বাংলা – দশম শ্রেনি – নদীর বিদ্রোহ (গদ্য)
লেখক পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম হল প্রবোধ কুমার বন্দোপাধ্যায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে অনার্স পড়ার সময় বন্ধুদের সাথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা বিচিত্রায় নিজের লেখা পাঠান। গল্পের নাম ছিল ‘অতসী মামী’, প্রথমবারেই গল্পটি বিচিত্রা পত্রিকায় ছাপা হয় এবং তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গল্পে তিনি লেখক হিসাবে নিজের প্রবোধ নামের বদলে মানিক নাম ব্যবহার করেছিলেন।
‘অতসীমামী’ গল্পের জনপ্রিয়তার ফলে তিনি সাহিত্যচর্চাকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি বিখ্যাত উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্য’ রচনা করেন। পরবর্তীকালে তিনি অসংখ্য গল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘মিহি ও মোটা’, ‘সরীসৃপ’ ইত্যাদি। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত অন্যতম সেরা উপন্যাস।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার মধ্যে প্রগাঢ়ভাবে বাস্তব জীবনের ছবি ফুটে উঠত। বলা চলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বকীয় লেখার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক বিরল ছাপ রেখে গেছেন।
উৎস
বর্তমানে পাঠ্য নদীর বিদ্রোহ গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘সরীসৃপ’ গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
নদীর বিদ্রোহ গল্পের বিষয়বস্তু
একটি ছোট রেলষ্টেশনের স্টেশন মাস্টার নদেরচাঁদ।
নদীর সাথে তাঁর এক অদ্ভুত সম্পর্ক আছে, নদীকে সে ভালোবাসে। নদী যখন বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে ওঠে তখন সে যেমন আনন্দ পায়, আবার সেই নদী যখন অনাবৃষ্টিতে ক্ষীণরূপ ধারণ করে তখন নদেরচাঁদের মন কেঁদে ওঠে। তার দেশে যে ছোট নদী আছে, তাকে ঘিরেই নদেরচাঁদের প্রকৃতি প্রেমের শুরু, দেশের ছোট নদীকে ঘিরেই সে বড় হয়েছে।
নদেরচাঁদ যখন দেশ থেকে দূরে তার কর্মস্থলে এসে একটি বড় নদীর সন্ধান পায়, তখন তার মন আনন্দে ভরে ওঠে। প্রাত্যহিক রেলগাড়ি নিয়ন্ত্রণের কাজ সমাপ্ত করে সে নদীর দর্শনে যায়। এই নদীর উপর আধুনিক ব্রিজ নির্মিত হয়েছে; নিয়মিত রেল চলাচল করে। ঐ ‘ব্রিজের মাঝামাঝি ইট, সুরকি আর সিমেন্টে গাঁথা ধারকস্তম্ভের শেষপ্রান্তে’ বসে নদেরচাঁদ নদীকে দেখে।
দশম শ্রেণির ভৌতবিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
গল্পে যে সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি বর্ষার সময়।
পাঁচদিন অনবরত বৃষ্টি হয়ে সেদিন বিকালের দিকে বর্ষণ থেমেছে। এই পাঁচদিন নদীকে দেখা হয়নি বলে নদেরচাঁদ মানসিকভাবে ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিল। তাই সেদিন সুযোগ এসে যাওয়ায় সে ছেলেমানুষের মতো উৎসুক্য বোধ করতে লাগলো। বিকালের প্যাসেঞ্জার ট্রেন রওনা করিয়ে দিয়ে সে নদীর উদ্দেশ্যে বেরোল।
নদীর কাছে পৌঁছে অবাক হয়ে গেল নদেরচাঁদ। পাঁচদিন আগে সে যখন শেষবারের মতো নদীকে দেখেছিল; তখন তা ছিল ‘বর্ষার জলে পরিপুষ্ট নদী’, সে নদী চঞ্চল হলেও তা যেন ছিল নদীর পরিপূর্ণতার প্রকাশ। কিন্তু আজ নদীর চেহারা অন্যরকম। প্রবলবৃষ্টির ফলে নদী যেন ক্ষেপে উঠেছে, নদীর গাঢ় পঙ্কিল জল যেন বিদ্রোহী হয়ে ছুটে চলেছে।
নদেরচাঁদ তার প্রতিদিনের জায়গায় এসে বসে। তবে সে লক্ষ্য করে যে জল আজ অনেকটাই উপরে উঠে এসেছে, ঠিক যেন হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে। নদী তার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে দেখে তার ভারি আনন্দ হল। তার পকেটে একটি পুরনো চিঠি ছিল, সে নদীতে চিঠিটি ফেলতেই তা যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। নদীর ‘উন্মত্ত জলপ্রবাহকে তার যেন আজ জীবন্ত’ মনে হচ্ছে, নদী যেন জীবন্ত হয়ে নদেরচাঁদের কাজের প্রত্যুত্তর দিচ্ছে।
গত দুইদিন বৃষ্টিপাত চলাকালীন নদেরচাঁদ তার স্ত্রীকে একটি ‘পাঁচপৃষ্ঠাব্যাপী বিরহ-বেদনাপূর্ণ’ চিঠি লিখেছিল। চিঠিটি তার পকেটেই ছিল, সে চিঠিটির একটা একটা করে পাতা ছিঁড়ে দুমড়িয়ে তা সে জলে ফেলতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পরে আবার বৃষ্টি নামলো; এবার যেন বৃষ্টির গতি আরো বেশি। নদেরচাঁদ কিন্তু ব্রিজ থেকে উঠে গেল না, বরং বসে ভিজতে লাগলো। তার মনে হল নদীতে বৃষ্টির জল পড়ে যেন এক মধুর সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে; সে উপভোগ করতে লাগলো। ক্রমে অনেকটা সময় পার হয়ে গেল, সন্ধ্যা নেমে চারপাশ কালো হয়ে গেলো। ব্রিজের উপরদিয়ে একটা ট্রেন আওয়াজ করে চলে যাবার ফলে নদেরচাঁদ সম্বিত ফিরে পেল। এই বার তার ভয় হতে শুরু করলো।
নদীর বিদ্রোহ গল্পের বিস্তারিত আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে↓
অন্ধকারে উন্মত্ত নদীর আর্তনাদ তার মনে ভীতির সঞ্চার করলো।
নদীর জলরাশি ব্রিজের স্তম্ভের অনেকটাই গ্রাস করেছে। হয়তো যে কোনো সময় ব্রিজ ভেঙে পড়তে পারে। নদেরচাঁদ ফিরে যাওয়ার জন্য ব্রিজের লাইন ধরে ষ্টেশনের দিকে ফিরে যেতে শুরু করলো।
তার ভাবুক মন চিন্তার জাল বুনতে শুরু করে। তার মনে হয় যে সে নদীর এই বিদ্রোহের কারণ বুঝতে পেরেছে; নদী ব্রিজটা ভেঙে ফেলতে চায়। সভ্য মানুষ যন্ত্রের সাহায্যে ব্রিজ গড়ে তুলেছে, কিন্তু সভ্যতা ভাবেনি যে এতে নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয়েছে।
কিন্তু নদী যদি আজ ঐ ব্রিজ ভেঙে ফলে, তবুও কি সভ্যতা তাতে থেমে যাবে? হয়তো না, সভ্যতা আবার নতুন করে নদীকে বাঁধবে, তার উপর আবার ব্রিজ তৈরি করবে। নদেরচাঁদ এতদিন ঐ লোহার ব্রিজটার জন্য গর্ব বোধ করতো, কিন্তু আজ তার মনে হয় – ‘কি প্রয়োজন ছিল ব্রিজের’?
আচমকা নদেরচাঁদের ভাবনার সমাপ্তি ঘটে যখন ৭নং ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেন তাকে পিষে দিয়ে স্টেশনের দিকে চলে যায়।
নদীর বিদ্রোহ গল্পের মূলবক্তব্য
প্রকৃতি ও যন্ত্র – সভ্যতা, এই দুটি সত্ত্বার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং একটি মানুষের মনে তার প্রতিফলনের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে এই গল্পে।
আধুনিক সভ্য মানুষ, তার প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে ধ্বংস করে। সে প্রকৃতির সমস্যার কথা ভেবেও দেখে না। কিন্তু মানুষ যখন সভ্যতার জয়গান ভুলে আবার প্রকৃতিকে প্রাধান্য দেয়, তখন সভ্যতা তার সেই ভাবনাকে পিষে দেয়।
নদেরচাঁদ একজন প্রকৃতিপ্রেমী। সে নদী অর্থাৎ প্রকৃতিকে ভালোবাসে।
আবার, একজন সাধারণ মানুষ আধুনিক স্থাপত্য যেমন ব্রিজ নিয়ে গর্ব অনুভব করে। নদেরচাঁদও তার ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু সেই নদেরচাঁদ যখন নদীরূপী প্রকৃতির দুঃখ, আনন্দ, আক্রোশ (যাকে লেখক বিদ্রোহরূপে চিহ্নিত করেছেন) উপলব্ধী করে, আধুনিক সভ্যাতার উপরে প্রকৃতিকে প্রাধান্য দেয়। তখন মানব সভ্যতার ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রেলগাড়ি’ তার ভাবনাকে পিষে মেরে ফেলে।
পর্ব সমাপ্ত। আরো পড়ো → অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান কবিতার আলোচনা
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Ben-Nodir-bidroho