বাংলা – নবম শ্রেণি – নব নব সৃষ্টি (দ্বিতীয়পর্ব)
নব নব সৃষ্টি প্রবন্ধের প্রথম পর্বের আলোচনায় আমরা লেখক পরিচিতি, উৎস এবং বিষয়সংক্ষেপ (প্রথম অংশ) নিয়ে আলোচনা করেছি। আগের পর্বটি পড়া না থাকলে এই লিঙ্ক থেকে পড়ে নেবার অনুরোধ রইল – নব নব সৃষ্টি (প্রথম পর্ব)।
বিষয়সংক্ষেপ (দ্বিতীয় অংশ)
বাংলা ভাষার উৎস সংক্রান্ত আলোচনার পরে প্রাবন্ধিক বাংলা ভাষায় আরবি-ফার্সি শব্দ ঋণ নেওয়ার বহু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। একথা আমাদের মনে রাখতেই হবে যে এককালে ভারতে মোগল শাসনব্যবস্থার প্রচলনের কারণে বহু আরবি-ফার্সি শব্দ শাসনপ্রণালীর ও আইন-কানুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আজও রয়ে গেছে।
দেখে নাও নব নব সৃষ্টি প্রবন্ধের সম্পূর্ণ আলোচনা↓
বাংলা ভাষা সেগুলির আত্তীকরণ করে নিজের মধ্যে গ্রহণ করেছে। ভাষা তো স্থির নয়, তা সতত প্রবহমান। আর সেই প্রবাহে অন্য ভাষার শব্দ এসে পড়লে বাংলা তাকে বর্জন না করে স্বীকার করেছে। এখানে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের উদাহরণ দিয়ে দেখান যে তাঁরাও তাঁদের সাহিত্যে আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।’ বলা ভালো এই উদ্ধৃতিটি রবীন্দ্রনাথের ‘কর্তার ভূত’ ছোটোগল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। এই তথ্যটি মনে রাখা দরকার। আবার নজরুল ‘ইনকিলাব’ বা ‘শহিদ’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন। বিদ্যাসাগর তাঁর বেনামে লেখা রচনায় ব্যবহার করেছেন আরবি-ফার্সি শব্দ।
বিদ্যাসাগরের কথা এলো যখন তখন বলতেই হয় বিদ্যাসাগরের সমগ্র রচনাগুলিকে প্রকরণের ভিত্তিতে চারভাগে ভাগ করা যায় – অনুবাদমূলক, শিশুশিক্ষামূলক, মৌলিক গ্রন্থ এবং প্রস্তাব বিষয়ক। এখন তাঁর লেখাগুলি ভালো করে পড়লে দেখা যাবে যে ঐ প্রস্তাব বিষয়ক লেখাগুলিতে তিনি যত আরবি-ফার্সি শব্দের প্রয়োগ করেছেন তেমনটি অন্যত্র করেননি। তবে এই আরবি-ফার্সির চর্চা এখন আর না হলেও আগের শব্দগুলিই এখনো প্রবাহিত হয়ে চলেছে। একইরকম ভাবে ইংরেজি ভাষার কাছে বাংলাকে ঋণী হতে হয় বিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রে।
পদার্থবিদ্যা, দর্শন, নন্দনশাস্ত্র, রসায়ন এ সমস্ত বিষয়ের চর্চায় ইংরেজি পরিভাষার ব্যবহার আমাদের করতেই হয়। ফলে বিদেশি ভাষা বর্জন করে বাংলা ভাষার মৌলিকত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে বোকামি এবং ভ্রান্ত কাজ। বাঙালি যেমন জাতিতত্ত্বের দিক থেকে একটি সংকর জাতি, তেমনি তাঁর ভাষাও একপ্রকার মিশ্রিত ভাষা। এরপরে প্রাবন্ধিক বাংলার সাহিত্যের রাধা-কৃষ্ণের আখ্যান, বাউল-মুর্শিদি গানের মতো সনাতন ধারার উল্লেখ করে বলতে চাইলেন – ‘ধর্ম বদলালেই জাতির চরিত্র বদলায় না।’ এ কথার গূঢ়ার্থ রয়েছে। বাঙালি জাতির চরিত্রে বিদ্রোহের বীজ রয়েছে এমন কথার মধ্যে আমাদের মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কথা। উর্দূভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে সেদিন বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমান একজোটে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল। হয়তো প্রাবন্ধিক আমাদের সেই ইঙ্গিত দিয়েই বলতে চাইলেন ধর্ম আর ভাষা দুটি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষা অনেক বৃহত্তর বন্ধন।
এই প্রবন্ধেই বেশ কিছু নতুন নাম খুঁজে পাওয়া গেল যেগুলি নিয়ে টীকা করে দিলে তোমাদের রচনাংশটি পড়তে ও বুঝতে সুবিধে হবে তাই নীচে টীকা করে তুলে দেওয়া হল –
আব্রু – ফারসি ভাষায় এর অর্থ হল স্ত্রীজাতির মর্যাদা
ইজ্জত – এটিও ফারসি শব্দ যার অর্থ হল সম্ভ্রম
ইমান – এই ফারসি শব্দের অর্থ হল বিবেকবোধ
ইনকিলাব – ইনকিলাব শব্দের অর্থ হল বিপ্লব। এই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী শহীদ ভগৎ সিং-এর কথা। তিনিই প্রথম ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শব্দবন্ধটি চালু করেন যার অর্থ হল বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।
হরপ্রসাদ – হরপ্রসাদ হলেন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ আবিষ্কার করেন নেপালের রাজদরবার থেকে। এটি পরে তাঁর সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
আলাল – এখানে আলাল বলতে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামের উপন্যাসটিকে বোঝানো হয়েছে। এটি লিখেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের অগ্রদূত বলা যায় এই লেখাটিকে। এই গ্রন্থে ব্যবহৃত বিশেষ কথ্যভাষার নাম – আলালী ভাষা।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
হুতোম – হুতোম হল আসলে ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ নামক রচনা, যা লিখেছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। বলা ভালো কালীপ্রসন্ন সিংহের ছদ্মনামই ছিল হুতোম প্যাঁচা। এই নক্শা গ্রন্থটিতে সেকালের কলকাতার বাবু সমাজকে বিদ্রুপ করা হয়েছে বিশেষ ভাষায়।
প্রেমচন্দ – প্রেমচন্দ বলতে এখানে মুন্সি প্রেমচন্দকে বোঝানো হয়েছে যিনি হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হল – ‘গোদান’। তাঁর আসল নাম ধনপত রায় শ্রীবাস্তব।
শংকর দর্শন – বাঙালি নৈয়ায়িক অর্থাৎ ন্যায়শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ শংকর তর্কবাগীশের যে দর্শনচিন্তা এখানে তার কথাই বলা হয়েছে।
বসুমতী – বাংলা ভাষায় প্রচারিত একটি দৈনিক সংবাদপত্রের নাম – মাসিক বসুমতী। এখানে এই পত্রিকাকেই বোঝানো হয়েছে।
পদাবলি – প্রাচীন বাংলায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক যে পদগুলি রচনা করেছিলেন বাঙালি কবিরা, বৈষ্ণব পদকর্তারা তাকে বলা হত বৈষ্ণব পদাবলি। এখানে পদাবলি বলতে তাকেই বোঝানো হয়েছে। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস প্রমুখ ছিলেন বিখ্যাত পদকর্তা।
কীর্তন – কীর্তি প্রচার করে যে গান তাই হল কীর্তন। রাধা-কৃষ্ণের লীলাবিষয়ক বিশেষ প্রকরণের যে গান তাকেই কীর্তন বলা হয়। কীর্তন আর নামগান প্রায় সমার্থক।
মুরশিদিয়া – সুফি সাধনার অন্যতম অঙ্গ হল এই মুরশিদিয়া সাধন সঙ্গীত। ইসলাম ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা এর প্রাণবস্তু।
টীকা যখন হল, তখন একটু টিপ্পনীও হোক।
এই পাঠ্যাংশে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে বিদেশি শব্দের আগমণ বিষয়েই লেখক মতামত দিয়েছেন, আলোচনা করেছেন। ফলে সেই শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানার্জন আশু প্রয়োজন। প্রবন্ধটির সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের শব্দভাণ্ডার অধ্যায়টি মিলিয়ে পড়লে তা খুবই ভালো হবে। প্রথমে তালিকার মাধ্যমে বিষয়টি দেখে নেওয়া যাক –
এই তালিকায় যে মৌলিক শব্দের কথা আছে তা আসলে সংস্কৃত। এখন সংস্কৃত থেকে যে শব্দগুলি এসেছে তাকে আমরা তিনভাগে ভাগ করেছি। যে সব শব্দ সংস্কৃত থেকে হুবহু একই রূপে বাংলায় এসেছে তাকে তৎসম শব্দ বলা হয় আর যেগুলি সামান্য কিছুটা বিবর্তিত হয়ে গৃহীত হয়েছে তা হল অর্ধ-তৎসম শব্দ। আর যেগুলি বিবর্তনের ফলে একেবারে মূল শব্দ থেকে বদলে গেছে সেগুলিকে বলা হয় তদ্ভব শব্দ। যেমন – গ্রিক শব্দ দ্রাখমে > দম্ম > দাম। তৎসম ও অর্ধতৎসমের উদাহরণ তালিকায় দেখতে পাচ্ছো নিশ্চয়ই। এখন বিদেশি শব্দগুলি কিংবা ভারতীয় অন্য ভাষার শব্দগুলিকে তোমরা ব্যাকরণের বই দেখে খুঁজে পাবে। এটাই তোমাদের এই পাঠ্যাংশের ব্যবহারিক কাজ থাকলো ।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
সারসংক্ষেপ
এত বিস্তারিত আলোচনা থেকে মূলত যে যে দিকগুলি উঠে আসে এই প্রবন্ধ সম্পর্কে তা ক্রমানুসারে অনেকটা এইরকম –
ক) প্রাবন্ধিক বাংলা ভাষার উৎস এবং তার মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন
খ) বাংলা ভাষায় ভারতীয় অন্যান্য ভাষা ও বিদেশি ভাষার শব্দের ব্যবহার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন
গ) এই সব বিদেশি শব্দের ব্যবহার যুক্তিযুক্ত কিনা কিংবা তা বাংলা ভাষার ক্ষতিসাধন করছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন
ঘ) ভাষা সতত প্রবহমান, তাই জোর করে এই বিদেশি শব্দের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া মূর্খামি।
ঙ) ধর্মের সঙ্গে ভাষার চারিত্রিক পার্থক্য রয়েছে। ধর্ম বদলে গেলেও ভাষা বদলায় না।
পাঠ্য ‘নব নব সৃষ্টি’ প্রবন্ধটি আমাদের দেখায় যে ভাষার সজীবতার জন্য চাই নতুন নতুন শব্দ, সেই শব্দ বিদেশি ভাষা থেকে আহরিত হলেও ভাষার মৌলিকত্ব বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত হয় না। বরং ভাষার প্রবাহমানতার নিয়মে এটাই আমাদের মেনে নিয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX_Beng_nobonobosristi_2