ভৌতবিজ্ঞান – দশম শ্রেণি – অধ্যায়: রাসায়নিক বন্ধন (তৃতীয় পর্ব)
আগের পর্বে আমরা একটা গল্পের মাধ্যমে আয়নীয় বন্ধন সহজভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম।
সেখানে আমরা তোমার আর তোমার বন্ধুর গল্প বলেছিলাম। বলেছিলাম কিভাবে দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমে বন্ধুত্বর বন্ধন স্থাপিত হলো। এবার পালা সমযোজী বন্ধনের, তাই এই পর্বে থাকছে আর কি উপায়ে সেই বন্ধন দৃঢ় হয়।
[আরো পড়ুন – রাসায়নিক বন্ধন]
সমযোজী বন্ধন
একটা সহজ উদাহরণ ভাবা যাক।
পরীক্ষা এগিয়ে এসেছে। স্কুল থেকে তোমাদের মাধ্যমিকের টেস্ট পেপার কিনে নিতে বলেছে। তোমার কাছে পুরোনো বছরের একটা টেস্ট পেপার আছে। নতুন টেস্ট পেপার কিনতে তোমার মন সায় দিচ্ছে না, মাত্র আড়াই মাসের জন্য নতুন টেস্ট পেপার কেনা বেকার আর আগেরটাই এখনো শেষ হয়নি সল্ভ করা!
কি করা যায়?
তুমি তোমার বন্ধুকে ধরলে ক্লাসের শেষে। আশ্চর্য্য ব্যাপার! ওর মাথাতেও একই চিন্তা ঘুরছে। ওর কাছেও একটা পুরোনো টেস্ট পেপার রয়েছে। নতুন টেস্ট পেপার কিনলে সেটা বেকার হয়ে যাবে তিন মাসেই। সুতরাং….!!
তুমি প্রস্তাব দিলে দুজনে মিলে টেস্ট পেপারটা কেনার। ও তো এক কথায় রাজি।
ঠিক হলো তুমি 60% দেবে ও 40%। ওর কাছে পকেটমানি কম রয়েছে, আর বাড়িতে ও চাইবে না এই বইয়ের জন্য। তুমিও পছন্দ করো নিজের সঞ্চয় থেকেই বই খাতা কেনার। কিন্তু তোমার কাছে একটু বেশি রয়েছে। তাই 60-40 ভাগ. তবে একটা শর্তে। মাসের 12 টা দিন ও নেবে আর বাকি 18 দিন বইটা তোমার।
যে যেমন ভাগ দিয়েছে সে তেমন ব্যবহার করবে। পরিচ্ছন্ন সমাধান।
এখন কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক…
১। বইটা কে কিনেছে?
২। বইটার বিল কার কাছে?
৩। কেনার পরে বইটার মালিক কে?
৪। নতুন বইটা কে ব্যবহার করছে?
যদি উপরের প্রশ্নের উত্তরগুলি বুঝতে পারো, তবে সমযোজী বন্ধনও বুঝতে পারবে!
বইটা দুজনেই কিনেছো, বিল দুজনেই রাখতে পারবে। এমনকি, বিলটা বইয়ের পাতার খাঁজেই রাখা রয়েছে। দুজনেই বইটার মালিক, তোমার অংশীদারী একটু বেশি এবং তোমরা দুজনেই বইটা ব্যবহার করছো।
তুমি একটু বেশি ব্যবহার করছো সেক্ষেত্রে। ঠিক সেরকমই হবে পরমাণুর ক্ষেত্রে।
কিন্তু এই ধরণের বন্ধন তৈরী করতে অংশগ্রহণকারী পরমাণুর কিছু বিশেষ ধর্ম থাকা প্রয়োজন। সেগুলি হলো
- সর্ববহিঃস্থ কক্ষে 4, 5, 6 বা 7টি ইলেক্ট্রনের উপস্থিতি: যেমন কার্বন, সিলিকন (4), নাইট্রোজেন, ফসফরাস, আর্সেনিক (5) অক্সিজেন, সালফার (6), হ্যালোজেন (7)
- পরমাণুর ক্ষুদ্র আকার
- মধ্যম থেকে উচ্চমানের তড়িৎঋণাত্মকতা (মোটামুটি 1.5 থেকে 4)
এখন এখানে উল্লেখ করা দরকার যে কিছু পরমাণু আছে যারা উপরোক্ত 3টি শর্তের দুটি শর্ত মেনেও সমযোজী বন্ধন করতে পারে, তবে তা ক্ষেত্র বিশেষে।
যেমন হাইড্রোজেন সর্ব্ববহিঃস্থ কক্ষে ১টি পরমাণু নিয়ে সমযোজী বন্ধন তৈরি করে। কারণ এর আকারও ছোট ও তড়িৎ ঋণাত্মকতা 2.1। তাই হাইড্রোজেন অষ্টক পূর্তি না করে সর্ববহিঃস্থ কক্ষে হিলিয়ামের মতন 2টি ইলেক্ট্রন ধরবার চেষ্টা করে।
এরা সকলেই অষ্টক পূর্তির জন্য ইলেক্ট্রন গ্রহণ করতে ভালোবাসে, কিন্তু কেউ ইলেক্ট্রন দিতে চায় না।
সুতরাং নিজেরটা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। নিজের ইলেক্ট্রনের ভাগ দিলে অন্যের ইলেক্ট্রনের ভাগও পাওয়া যায়। তাই দিয়েই পরমাণুর অষ্টকপূর্তি হয়। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
ধরা যাক নাইট্রোজেনের কথা।
নাইট্রোজেনের পরমাণু ক্রমাঙ্ক 7। তাই ইলেক্ট্রন বিন্যাস 2, 5। এখন নাইট্রোজেনের 3টি ইলেক্ট্রন প্রয়োজন। কিন্তু কোনো পরমাণুই নাইট্রোজেনকে ইলেক্ট্রন দান করতে আগ্রহী নয়। তো নাইট্রোজেন কি করবে? নাইট্রোজেন তার 3টি ইলেক্ট্রন সামনে বাড়িয়ে দেবে। হ্যাঁ! তার ঠিক যতগুলো দরকার ততটা!
এবার আসা যাক হাইড্রোজেনের কথায়। হাইড্রোজেনের পরমাণু ক্রমাঙ্ক 1, সুতরাং এর একটি মাত্র ইলেক্ট্রনই আছে, আর সেটাই সর্ববহিঃস্থ কক্ষের ইলেক্ট্রন। আগেই বলেছি হাইড্রোজেন এই কক্ষে 2টি ইলেক্ট্রন ধরতে চায়। সুতরাং তার প্রয়োজন 1টি ইলেক্ট্রন। সেও নিজের একমাত্র ইলেক্ট্রনটি সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
[আরো পড়ুন – মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি]
এরকম তিনজন হাইড্রোজেন তিনটি ইলেক্ট্রন নাইট্রোজেনকে বাড়িয়ে দিলে নাইট্রোজেনের থেকে আসা 3টি ইলেক্ট্রন এই তিনটি হাইড্রোজেন ভাগ করতে পারে। প্রত্যেকে 1টি করে ইলেক্ট্রনের ভাগ পেলে প্রত্যেক হাইড্রোজেনের সর্ব্ববহিঃস্থ কক্ষে 2টি করে ইলেক্ট্রন চলে আসে। ঠিক তেমনই নাইট্রোজেনও 3টি ইলেক্ট্রন ভাগ পেয়ে সর্ব্ববহিঃস্থ কক্ষে 8টি ইলেক্ট্রন বানাতে পারে।
এইভাবে NH3 তৈরী হয়।
এখন উল্লেখ্য যে, নাইট্রোজেনের তড়িৎ ঋণাত্মকতা (3.0) হাইড্রোজেনের তড়িৎ ঋণাত্মকতার অপেক্ষা (2.1) বেশী হওয়ায় বন্ধনের ইলেক্ট্রন জোড় নাইট্রোজেনের দিকে বেশি ঘেঁষে থাকে।
যদি দুজনের তড়িৎঋণাত্মকতা সমান হতো বা যদি দুটি পরমাণুই এক মৌলের পরমাণু হতো, তবে বন্ধনের ইলেক্ট্রন জোড় বন্ধনের ঠিক মাঝখানে থাকতো। এই একদিকে ঘেঁষে থাকার কারণে নাইট্রোজেনের ওপর আংশিক ঋণাত্মক আধান সৃষ্টি হয় ও হাইড্রোজেনের ওপর আংশিক ধনাত্মক আধান সৃষ্টি হয় (যেহেতু পরমাণু নিস্তড়িৎ)। এই ঘটনাকে ধ্রুবীয়তা বা Polarity বলে।
দশম শ্রেণির অন্যান্য বিভাগগুলি পড়ুন –ভৌতবিজ্ঞান | গণিত | জীবনবিজ্ঞান
এর ফলে একটি অণুর নাইট্রোজেন প্রতিবেশী অণুর হাইড্রোজেনকে ও হাইড্রোজেন প্রতিবেশী অণুর নাইট্রোজেনকে তড়িদাকর্ষণ করতে পারে। এই আকর্ষণকে হাইড্রোজেন বন্ধন বলে। এর ফলে আমোনিয়া NH3 গ্যাসকে সহজে তরলে পরিণত করা যায়।
এই উদাহরণে বলি তুমি হলে নাইট্রোজেন, তোমার বন্ধু হাইড্রোজেন, আর বইটা ইলেক্ট্রন।
তোমার নিবিষ্ট অর্থ, নাইট্রোজেনের তড়িৎঋণাত্মকতা আর তোমার বন্ধুর নিবেশ হাইড্রোজেনের তড়িৎ ঋণাত্মকতা। বইটা তোমার কাছে বেশিদিন থাকার মতোই বন্ধন ইলেকট্রন জোড় নাইট্রোজেনের দিকে ঘেঁষে রয়েছে।
এই বন্ধনের ফলে যে অণু সৃষ্টি হয়, তা ভৌত ও রাসায়নিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই এই অণুকে প্রকৃত অণু বলে। এই অণুসকলের মধ্যে সবকটিতে হাইড্রোজেন বন্ধনের মতন তড়িৎচুম্বকীয় আকর্ষণ লক্ষিত হয় না। এদের মধ্যে এরকম তড়িৎচুম্বকীয় আকর্ষণের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে এদের দশা (কঠিন, তরল বা গ্যাসীয়) সৃষ্টি হয়। যাদের ভর যত বেশি তারা তত বেশি কঠিন হয়। যাদের মধ্যে এরকম তড়িদাকর্ষণ বেশী তাদেরও গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক উচ্চ হয়।
যে ধর্মগুলি সমযোজী যৌগে সৃষ্টি হয় সেগুলি হল –
- কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় দশা
- উচ্চ থেকে নিম্ন, সকল প্রকার গলনাঙ্ক বা স্ফুটনাঙ্ক (বোরনের বা হীরের গলনাঙ্ক উচ্চ, হাইড্রোজেনের অত্যন্ত কম)
- জলে স্বল্প দ্রাব্যতা (যেমন চিনি, কার্বন দেয় অক্সাইড) বা অধ্রুবীয় দ্রাবকে দ্রাব্যতা (বেঞ্জিন, টলুইন, আলকোহোল, ইথার, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড প্রভৃতি)
- সম্পূর্ণরূপে বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অক্ষমতা (বন্ধন ভেঙ্গে বিভিন্ন অন্তর্বতী যৌগ ও উপজাত দ্রব্য তৈরী হয়)
- গলিত অবস্থায় তড়িৎ পরিবাহীতার অক্ষমতা (মুক্ত ইলেক্ট্রনের অভাব)
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Psc-8-2c