জীবনবিজ্ঞান – দশম শ্রেণি – পরিবেশ দূষণ [Pollution]
অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কলকারখানা স্থাপন, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনাঞ্চল ধ্বংস করা প্রভৃতি মনুষ্য সৃষ্ট কারণের জন্য আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সমগ্র জীবজগতের উপর পড়ছে। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবী জুড়েই পরিবেশ দূষণ একটি বড় সমস্যা এবং তার প্রতিকার করা অবিলম্বে প্রয়োজন। পরিবেশ দূষণ রোধে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বিশেষ প্রয়োজন।
বিজ্ঞানী ওডামের মতে পরিবেশ দূষণের সংজ্ঞা হল, জল, বায়ু, মাটি প্রভৃতির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের ফলে যখন মানবসভ্যতা, সমগ্র প্রাণীজগৎ, শিল্প, এমনকি কোনো সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তাকেই পরিবেশ দূষণ বলে।
দূষণ সৃষ্টিকারী পদার্থকে দূষক (Pollutant) বলা হয়।
দূষণের প্রকারভেদ
দূষণ বিভিন্ন রকমের হতে পারে তবে মূলত বায়ুদূষণ, জলদূষণ, মাটিদূষণ ও শব্দদূষণ এই চারটি দূষণ নিয়েই আলোচনা করা হল।
বায়ুদূষণ কাকে বলে?
প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট কোনো কারণে বাতাসে অবাঞ্ছিত কোনো বস্তুর উপস্থিতির ফলে যদি বায়ুর স্বাভাবিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় এবং বায়ুর ওই অবস্থা যদি জীবজগতের ক্ষতি সাধন করে, তবে সেই অবস্থাকে বায়ুদূষণ বলে।
বায়ুদূষণের কারণ
a) প্রাকৃতিক বায়ুদূষক
দাবানল থেকে কার্বন মনোঅক্সাইড, পচে যাওয়া উদ্ভিদ থেকে মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড, আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ধোঁয়া, ছাই ইত্যাদি।
b) মনুষ্য সৃষ্ট বা অ্যানথ্রোপোজেনিক বায়ুদূষক
কলকারখানা, রান্নার উনুন, যানবাহন ইত্যাদি থেকে নির্গত গ্যাসীয় দূষক ইত্যাদি।
c) গ্রীনহাউস গ্যাস
বায়ুমন্ডলে উপস্থিত কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2), কার্বন মনোক্সাইড (CO), মিথেন (CH4), ওজোন (O3), ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFCs), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) প্রভৃতি গ্যাস তাপের বিকিরণে বাধা দেয়। তার ফলে সূর্য থেকে যে তাপ পৃথিবীতে আসে তার সবটুকু ফিরে যেতে পারে না, তাই জন্য পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এই ঘটনাটিকে গ্রীনহাউস এফেক্ট বলে এবং এই গ্যাসগুলি গ্রীনহাউস গ্যাস নামে পরিচিত।
d) SPM (Suspended Particulate Matter)
বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা, ধোঁয়া, কুয়াশা, জলীয় বাষ্প, ছাই, ফুলের রেণু ইত্যাদি কঠিন কণাজাতীয় পদার্থ যেগুলি বায়ুদূষণ ঘটায় তাদের SPM বলে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
বায়ুদূষণের ফলাফল
বায়ুদূষণের প্রভাব মানুষ তথা সমগ্র জীবজগৎ, বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ সবকিছুর উপর লক্ষ্য করা যায়।
বায়ু দূষণের স্বল্পস্থায়ী প্রভাবের ফলে মাথার যন্ত্রণা, শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অত্যাধিক ভয়ঙ্কর হয়।
অ্যাসিড বৃষ্টি কাকে বলে?
বায়ুদূষণের দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর ফলাফলের মধ্যে অন্যতম হল অ্যাসিড বৃষ্টি বা অম্ল বৃষ্টি। বায়ু দূষণের ফলে সৃষ্ট সালফার ডাই অক্সাইড (SO2), নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2) প্রভৃতি গ্যাস বৃষ্টির জলের সাথে বিক্রিয়া করে সালফিউরিক অ্যাসিড (H2SO4), নাইট্রিক অ্যাসিড (HNO3) প্রভৃতি তৈরি করে এবং ভূপৃষ্ঠে নেমে এসে পরিবেশ ও সমগ্র জীবজগতের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে একে অ্যাসিড বৃষ্টি বলে।
জলদূষণ কাকে বলে?
বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে যখন জলে কোনো ক্ষতিকারক, অবাঞ্ছিত বস্তুর প্রবেশ ঘটে এবং তার ফলে জলের ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের অবক্ষয় ঘটে এবং যা পরিবেশ ও সমগ্র জীবজগতের ক্ষতিসাধন করে, তাকে জলদূষণ বলে।
জলদূষণের কারণ
A) রাসায়নিক দূষক
i) কৃষিক্ষেত্রের বর্জ্য
ii) কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য
B) গৃহস্থলীর বর্জ্য
পুকুরে, নদীর জলে বাসন মাজা, স্নান করা, কাপড় কাঁচা, গৃহপালিত পশুর স্নান করানো ইত্যাদি কারণে জলদূষণ হয়।
C) জীবিত দূষক
জমি বা জলাশয়ের ধারে মলমূত্র ত্যাগ, মৃত পশু পাখির দেহ জলে ফেলা, সঞ্চিত বর্জ্য ইত্যাদি জলাশয়ের জলকে দূষিত করে।
জলদূষণের ফলাফল
জলদূষণের কারণে জলে বিভিন্ন রকম দূষকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তার ফলে জলের pH অধিক অম্ল বা ক্ষারীয় হয়ে ওঠে এবং তখন ওই জল ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। জল দূষণের ফলে জলে ইউট্রিফিকেশন, জৈব বিবর্ধন ইত্যাদি ঘটনা ঘটে থাকে।
ইউট্রোফিকেশন
শহরাঞ্চলের অতিরিক্ত জনবহুল এলাকার যে বর্জ্য মিশ্রিত জল জলাশয়ে মেশে তাতে প্রচুর পরিমাণে খাবারের অবশিষ্টাংশ, সাবান এবং ডিটারজেন্ট থাকে, যার অন্যতম উপাদান হলো ফসফেট জাতীয় যৌগ। এছাড়াও জমিতে প্রয়োগকারী ফসফেট ঘটিত সারও বিভিন্ন কারণে যেমন – বৃষ্টির জলের সাথে এসে জলাশয়ে পড়ে। এই যৌগগুলি জলে অধিক পরিমাণে সঞ্চিত হলে তা জলজ উদ্ভিদকে পুষ্টি যোগায় এবং তাদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তার ফলে জলজ আগাছা ও শৈবালের প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি ঘটে একে অ্যালগ্যাল ব্লুম (Algae বা অলগি অর্থ ‘শ্যাওলা’ আর Bloom বা ব্লুম এর অর্থ হল পরিস্ফুট হওয়া) এবং ফলস্বরূপ জলের গুণগত মান হ্রাস পায়। এই ঘটনাকে ইউট্রোফিকেশন বা অতিপৌষ্টিকতা বলে।
দশম শ্রেণির অন্যান্য বিভাগগুলি পড়ুন –ভৌতবিজ্ঞান | গণিত | জীবনবিজ্ঞান
জলদূষণের ফলে সৃষ্ট রোগ
দূষিত জল পান করলে কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় বা অ্যামিবায়েসিস ইত্যাদি রোগ হতে পারে।
মাটিদূষণ কাকে বলে?
বিভিন্ন রকমের ক্ষতিকারক দূষক অর্থাৎ প্লাস্টিক, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি যখন মাটিতে মিশে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটায় এবং তার ফলে মাটির ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ্য করা যায়, তাকে মাটিদূষণ বলে।
মাটিদূষণের কারণ
i) চাষের জমিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মাটিতে মিশে দূষণ ঘটায়।
ii) মাটিতে থাকা বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ মাটিকে দূষিত করতে পারে। যেমন – নাইট্রেট, সালফেট ইত্যাদি যৌগ ও অজৈব সার। এছাড়াও অনেক সময় রাসায়নিক সারে বেশ কিছু কৃত্রিম যৌগ উপস্থিত থাকে, যেগুলি মাটিতে মিশে দূষণ ঘটায়।
iii) শহরাঞ্চলের গৃহস্থলী বা অন্যত্র উৎপাদিত বর্জ্য, সিউয়েজ, কলকারখানা ও পৌর প্রতিষ্ঠানের আবর্জনা, মলমূত্র ইত্যাদি মাটিতে মিশলে মাটি দূষিত হয়।
মাটিদূষণের ফলাফল
i) কৃষিক্ষেত্রে ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য মাটিতে বিভিন্ন রকমের কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। এতে গাছগুলি পেস্টের হাত থেকে রক্ষা পেলেও এই কীটনাশকগুলি খাদ্যের মাধ্যমে মানুষ এবং গৃহপালিত পশুর দেহে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন রকম রোগের সৃষ্টি করে।
ii) প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত বিভিন্ন দ্রব্য মাটিতে দীর্ঘদিন অক্ষত অবস্থায় থেকে যায়। তার ফলে অনেক সময় গবাদিপশুরা তাদের খাদ্যের সাথে এগুলি ভক্ষণ করে, যা তাদের শরীরের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক।
মাটিদূষণের ফলে সৃষ্ট রোগ
মাটিদূষকগুলি সরাসরি মাটিতে মেশার ফলে বা জীবাণু দ্বারা বাহিত হয়ে মানবদেহে প্রবেশ করলে তার থেকে নানা রকমের রোগের সৃষ্টি হতে পারে। যেমন – টিটেনাস, অ্যাসপারজিলোসিস ও কৃমিঘটিত রোগ ইত্যাদি।
শব্দদূষণ কাকে বলে?
মাত্রাতিরিক্ত শব্দ যখন আমাদের পরিবেশ এবং মানবদেহের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে, তখন তাকে শব্দদূষণ বলে। শব্দদূষণ পরিমাপের একক হল ডেসিবেল (dB)।
শব্দদূষণের কারণ
i) বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক কারণে শব্দ দূষণ ঘটতে পারে যেমন – বাজ পড়া, ধ্বস নামা ইত্যাদি।
ii) বিভিন্ন মনুষ্যসৃষ্ট কারণ অর্থাৎ যানবাহনের হর্নের তীব্র আওয়াজ, আকাশে বিমান ওড়ার শব্দ, বিভিন্ন শিল্প কারখানায় যন্ত্রের আওয়াজ, মাইক, মানুষের কোলাহল ইত্যাদি শব্দদূষণ ঘটায়। আমাদের ভারতবর্ষে যানবাহন থেকে সৃষ্ট শব্দের সর্বাধিক মাত্রা 70dB এবং শিল্প-কারখানায় 8 ঘন্টায় গড়ে সর্বাধিক সহনসীমা 90dB বলে নির্ধারিত হয়।
iii) বর্তমানে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, উৎসব-অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত মাত্রায় শব্দবাজি ফাটানো হয়, যা শব্দদূষণের একটি অন্যতম কারণ।
শব্দদূষণের ফলাফল
i) অনেকক্ষণ ধরে অতিরিক্ত শব্দ বিরক্তি সৃষ্টি করে। হঠাৎ কোনো তীব্র শব্দের কারণে আমাদের মনসংযোগ নষ্ট হতে পারে।
ii) অতিরিক্ত জোরালো শব্দের ফলে কানের পর্দার সাময়িক ক্ষতি ও বধিরতা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও শব্দদূষণের ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়।
শব্দদূষণের ফলে সৃষ্ট রোগ
ক) মানুষের ওপর প্রভাব
দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত শব্দ যুক্ত স্থানে বসবাস করলে তাদের অন্তঃকর্ণের অর্গান অফ কর্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার ফলে শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
খ) অন্যান্য প্রাণীর ওপর প্রভাব
মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীরা জোর শব্দ সহ্য করতে পারে না। শব্দের আওয়াজ প্রাণীদের বিরক্তির কারণ হয়, এরা ভয় পায় এবং অন্যরকম আচরণ করে।
অধ্যায় সমাপ্ত! পরবর্তী পর্ব → পরিবেশ ও মানব জনসমষ্টি
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Lsc-5b