ওজন বা আয়তন কম থাকে সেটিকে দ্রাব বলে। যদি, উভয়ে ভিন্ন দশার হয়, তবে যে উপাদানটি নিজস্ব দশা বিনষ্ট করে সেটিকে দ্রাব বলা যেতে পারে।
কয়েকটি উদাহরণ দিলে ধারণাটি আরো পরিষ্কার হবে।
চিনি আর জলকে মেশানো হলে, একটি তরল দ্রবণ প্রস্তুত হয়। যেহেতু মিশ্রণটি তরল, তাই তরল জল দ্রাবক ও কঠিন চিনি দ্রাব।
কিন্তু সোডিয়াম আর পারদকে মেশালে দ্রবণটি চটচটে কঠিনে পরিণত হয়। যেহেতু দ্রবণ কঠিন, তাই কঠিন সোডিয়াম দ্রাবক ও তরল পারদ দ্রাব।
অপরদিকে অ্যাসিড ও জল মেশালে, উভয়েই তরল। সেক্ষেত্রে জলের পরিমাণ বেশি থাকলে জল দ্রাবক, অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকলে অ্যাসিড দ্রাবক।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]
দৈনন্দিন জীবনে দ্রবণের উদাহরণ
দ্রাব
দ্রাবক |
কঠিন | তরল | গ্যাসীয় |
কঠিন | ধাতু সংকর
যেমন: স্টিল (লোহা, কার্বন, নিকেল ও ক্রোমিয়াম) |
অ্যামালগাম
যেমন: সোডিয়াম ও পারদ, সোনা ও পারদ |
নিকেল/প্যালাডিয়াম/প্ল্যাটিনাম ও হাইড্রোজেন
পোড়াচুন ও কার্বন ডাই অক্সাইড |
তরল | স্যালাইন , ক্ষারের জলীয় দ্রবণ | অ্যাসিডের লঘু দ্রবণ, বাণিজ্যিক ইথানল | কোল্ড ড্রিঙ্কস |
গ্যাসীয় | নাইট্রোজেন গ্যাসে কর্পূর বা যে কোনো উদ্বায়ী কঠিন | বায়ুতে জলীয় বাষ্প | বায়ু |
একটি তরল, অপর একটি তরলের সাথে মিশে দ্রবণ তৈরি করলো এটা একটা সহজ ঘটনা। কিন্তু গ্যাস বা কঠিন কি দ্রবীভূত হতে পারে? উত্তর হল, হ্যাঁ পারে। কিন্তু কিভাবে?
কঠিন কিভাবে দ্রবীভূত হয় এবং কেন?
কঠিন সাধারণত তিনটি উপায়ে দ্রবীভূত হয়।
১। আয়নে ভেঙ্গে গিয়ে : যেমন নুন (সোডিয়াম ক্লোরাইড) জলে দ্রবীভূত হওয়ার সময় সোডিয়াম ক্যাটায়ন ও ক্লোরাইড অ্যানায়নে ভেঙে গিয়ে মিশে যায়।
এর পেছনে যে কারণটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হল দ্রাবকের দ্রাবকায়ন শক্তি। যে তীব্রতায় জলের ঋণাত্মক অংশ (O) দ্রাবকের ধনাত্মক আয়নকে ও ধনাত্মক অংশ (H) দ্রাবকের ঋণাত্মক অংশকে আকর্ষণ করে সেটি দ্রাবকায়ন শক্তি। এই কারণেই তড়িৎযোজী যৌগ জলে গিয়ে আয়নিত হয়।
২। হাইড্রোজেন বন্ধনীর দ্বারা দ্রাবকের অণুর সাথে জুড়ে: যেমন চিনি বা গ্লুকোজকে জলে গুললে ওতে উপস্থিত অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সাথে জলের হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন H-বন্ধন করে।
৩। রাসায়নিক বিক্রিয়া করে: ক্যালসিয়াম অক্সাইডকে জলে দিলে, ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড করে তা দ্রবীভূত হয়।
গ্যাস কিভাবে দ্রবীভূত হয় এবং কেন?
গ্যাস সাধারণত চারটি উপায়ে দ্রবীভূত হয়।
১। আয়নে ভেঙ্গে গিয়ে : যেমন হাইড্রোজেন ক্লোরাইড জলে দ্রবীভূত হওয়ার সময় H ক্যাটায়ন ও ক্লোরাইড অ্যানায়নে ভেঙে গিয়ে মিশে যায়।
২। হাইড্রোজেন বন্ধনীর দ্বারা দ্রাবকের অণুর সাথে জুড়ে: যেমন অ্যামোনিয়া জলে গুললে ওতে উপস্থিত নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের সাথে জলের হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন H-বন্ধন করে।
৩। রাসায়নিক বিক্রিয়া করে: যেমন কার্বন ডাই অক্সাইডকে জলে দিলে, কার্বনিক অ্যাসিড তৈরী করে তা দ্রবীভূত হয়।
৪। আন্তঃরাণবিক ফাঁকে ঢুকে: যেমন জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌতবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবনবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]
দ্রাব্যতা কাকে বলে?
কোনো নির্দিষ্ট উষ্ণতায় 100 গ্রাম দ্রাবকে সর্বোচ্চ পরিমাণ যত গ্রাম দ্রাব দ্রবীভূত হতে পারে, সেই পরিমাণকে ওই উষ্ণতায় ওই দ্রাবের দ্রাব্যতা বলে।
যেমন পটাসিয়াম নাইট্রেট 20° উষ্ণতায় 100 গ্রাম জলে (দ্রাবক) সর্বোচ্চ পরিমাণ 32 গ্রাম দ্রবীভূত হতে পারে। সুতরাং পটাসিয়াম নাইট্রেটের দ্রাব্যতা হল 32। এটি একটি এককবিহীন রাশি। এটি ওজনমাত্রিক বিশ্লেষণে নির্ধারিত হয়।
[পরবর্তী পর্ব – দ্রবণের শ্রেণিবিভাগ]
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-PS-4.3-c