sirajdullah by Sachindra nath sengupta
Madhyamik

সিরাজদ্দৌলা শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত । প্রথম পর্ব

বাংলা দশম শ্রেনি – সিরাজদ্দৌলা (নাটাংশ্য) – প্রথম পর্ব

দশম শ্রেণির পাঠ্য শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটাংশ্যটি তিনটি পর্বে আলোচিত হবে। এই লেখাটি প্রথম পর্ব। এই পর্বে উক্ত নাটাংশ্যটির প্রথম অংশ থেকে মঁসিয়ে লা-র প্রস্থান অবধি আলোচিত হয়েছে।

লেখক পরিচিতি

শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত একজন জনপ্রিয় নাট্যকার। তার প্রধান পেশা সাংবাদিকতা হলেও তাঁর বর্ণময় জীবনে তিনি অনেক পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী ছাত্র জীবনে তাঁর সহপাঠী ছিলেন। এরপরে তিনি স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন, এর কিছুকাল পরে পুনরায় বিএ পাশ করেন এবং চিকিৎসাবিদ্যা শেখেন।

jump magazine smart note book

কর্মজীবনের শুরুতে কিছুদিন অধ্যাপনা করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি সাংবাদিকতাকেই নিজের পেশা হিসাবে বেছে নেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে নাটকগুলি বিশেষভাবে দর্শক – পাঠককুলের মনযোগ আকর্ষণ করে। সিরাজদ্দৌলা ছাড়াও, গৈরিক পতাকা, দেশের দাবি, রাষ্ট্রবিপ্লব ইত্যাদি নাটক বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়। নাটক ছাড়াও তিনি লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, অনুবাদিত গল্প ও ভ্রমণ কাহিনী।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

উৎস

বর্তমান আলোচ্য নাটাংশ্যটি ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকের দ্বিতীয় অংকের প্রথম দৃশ্য থেকে নেওয়া হয়েছে।

পটভূমি

সিরাজ যখন নবাবী লাভ করেন তখন বাংলা জুড়ে অরাজকতা চলছে।

নবাব আলীবর্দী খান ছিলেন সুযোগ্য এবং দূরদর্শী নেতা, তাঁর মৃত্যুর পরে সিরাজের রাজ্যাভিষেক নবাব পরিবারের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দের সৃষ্টি করে। তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। আবার মান্যগণ্য মানুষদের প্রতি সিরাজের ব্যবহারও শীর্ষস্থানীয় সমাজের কাছে তাঁকে অপ্রিয় করে তোলে এবং এদের অধিকাংশই নবাব পরিবারের ষড়যন্ত্রে সামিল হয়।

Portrait_of_Allahwerdi_Khan
নবাব আলীবর্দী খান [চিত্র সৌজন্য – Wkipedia]

বাংলা ছিল তৎকালীন সময়ে অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি রাজ্য।

ইংরেজ ও ফ্রান্সের বণিকদল ভারতবর্ষে বাণিজ্য করার আছিলায় প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে ভারতকে তাদের উপনিবেশ হিসাবে দখল করার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। এদিকে বাংলায় নবাব পরিবারের টালমাটাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা নিজেদের শক্তিশালী করে তুলতে থাকে। প্রসঙ্গত ফরাসী এবং ইংরেজরা ছিল একে অপরের শত্রু, ইউরোপে ও  আমেরিকায় তারা যেমন একে অপরের সাথে লড়াই করতো ঠিক তেমনই ভারতেও তারা সুযোগ পেলেই একে অপরকে পর্যদুস্ত করতো। বাংলায় ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি ছিল কলিকাতা বা ক্যালকাটা এবং ফরাসীদের প্রধান ঘাঁটি ছিল চন্দনগর।  

jump magazine smart note book

ইংরেজ বণিকদল কলকাতায় তাদের শক্তিবৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কলকাতায় তাঁদের দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণ করেছিল এবং তারা এই দুর্গের পাশে বিশাল প্রাচীর নির্মাণ করে। বালাই বাহুল্য কলিকাতায় ইংরেজদের একাধিপত্য সিরাজ ভালো – ভাবে নেননি। কিন্তু, ইংরেজদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলার মসনদ দখল, তাই তারা নানাভাবে নবাবের সঙ্গে  অসহযোগিতা করতে শুরু করেন। যেমন নবাব দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার আদেশ দিলেও তারা তা পালন করতে অস্বীকার করে।

ফোর্ট উইলিয়াম
ফোর্ট উইলিয়াম

এদিকে ব্রিটিশদের ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি এবং ফরাসী বণিকদের ক্রমাগত ইন্ধনের ফলে সিরাজ ১৭৫৬ সালের জুন মাসে ‘কলিকাতা’ আক্রমণ করেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করেন।

এই সময় তিনি কলিকাতার নাম পরিবর্তন করে তাঁর স্বর্গীয় দাদুর নাম অনুসরণ করে নাম রাখেন আলিনগর। কলিকাতা থেকে সিরাজ ফিরে এলে, ব্রিটিশরা তাঁদের দুর্গ পুনঃদখল করে।

jump magazine smart note book

কিন্তু এই আক্রমণের ফলে ব্রিটিশদের সঙ্গে নবাবের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং ভীত সিরাজ ‘আলিনগরের সন্ধি’ সাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই চুক্তির ফলে বাংলায় ব্রিটিশদের শক্তিবৃদ্ধি হয় এবং ফরাসীদের শক্তিক্ষয় হয়। ব্রিটিশরা সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার লক্ষ্যে গোপনে সিরাজের প্রধান সেনাপতি – মীরজাফর এবং অমাত্যদের সঙ্গে হাত মেলায়, এর ফলে আত্মবিশ্বাসী ব্রিটিশরা সিরাজের সকল আদেশ অমান্য করতে শুরু করে এবং বাংলায় যুদ্ধের ন্যায় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।


[আরো পড়ুন – The passing Away of Bapu| অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান কবিতার সারাংশ

প্রধান চরিত্রগুলির পরিচয়

সিরাজদ্দৌলা

নবাব সিরাজদ্দৌলা ছিলেন বাংলা – বিহার – উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধের পরে সিরাজের মৃত্যু হয় এবং বাংলা কার্যত ব্রিটিশদের দখলে চলে আসে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে সিরাজ তাঁর দাদু নবাব আলীবর্দী খান-এর কাছ থেকে নবাবী লাভ করেন। এই নাট্যাংশের প্রধান চরিত্র হলেন সিরাজদ্দৌল্লা।

ওয়াটস

ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠির প্রধান ছিলেন ওয়াটস্‌ সাহেব। তিনি ছিলেন সিরাজের ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে ব্রিটিশদের যোগাযোগের মাধ্যম। ব্রিটিশরা নবাবকে উৎখাত করে, তাঁদের সুবিধার পাত্রকে নবাব নির্বাচনের দায়িত্ব ওয়াটস্‌কে দেন। ‘আলিনগরের চুক্তি’ সম্পন্ন হবার পরে, সিরাজ ওয়াটস্‌কে তাঁর দরবারে স্থান দেন। সিরাজের পক্ষ থেকে ব্রিটিশদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন এই ওয়াটস্‌।

মঁসিয়ে লা

ফরাসীদের দূত ছিলেন মঁসিয়ে লা। তার আত্মজীবনী থেকে তৎকালীন সময়ের অনেক তথ্য জানা যায়।

এই ভিডিও থেকে শুনুন সিরাজদ্দৌলা নাট্যাংশের প্রথম পর্বের আলোচনা। ↓

বিষয় সংক্ষেপ

[এই পর্বে নাট্যাংশের শুরু থেকে মঁসিয়ে লা-র প্রস্থান অবধি আলোচনা করা হয়েছে]

বাংলা এক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। নাট্যাংশের শুরুতে আমরা জানতে পারি যে সিরাজ দরবারে তাঁর সিংহাসনে উপবিষ্ট আছেন। সভায় অন্যান্য কর্মচারী ছাড়াও উপস্থিত আছেন, মীরজাফর, মীরমদন, মোহনলাল, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধি ওয়াটস্‌ এবং ফরাসী দূত মঁসিয়ে লা।

সিরাজ ব্রিটিশ প্রতিনিধি ওয়াটস্‌কে অভিযোগ করছেন যে ব্রিটিশরা ‘আলিনগরের সন্ধি’ অমান্য করছে। সিরাজ শুধুমাত্র শান্তি রক্ষার তাগিদে ব্রিটিশদের সাথে সু-সম্পর্ক রেখেছেন কিন্তু ব্রিটিশদের ‘অত্যাচার’ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এই মর্মে সিরাজ ওয়াটস (নবাবের সভায় ব্রিটিশদের প্রতিনিধি) ও গোটা সভাকে একটি পত্র দেখান যা ব্রিটিশ এডমিরাল (জলবাহিনীর প্রধান) ওয়াটসন সিরাজকে লিখেছেন।

ওয়াটসন জানিয়েছেন যে ব্রিটিশ সেনাপ্রধান ক্লাইভ যে সৈন্য পাঠিয়েছেন, তা শীঘ্রই কলিকাতায় পৌঁছাবে এছাড়া বিপুল সংখ্যক যুদ্ধ জাহাজের কথাও তিনি জানিয়েছেন। শেষে তিনি সিরাজকে হুমকি দিয়েছেন যে ‘ব্রিটিশরা বাংলায় এমন আগুন জ্বালাবে যে তা গঙ্গার জল দ্বারাও নেভানো সম্ভব হবে না’। প্রসঙ্গত তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ নৌ-বাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল, তাদের সমকক্ষ কোন দেশ বিশ্বে ছিল না।

ওয়াটসনের এই হুমকির কারণ বুঝতে না পারার ভান করলে, সিরাজ ওয়াটস-কে একটি পত্র দেখান যাতে ওয়াটস্‌ লিখেছেন ‘নবাবের উপর নির্ভর করা অসম্ভব। চন্দননগর আক্রমণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ’। প্রসঙ্গত চন্দননগর ছিল বাংলায় ফরাসীদের প্রধান ঘাঁটি। আলিনগরের সন্ধির পরবর্তি সময় থেকে ব্রিটিশরা শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে, বাংলায় ব্রিটিশদের একাধিপত্য নিশ্চিত করতে তাই তারা নানা ভাবে ফরাসীদের দমন করতে শুরু করে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

সিরাজের সভাসদ ওয়াটসের অদ্ভুদ আচরণে আশ্চর্য সিরাজ তাঁকে এই দ্বিচারিতার কারণ জানতে চাইলে ওয়াটস জানায় যে সে শুধুমাত্র তাঁর দায়িত্ব (ব্রিটিশদের তরফে ওয়াটসকে নবাব উৎখাতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল) পালন করছে এবং সিরাজ তাকে কোনরূপ শাস্তি দিতে চাইলে তা তিনি দিতে পারেন। এর পর সিরাজ ওয়াটসকে তাঁর দরবার থেকে বহিষ্কার করেন।

এর পরবর্তী সময়ে ফরাসী প্রতিনিধি মঁসিয়ে লা-র সাথে তার কথোপকথন হয় এবং মঁসিয়ে লা-কে তিনি জানান যে ফরাসীদের কাছে তিনি লজ্জিত। কারণ ইংরেজরা নবাবের কথা না শুনলেও, ফরাসীরা নবাবের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। ইংরেজরা নবাবের সম্মতি ছাড়াই ফরাসী ঘাঁটি চন্দননগর অধিকার করেছে তাই ফরাসীরা নবাবের কাছে এর সুবিচার চেয়েছেন। নবাব এও জানান যে ফরাসীদের সাথে ইংরেজদের বিবাদ সর্বজন বিদিত, তারা শুধু ভারতের বুকেই নয়  ইউরোপেও লড়াই করে।

jump magazine smart note book

সিরাজ আরো জানান যে তাঁর মন্ত্রীরা ফরাসী – ইংরেজদের নিজেদের বিবাদকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সম্মত নয়, এছাড়া পূর্ণিয়ার যুদ্ধে (শওকত জঙ্গ-কে হত্যা করে বিহার অধিগ্রহন) ও কলিকাতার যুদ্ধে (ফোর্ট উইলিয়াম জয়) সিরাজের প্রচুর অর্থ ও লোকবল ক্ষয় হয়েছে তাই এই মুহূর্তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘চন্দননগর অধিগ্রহন’ নিয়ে বিবাদ করা তাঁর পক্ষে অসুবিধাজনক। তাই সিরাজ ফরাসীদের শান্ত হয়ে থাকার অনুরোধ করেন।


আরো পড়ো → পথের দাবী গল্পের বিশদে আলোচনা

এর পরিপ্রেক্ষিতে মঁসিয়ে লা – সিরাজের অক্ষমতার কথা জেনেও তাঁর প্রতি ফরাসীদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি নবাবকে জানান যে এর ফলে ফরাসীদের বাংলা ত্যাগ করতে হবে এবং এর ফলে ইংরেজরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে; যা নবাবের সাম্রাজ্যকে গ্রাস করে নিতে পারে।

নবাব মঁসিয়ে লা-র কথার সম্মতি জানিয়ে বন্ধু হিসাবে তাঁকে ভবিষ্যতে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে দরবার থেকে বিদায় দেন।  

প্রথম পর্ব সমাপ্ত। দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এই লিঙ্ক থেকে।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X_Ben_Siraj_1