ভূগোল – দশম শ্রেণি – ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ (তৃতীয় পর্ব)
আগের পর্বে আমরা ধান ও গম উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা অর্থকরী ফসল [চা, কার্পাস ও কফি] নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
অর্থকরী ফসল কাকে বলে?
সাধারণত অর্থকরী ফসল বলতে আমরা সেইসব ফসলকেই গণ্য করে থাকি যেগুলি উৎপাদনের পর প্রায় সম্পূর্ণটাই বিদেশে রপ্তানি হয় এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। এই ফসলগুলি বাণিজ্য, রপ্তানি এবং আয়ের উদ্দেশ্যে চাষ করা হয় বলে, একে বাণিজ্যিক ফসলও বলা হয়।
ক) চা
চা এক ধরণের সুগন্ধযুক্ত ও স্বাদবিশিষ্ট জনপ্রিয় উষ্ণ পানীয়, যা চা পাতা গরম জলে ফুটিয়ে তৈরি করা হয়। চা এক ধরণের ছোট গুল্মজাতীয় চিরহরিৎ গাছ। চা গাছের পাতা, মুকুল ও পর্ব শুকিয়ে, গুঁড়ো করে ইত্যাদি উপায়ে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন করা হয়। চা মৌসুমি অঞ্চলের পার্বত্য জমি ও উচ্চভূমির ফসল।
চায়ের শ্রেণিবিভাগ
প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া অনুসারে সারাবিশ্বে মোট ছয়টি প্রধান ধরণের চা পাওয়া যায়। যেমন – কালো চা, সবুজ চা, সাদা চা, ওলং চা, ইষ্টক চা এবং প্যারাগুয়ে চা।
ভারতে চা উৎপাদন ব্যবস্থা
ভারতে পানীয় হিসাবে চা এর চাহিদা সর্বাধিক। চীনের পর ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় চা উৎপাদক দেশ।
অর্থকরি ফসল সংক্রান্ত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
চা উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ
প্রাকৃতিক পরিবেশ
I. চা চাষের জন্য 175 – 250 সেমি বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয়।
II. প্রচুর বৃষ্টিপাতযুক্ত পাহাড়ি বা উচ্চ ঢালু জমি চা চাষে উপযোগী। জলনিকাশির ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
III. দোআঁশ মাটি বিশেষ করে হিউমাস, ফসফরাস ও লোহা মিশ্রিত মাটি চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী।
IV. সরাসরি সূর্যালোক পেলে চা গাছ নষ্ট হয়ে যায়, তাই চা বাগানে বড় বড় গাছ লাগানো হয় ছায়া প্রদান করার জন্য।
V. তুষারপাত চা চাষে ক্ষতি করে। অল্প কুয়াশাযুক্ত আবহাওয়া ও আর্দ্রতা চা-এর স্বাদ ও গন্ধকে প্রভাবিত করে থাকে।
অর্থনৈতিক পরিবেশ
I. চা গাছ জমির উর্বরতা শক্তি কমিয়ে দেয়, জমিতে নাইট্রোজেন, জিংক ও পটাশিয়াম সার ব্যবহার করা দরকার হয়।
II. চা এর গুণগত মান শ্রমিকের দক্ষতার উপর নির্ভর করে। বাগান পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ ও চা পাতা তোলার জন্য দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
III. চা গাছের পরিচর্যার জন্য সার, সুলভ শ্রমিক, কীটনাশক প্রভৃতির জন্যে প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন হয়।
IV. চা মূলত বাণিজ্যের জন্য উৎপাদন করা হয়, তাই উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা চা চাষ ও উৎপাদনকে আরও লাভজনক করে তোলে।
V. চা পাতা তোলার পর চা গুঁড়ো, শুকনো ইত্যাদি প্রস্তুতির জন্যে নিকটবর্তী কারখানা, সাথে প্রক্রিয়াকরণের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো দরকার।
ভারতে চা উৎপাদক অঞ্চল
ভারতে চা উৎপাদন মূলত দুটি অঞ্চলে হয়ে থাকে। উত্তর-পূর্ব ভারতে আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রায় 77% চা উৎপাদন হয়। দক্ষিণ ভারতে 21% চা উৎপাদন হয়।
১) আসাম
আসাম ভারতে চা উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করে। আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার ডিব্রুগড়, দরং এবং সুমা উপত্যকা চা চাষের জন্য প্রসিদ্ধ।
২) পশ্চিমবঙ্গ
পশ্চিমবঙ্গ চা উৎপাদনে ভারতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স অঞ্চলে এবং দার্জিলিঙের পার্বত্য অঞ্চলে চা চাষ হয়। দার্জিলিঙের চা গন্ধের জন্যে পৃথিবী বিখ্যাত।
৩) তামিলনাডু
বর্তমানে তামিলনাডু চা উৎপাদনে ভারতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। তামিলনাডুর নীলগিরি ও আনাইমালাই প্রধান চা উৎপাদক অঞ্চল।
খ) কার্পাস
কার্পাস একটি তন্তু জাতীয় ফসল যা প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ফসল, তবে গ্রীষ্ম প্রধান দেশেও এর চাষ হয়ে থাকে। কার্পাস গাছ থেকে আঁশজাতীয় নরম তুলা তৈরি হয়। এই তুলা বস্ত্র তৈরিতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই উৎপন্ন হয়। এই জন্যে কার্পাস গাছ অর্থকরী ফসল হিসেবে ব্যপকভাবে চাষ হয়ে থাকে।
ভারতে কার্পাস উৎপাদন ব্যবস্থা
ভারতের বিভিন্ন অর্থকরী ফসলের মধ্যে কার্পাস অন্যতম।
ব্যবহার –
• কার্পাস থেকে প্রস্তুত হওয়া তুলা নানা ধরণের সুতো থেকে মসৃণ নরম ও নানান ধরণের কাপড় তৈরি হয়।
• তুলা ব্যবহার করে তোশক, জাজিম, বালিশ তৈরি হয়।
কার্পাস উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ
প্রাকৃতিক পরিবেশ
I. কার্পাস চাষের জন্য মাঝারি উষ্ণতা (20° সে থেকে 25° সে) আদর্শ।
II. বছরে 60-100 সেমি বৃষ্টিপাত প্রয়োজন, তবে জলসেচের ব্যবস্থা থাকলে 50 সেমি এর কম বৃষ্টিপাতেও কার্পাস চাষ হতে পারে।
III. কার্পাস গাছ রোপণের পর বছরে অন্তত 200 দিন বরফমুক্ত থাকা আবশ্যক।
IV. আগ্নেয় কৃষ্ণ মৃত্তিকা ও চারনোজেম মৃত্তিকা কার্পাস চাষের জন্যে খুবই উপযোগী। এই জন্যে দক্ষিণ ভারতের লাভা মালভূমিতে এর চাষ হয়ে থাকে। এছাড়াও মাটি চুন ও লবণ সমৃদ্ধ এবন জল ধারণের উপযোগী হওয়া দরকার।
V. গাছের গোড়ায় জল জমলে কার্পাস গাছের ক্ষতি হয়, এজন্য ঢালু, জলনিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত জমিতে কার্পাস চাষ হলে উৎপাদন ভালো হয়ে থাকে।
অর্থনৈতিক পরিবেশ
I. কার্পাস গাছ রোপণ, গাছের পরিচর্যা করা, গুটি বা ফল পাকলে সেগুলি তুলে তা থেকে তুলো ছাড়িয়ে নেওয়া প্রভৃতি কাজে প্রচুর দক্ষ ও সুলভ শ্রমিক দরকার পড়ে।
II. কার্পাস গাছকে বলউইভিল নামক রোগ পোকার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে কীটনাশক প্রয়োগ করা দরকার।
III. কার্পাস গাছ রোপণের ফলে জমির উর্বরতা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, তাই জমিকে উর্বর রাখার জন্যে সার প্রয়োগ করতে হয়।
IV. রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি কিনতে, শ্রমিকের মজুরি এবং উৎপন্ন ফসল সহজে প্রক্রিয়াকরণ করতে কার্পাস চাষে মূলধন দরকার হয়।
V. বাণিজ্যিক ফসল হওয়ার জন্যও কার্পাস জমি এবং রপ্তানি করার বন্দর, অঞ্চল ইত্যাদির মধ্যে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠা প্রয়োজনীয়।
VI. ভারতের নিজস্ব বাজার এবং বিদেশে বস্ত্র এবং নানান ধরণের সুতোর বিপুল চাহিদা থাকায় কার্পাস চাষের পরিবেশকে আরও উন্নত করেছে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
ভারতে কার্পাস উৎপাদক অঞ্চল
১) গুজরাত
কার্পাস উৎপাদনে গুজরাত ভারতে প্রথম স্থানে রয়েছে। এ রাজের সুরাট, বরোদা, আমেদাবাদ ইত্যাদি জালার উর্বর কৃষ্ণ মৃত্তিকায় প্রচুর কার্পাস চাষ হয়।
২) মহারাষ্ট্র
এই রাজ্যের শোলপুর, নাসিক, অমরাবতী, জলগাঁও প্রভৃতি জেলায় কার্পাস চাষ হয়। মহারাষ্ট্র বর্তমানে দ্বিতীয় কার্পাস উৎপাদক রাজ্য।
৩) অন্ধ্রপ্রদেশ
এই রাজ্যের কুরনুল, কুদাপ্পা, আলিদাবাদ ইত্যাদি জেলায় প্রচুর কার্পাস চাষ হয়। উৎপাদনের নিরিখে অন্ধ্রপ্রদেশ ভারতে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
গ) কফি
কফি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি পানীয়। কফি গাছের বীজ গুঁড়ো করে, রোস্ট করে, সেই কফি জলের সাথে ফুটিয়ে উৎকৃষ্ট পানীয় তৈরি করা হয়ে থাকে। সবুজ কফি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত কফি। এছাড়াও গাঢ় বাদামি, হলদে বাদামি, এবং কালো রঙের কফি উৎপাদন করা হয়। বিশ্বের প্রায় 70টি দেশে কফি গাছের চাষ করা হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই মৃদু উত্তেজক পানীয় হিসেবে কফি বিখ্যাত।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
ভারতে কফি উৎপাদন ব্যবস্থা
ভারতে বাণিজ্যিক ও বাগিচা ফসল হিসেবে কফি চাষ করা হয়ে থাকে। মৃদু উত্তেজক পানীয় হিসেবে চা এর পরেই কফির স্থান। কফি সাধারণত ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় জলবায়ুর ফসল।
কফির ব্যবহার
কফি মূলত স্বাদ ও গন্ধযুক্ত চনমনে একটি পানীয়। পৃথিবীর সব দেশেই কফিকে গরম জল বা গরম দুধের সাথে মিশিয়ে পান করা হয়, এছাড়াও কেক এবং কুকিজ তৈরিতে কফি গুঁড়ো ব্যবহার করা হয়।
কফি উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ
প্রাকৃতিক পরিবেশ
I. কফি চাষের জন্য 15° থেকে 30° সে উষ্ণতার প্রয়োজন। তবে সরাসরি সূর্যের আলো কফি গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক, তাই কফি বাগানে বড় বড় ছায়া প্রদানকারী গাছ লাগানো হয়ে থাকে।
II. কফি চাষের জন্যও বছরে 150 – 250 সেমি বৃষ্টিপাত দরকার হয়। তবে ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে কফি ফল পাকার সময় শুষ্ক আবহাওয়া থাকলে ভালো হয়।
III. কফি চাষের জন্য লোহা, নাইট্রোজেন ও পটাশযুক্ত মাটি উপযোগী। দক্ষিণ ভারতের রেগুর মাটিতে কফি চাষ খুব ভালো হয়ে থাকে।
IV. ভালো জলনিকাশি থাকা ঢালু পাহাড়ি জমি কফি চাষের জন্যে আদর্শ। ভারতে বেশিরভাগ কফির বাগিচা 800-1600 মিটারের মধ্যে রয়েছে।
অর্থনৈতিক পরিবেশ
I. কফি চাষ একটি শ্রম নিবিড় কাজ। বাগিচা তৈরি, কফি প্রস্তুত ও প্যাকেট করা, বাজারে পাঠানো সবকিছুতেই প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন হয়।
II. জমি পরিস্কার করা, পরিচর্যা করা, কীটনাশক প্রয়োগ, কফি গাছের ফল তোলা, ভাজা ও গুঁড়ো করা, কফি গুঁড়ো প্যাকেট করা এইসব কাজের জন্যে প্রচুর দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
III. কফি বাণিজ্যিক ফসল হওয়ায় বন্দরে পৌঁছনো এবং দেশের ভিতরে অন্যান্য রাজ্যে পৌঁছনোর জন্যও উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা থাকা একান্ত দরকার।
IV. মৃদু উত্তেজক পানীয় হিসেবে শীতপ্রধান দেশে কফির চাহিদা সর্বাধিক। এছাড়াও ভারতের অভ্যন্তরেও কফির চাহিদা বর্তমানে বেড়েছে।
ভারতে কফি উৎপাদক অঞ্চল
ভারতে প্রায় বেশিরভাগ কফি দক্ষিণ ভারতে তিনটি রাজ্যে ( কর্ণাটক, কেরালা, তামিলনাডু) চাষ করা হয়।
১) কর্ণাটক
শীর্ষ স্থানে থাকা এই রাজ্যের প্রায় 2 লক্ষ হেক্টর জমি কফি চাষে নিযুক্ত। দেশের মোট উৎপাদনের 72% কফি এই রাজ্যে উৎপন্ন হয়।
২) কেরল
দ্বিতীয় স্থানে থাকা এই রাজ্যে 1 লক্ষ হেক্টর জমিতে কফি চাষ হয়। ভারতের মোট উৎপাদনের 20% কফি এই রাজ্যে উৎপন্ন হয়।
৩) তামিলনাডু
ভারতের তৃতীয় কফি উৎপাদক রাজ্য। প্রায় 50,000 হেক্টর জমিতে প্রায় ৬% কফি উৎপাদিত হয়।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতীয় কৃষি ও সবুজ বিপ্লব
লেখিকা পরিচিতি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্রী শ্রীপর্ণা পাল। পড়াশোনার পাশাপাশি, গান গাইতে এবং ভ্রমণে শ্রীপর্ণা সমান উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-geo-6-c