bharater-bhasa-poribar-bangla-bhasa-2
Class-11

ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা – দ্বিতীয় পর্ব

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা (দ্বিতীয় অধ্যায়)


এর আগে ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা- প্রথম পর্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, এই পর্বে আমরা ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা- দ্বিতীয় পর্বটি আলোচনা করে নেব।

ভালো আছো তো বন্ধুরা? আগের ক্লাসে নিশ্চয়ই ভারতের ভাষা পরিবার সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পেয়েই গিয়েছো তোমরা। জেনে গিয়েছো যে ভারতে মোট চারটি ভাষাবংশ রয়েছে, এমনকি তার মধ্যে তিনটি ভাষাবংশ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনাও হয়ে গিয়েছে। আজ শেষের পালা। আজকের আলোচনা একটু দীর্ঘ হবে। তাই একটু ধৈর্য ধরে আলোচনাটা শুনতে হবে। একঘেঁয়ে লাগবে না আশা করি।

আগের দিনের ক্লাসে ভারতীয় আর্য ভাষার ব্যাপারে খুব সামান্য একটু তথ্য দিয়েছিলাম মনে আছে নিশ্চয়। সেখান থেকেই নাহয় শুরু করা যাক। এই ভাষার যাত্রাপথ যে কত রোমাঞ্চকর হতে পারে তা ভাবলে তোমরাও শিহরিত হয়ে উঠবে। মোটামুটিভাবে পঞ্চদশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে এসেছিল আর্যরা, ঐতিহাসিকরা তাই বলেন।

প্রথমে কোথায় এসেছিল জানো? মানে কোথায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল প্রথম জানো কি? সেটা হল ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল, মানে এখন যেখানে কাবুল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশ রয়েছে। ঐ অঞ্চলেই কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল মনে পড়ছে?
এখন সিন্ধু সভ্যতা কাদের সভ্যতা ছিল?

এই আর্যদের সভ্যতা। ফলে সিন্ধু সভ্যতার ভাষা বলতে আসলে এই আর্যদের ভাষাকেই বোঝায় কিন্তু বন্ধুরা। নীচের ছবিটা দেখলেই বুঝবে বন্ধুরা কীভাবে মাইলের পর মাইল পথ পেরিয়ে আর্যরা চলে এসেছিল এই ভারতে। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীর থেকে পশুপালনের জন্য খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নতুন নতুন আবাদি জমির খোঁজে সেদিন আর্যদের একটা দল বেরিয়ে পড়েছিল অজানার সন্ধানে। তারপর হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে ইরানীয় মালভূমিকে পাশ কাটিয়ে বহু দুর্গম উপত্যকার মধ্য দিয়ে তারা এসে উঠেছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। আর্যদের প্রধান জীবিকা ছিল পশুপালন, তারা আসলেই ছিল যাযাবর সম্প্রদায়।

এখন এই ছবিতেই তোমরা দেখতে পাচ্ছো যে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে কীভাবে সমগ্র ভারতে বিস্তৃত হয়েছিল আর্য সংস্কৃতি এবং যথারীতি যেখানে যেখানে তারা বসতি স্থাপন করেছে সেখানেই ছড়িয়ে পড়েছে তাঁদের ভাষা। তবে যে নির্দেশ রেখাটি একেবারে দক্ষিণ ভারতে প্রবেশ করতে দেখা যাচ্ছে, সেটি ঘটেছিল অনেক অনেক পরে। কারণ আগেই বলেছি মূর্তিমান বিন্ধ্য পর্বত পেরিয়ে ঐপারে যাওয়া আর্যদের পক্ষে সম্ভব হয়নি সেই সময়।

এখন তোমরা এও নিশ্চয়ই শুনে থাকবে যে ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন হল ঋগ্বেদ।

দেবতার বন্দনা-গান হিসেবে এই ঋগ্বেদ লিখিত হয়েছিল। বেদের ভাষাকেই প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার নিদর্শন বলে ধরা হয়। এই দেখো একেবারে টেকনিক্যাল কথায় ঢুকে পড়লাম। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা – সেটা আবার কি বস্তু! খায় না মাথায় দেয় তা তো জানো না। আরে চিন্তা করছো কেন? জানতে পারবে এক্ষুনি।

দেখো বন্ধুরা চার প্রকার বেদের নাম আমরা জানি – ঋক্‌, সাম্‌, যজুঃ আর অথর্ব।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

এর মধ্যে সবার আগে লেখা হয়েছিল ঋগ্বেদ আর এটাকেই ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীনতম দৃষ্টান্ত বলা হচ্ছে। ঠিক যেভাবে কিছু সময়ের ব্যবধানে চারটি বেদ লেখা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে ভারতে যে আর্য ভাষার শাখাটি প্রবেশ করেছিল তার বিবর্তনের পথেও তিনটি স্পষ্ট স্তর বিভাজন লক্ষ্য করা যায়। দেখে নিই একবার ভাগগুলো –

• প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা
• মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা
• নব্য ভারতীয় আর্যভাষা

আগে একটা সামগ্রিক রেখাচিত্র তোমাদের সামনে উপস্থাপন করছি। সেটা দেখলে এক ঝলকেই তোমরা পুরো বিষয়টা বুঝতে পারবে। তারপর একে একে আমরা ভাষাগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। নীচের তালিকাটি খেয়াল করো। দেখতেই পাচ্ছো প্রতিটি বিভাগের নির্দিষ্ট সময়কাল লেখা রয়েছে। সময়কালটার দিকে ভালো করে তাকাও। এখানে যা সাল লেখা হবে, তা সবই কিন্তু খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এ প্রসঙ্গে তোমাদের মনের মধ্যে থাকা জটিলতা একটু সরল করে দিই।

খ্রিস্টের জন্মের আগের সময়কে আমরা খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলি আর খ্রিস্টের জন্মের পরের সময়কে বলা হয় খ্রিস্টাব্দ।

এখন এই দুই সময়ের হিসেব হয় একে অপরের উলটো। কিরকম যেমন খ্রিস্টপূর্বাব্দের ক্ষেত্রে সময় যত এগোয় সালের হিসেবটা নিম্নক্রমানুসারে এগোতে থাকে, অর্থাৎ যত প্রাচীন তত বেশি সংখ্যা আর যত নতুন তত কম সংখ্যা। আর খ্রিস্টাব্দের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা উলটো। এক্ষেত্রে সময় যত এগোয়, সালের সংখ্যাটাও বাড়তে থাকে।

এইটুকু শোনার পর সোজা ছবিটার দিকে মন দিয়ে দেখো, সালগুলোর দিকে দেখো ভালো করে। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে ৯০০ খ্রি. পর্যন্ত সময় এগিয়েছে, আর সেই সঙ্গে ভারতীয় আর্যভাষার বিবর্তনও হয়েছে। ফলে খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে এই খ্রিস্টপূর্বাব্দ গুলিয়ে ফেলো না কিন্তু বন্ধুরা। চলো এবারে এক এক করে বিস্তারিত জেনে নিই।

• প্রাচীন ভারতীয় আর্য

ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর একটি শাখা যখন প্রথম ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে প্রবেশ করে, সেই ভাষাকেই প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা বলে চিহ্নিত করেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। এই ভাষার প্রাচীনতম ও প্রথম নিদর্শন হল ঋগ্বেদের বৈদিক ভাষা।

এখন এই বৈদিক ভাষাও আবার দুভাগে বিভক্ত বন্ধুরা –
১) কথ্য বৈদিক ভাষা
২) লেখ্য বৈদিক ভাষা

এখন এই কথ্য বৈদিক ভাষার অঞ্চলগতভাবে চারটি রূপভেদ ছিল বলে দাবি করেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা।

এই রূপভেদগুলি হল – প্রাচ্য, উদীচ্য, মধ্যদেশীয় ও দাক্ষিণাত্য।

উপরের ছবিতে ভালো করে তালিকা করে দেওয়া আছে তোমরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো বন্ধুরা। এ প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি। বৈদিক ভাষা আর সংস্কৃত ভাষা কিন্তু এক নয় বন্ধুরা। শুনে অবাক হচ্ছো তো? হ্যাঁ এটা সত্যি যে বেদ যে ভাষায় লেখা হয়েছে সেই ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার অনেক অমিল রয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে প্রাচীন বৈয়াকরণ পাণিনি তাঁর ‘অষ্টাধ্যায়ী’ গ্রন্থ রচনা করেন আর এই বইটিই সংস্কৃত ভাষার আদি নিদর্শনের সাক্ষ্য বহন করে।

এই বইয়ে পাণিনির মূল উদ্দেশ্যই ছিল বৈদিক ভাষার জটিলতা দূর করে তাকে ব্যাকরণ-বিধিতে বেঁধে ফেলে লোক-ব্যবহার্য একটি ভাষারূপ গড়ে তোলা। কালিদাস, ভবভূতি, অশ্ব ঘোষ, বিশাখদত্ত, শূদ্রক, বাণভট্ট প্রমুখ বিখ্যাত সব প্রাচীন কবিরা এই সংস্কৃত ভাষাতেই তাঁদের বিখ্যাত সব সাহিত্যগুলি রচনা করেছেন। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার অন্তর্গত বৈদিক ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার মূল পার্থক্য ধ্বনিগত। বৈদিক ভাষায় উচ্চারণের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, যা সংস্কৃতে নেই। তাই ভাষাবিজ্ঞানে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা বলতে সংস্কৃত ভাষাকেই বুঝবো।

এখন প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলো এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক বন্ধুরা –
• বৈদিক ভাষার থেকে এই ভাষার স্বরধ্বনির সংখ্যা কম।
• যুক্তব্যঞ্জন প্রভূত ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই ভাষায়।
• শব্দরূপ ও সমাসের প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।
• বাক্যে পদ সাজানোর বিশেষ কোনো নিয়ম-রীতি ছিল না।
• সবশেষে বলতে হয়, প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ছন্দপদ্ধতি ছিল অক্ষরমূলক।

এই ভাষাই বিবর্তিত হয়ে ক্রমে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার রূপ নেয়। তবে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার বিষয়টা একটু জটিল। দেখো বন্ধুরা, প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার সময়কাল আমরা আগেই বলেছি ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিন্তু মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার বিস্তৃতি সেই ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এখানেই গুলিয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।

মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার ক্ষেত্রে খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে খ্রিস্টাব্দে এসে শেষ হয়েছে। এতটাই বিশাল এই ভাষার ব্যাপ্তি এবং বিবর্তনের সময়পর্ব। এখন এই মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার মূলত তিনটি স্তর লক্ষ্য করেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা – আদি, মধ্য ও অন্ত্য। তোমাদের বোঝার সুবিধের জন্য নীচে তালিকার মধ্য দিয়ে এই স্তরগুলির সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি দেখে নেওয়া যাক –

বন্ধুরা প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ক্ষেত্রে যে বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষর কথা বলেছিলাম, তা সেই ভাষা ছিল মূলত লেখ্য ভাষা। মানুষ মুখে কথা বলার জন্য সেই সংস্কৃত ভাষা কিন্তু ব্যবহার করতো না। এখন সেই সময়কার মানুষের মুখের ভাষা বদলাতে শুরু করে। আর তার ফলেই সংস্কৃত থেকে জন্ম হয় প্রাকৃত ভাষার। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাই পাওয়া যায় অশোকের শিলালিপিতে বা অনুশাসনে। অন্যদিকে বৌদ্ধ হীনযানদের যে ধর্মগ্রন্থগুলি রয়েছে সেগুলি যে পালি ভাষায় লেখা হয়েছে, তাও কিন্তু এই আদি মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার অন্তর্গত। তবে এই পালি ভাষা মূলত ছিল সাহিত্যিক ভাষা।

বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক লেখা হয়েছে এই ভাষাতেই।

তাছাড়া বুদ্ধের জীবনকাহিনি অবলম্বনে রচিত জাতকের গল্পগুলিও পালি ভাষায় লেখা হয়েছে। ফলে সহজ করে বললে পালি এবং প্রাকৃত ভাষা একত্রে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার নিদর্শনের মধ্যে পড়ে। একটা জিনিস তোমাদের মাথায় রাখতে হবে বন্ধুরা,এই সময়টা কিন্তু একটা সন্ধিক্ষণ যে সময় ভাষা পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলিও বদলাতে থাকবে। বৈদিক ভাষা যেমন ধীরে ধীরে কথ্য বৈদিক এবং তা থেকে পাণিনির হাত ধরে কথ্য সংস্কৃত ভাষার জন্ম হয়, ঠিক সেভাবেই এই সংস্কৃত ভাষাও আরো বিবর্তিত হতে শুরু করে। এই বিবর্তনের প্রথম ধাপ হল পালি ও প্রাকৃত ভাষার জন্ম। এটুকু আশা করি বুঝে গেছো বন্ধুরা।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

এরপর তাহলে আমরা পরের ধাপে যাই। এই প্রাকৃত ভাষাও বিবর্তিত হতে শুরু করে। এই বিবর্তনেরও আবার তিনটে ধাপ। চলো দেখে নিই। একেবারে প্রথমে অঞ্চলভেদে প্রাকৃত ভাষায় চারটি বিভাগ বা শাখা সৃষ্টি হয় –
১) উত্তর-পশ্চিমা
২) দক্ষিণ-পশ্চিমা
৩) প্রাচ্যা-মধ্যা
৪) প্রাচ্যা
এরপরে এল দ্বিতীয় ধাপের বিবর্তন। এই ধাপে আবার এই চারটি শাখা থেকে পাঁচটি সাহিত্যিক প্রাকৃত ভাষার জন্ম হয়।

নীচের তালিকাটা দেখো বন্ধুরা –
পৈশাচী, শৌরসেনী ও মহারাষ্ট্রী, অর্ধ-মাগধী এবং মাগধী এই পাঁচটি সাহিত্যিক প্রাকৃত ভাষার নাম তোমাদের কিন্তু মনে রাখতে হবে বন্ধুরা।

তবে এদের মধ্যে মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতকেই আদর্শ বলে মানা হত। তোমরা যদি সংস্কৃত নাটক পড়ো, তাহলে নাটকের সংলাপগুলি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝতে পারবে যে সেখানে স্পষ্টভাবে রাজা, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি চরিত্রের সংলাপের ভাষা হত সংস্কৃত, এছাড়া সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা হত মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত। আবার সেই সংস্কৃত নাটকেই শিক্ষিত নারী কিংবা রাজপুরুষের মুখের সংলাপে দেখা যেত শৌরসেনী প্রাকৃত ভাষার নিদর্শন। জৈন ধর্মের সমস্ত প্রকার ধর্মীয় সাহিত্যগুলি রচিত হয়েছে অর্ধ-মাগধী প্রাকৃত ভাষায়। এই জাতীয় ভাষার বিভাগের নিদর্শনগুলি তালিকার মধ্য দিয়ে তোমরা মনে রাখার চেষ্টা করবে। এখন বিবর্তনের তৃতীয় ধাপ হাজির। এই ধাপে এই পাঁচটি সাহিত্যিক প্রাকৃত থেকে জন্ম হল পাঁচটি আলাদা আলাদা অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠের। নীচে তালিকাটি আরেকবার দেখে নাও বন্ধুরা।

বন্ধুরা এই অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠগুলি থেকেই কিন্তু পরবর্তীকালে নব্য ভারতীয় আর্যভাষার সৃষ্টি হয়েছে। বলা যেতে পারে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলি সৃষ্টির আগে প্রাকৃত ভাষা থেকে বিবর্তনের মধ্যে এই অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ একপ্রকার সেতুর মতো। এই পৈশাচী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ থেকে সৃষ্টি হয়েছে মূলত পূর্বী পাঞ্জাবি,পশ্চিমা পাঞ্জাবিআর সিন্ধ্রি ভাষা। ভারতের পাঞ্জাবি শিখদের ভাষা এই পূর্বী পাঞ্জাবি আর তাদের লিপিকে বলা হয় গুরুমুখি। অন্যদিকে সিন্ধ্রি ভাষার লিপির সঙ্গে হিন্দির দেবনাগরী লিপির খানিক সাদৃশ্য রয়েছে। মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ থেকে মারাঠি আর কোঙ্কণি ভাষার জন্ম হয়েছে। মারাঠি ভাষা তো এখন মহারাষ্ট্রের প্রধান ভাষা।

শেষে বলা যায় অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ থেকে যে তিনটি ভাষা তৈরি হয়েছে তা মূলত পূর্বী হিন্দি নামে পরিচিত।

অবধি বা আওধি, ছত্তিশগড়ি আর বাঘেলি এই তিনটি ভাষা অর্ধমাগধী থেকে এসেছে বলে জানা যায়। এগুলি কিন্তু সবই নব্য ভারতীয় আর্যভাষার নিদর্শন বন্ধুরা এটা ভুলো না যেন। সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গিয়ে তোমাদের মালিক মুহম্মদ জায়সির ‘পদুমাবৎ’ কাব্যের কথা বলবো। সেই কাব্যটিও কিন্তু অবধি ভাষায় রচিত। তাছাড়া ঐ ভাষাতেই তুলসীদাস তাঁর বিখ্যাত ‘রামচরিতমানস’ লিখেছেন। শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ থেকে মূলত উত্তর-পশ্চিম ভারতের আর মধ্য ভারতের প্রধান ভাষাগুলির জন্ম হয়েছে। যেমন বলা যায়, হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে শৌরসেনী ভাষার যে শাখা বিস্তৃত হয়েছিল, তা থেকে মূলত নেপালি, গোর্খালি, কুমায়ুনি, গাড়োয়ালি, চম্বলি ইত্যাদি নানাবিধ ভাষার জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে পূর্বী হিন্দি বলতে যে ভাষাগুচ্ছকে বোঝায় তাও কিন্তু বন্ধুরা এই শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ থেকেই সৃষ্ট। এ নিয়ে অনেক বিস্তৃত আলোচনা করে তোমাদের বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না। তাই তোমাদের যেটুকু জানানোর প্রয়োজন, তা বললাম। এর বেশি এক্ষেত্রে জেনে লাভ নেই বিশেষ।

অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ থেকে কীভাবে কোন কোন শাখার নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলির সৃষ্টি হয়েছে তার ধারাক্রমটা একটু মাথায় রেখো তোমরা। এখন এই আলোচনায় এখনও পর্যন্ত মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ নিয়ে কোনো কথা বলিনি। এই বিষয়টি আলাদা করেই সরিয়ে রেখেছিলাম। এবারে সেই বিষয়ে আসি।

প্রথমেই বলে নিই সহজ কথায়, মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে।

শুনে আশ্চর্য হচ্ছো? এতদিন জেনে এসেছো যে সংস্কৃত ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। না বন্ধুরা, সেই ধারণাটা সত্যি নয়।

সংস্কৃত বাংলা ভাষার জননী নয়।

এখন তোমরা তো আর এমনি এমনি আমার কথায় বিশ্বাস করবে না, কেনই বা করবে? উপযুক্ত যুক্তি ছাড়া কোনো কিছুই বিশ্বাস করা উচিত নয়। তাহলে চলো সংস্কৃত যে বাংলা ভাষার জননী নয়, সেই আলোচনায় ঢুকে পড়া যাক। তার আগে আমরা একটু মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠের দিকে তাকাবো। পাশের তালিকাটা খেয়াল করো একবার। মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠের পরে মূলত তিন ধাপের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে।

বন্ধুরা তালিকাতে দেখতেই পাচ্ছো, মূলত দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে এই মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ ভাষাটি – পশ্চিমা ও পূর্বী। পশ্চিমা শাখা থেকে জন্ম হয়েছে ভোজপুরি, মৈথিলি এবং মগহি ভাষার। অন্যদিকে পূর্বী শাখা থেকে সৃষ্টি হয়েছে ওড়িয়া, বাংলা ও অসমিয়া ভাষা। আমাদের দেখার বিষয় হল এর পূর্বী শাখাটি। ওড়িয়া, বাংলা আর অসমিয়া যেহেতু একই ভাষা শাখা থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তাই এদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলা ও অসমিয়া বর্ণমালা তো প্রায় সমান। তোমরা নিশ্চয়ই এটা খেয়াল করেছো।

ওড়িয়া ভাষার যদিও লিপি আলাদা। কিন্তু বাংলা ও অসমিয়া ভাষার লিপিকে বঙ্গলিপি বলা হয়। এই বাংলা ও অসমিয়া কিন্তু প্রথমে একই ভাষা ছিল জানো কি বন্ধুরা? অনেক পরে এ দুটি পৃথক হয়েছে, তাই আজও এই দুই ভাষার মধ্যে এত মিল। মোটামুটিভাবে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে সংস্কৃত ভাষা হল প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার একটি বিবর্তিত রূপ যা কিনা মূলত লেখ্য ভাষা হিসেবেই প্রচলিত ছিল। সম্পূর্ণ সংবদ্ধ একটি ব্যাকরণের নিয়মে আবদ্ধ বলে এই ভাষা থেকে অন্য কোনো ভাষার উৎপত্তি হওয়া প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। কিন্তু অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার কথ্যরূপটি বিবর্তিত হতে হতে আধুনিক ভারতীয় ভাষার রূপ পেয়েছে যা থেকে ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। তাই কোনোভাবেই সংস্কৃতকে বাংলা ভাষার জননী বলা যুক্তিযুক্ত নয়। বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠ ভাষা থেকে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

তাহলে এতক্ষণের আলোচনায় আমরা সমস্ত ভারতীয় ভাষাগোষ্ঠীগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানলাম এবং দেখলাম কীভাবে ধীরে ধীরে ভারতীয় আর্যভাষা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার সৃষ্টি হয়েছে। যদি বলা হয়, ঠিক কোন সময় বাংলা ভাষার জন্ম হয়? কী বলবে বন্ধুরা? খুব সহজভাবেই তোমাদের বলতে হবে, বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দে। খ্রিস্টপূর্বাব্দ কিন্তু ভুলেও বোলো না বা লিখো না। তাহলেই একেবারে গোল্লা! এরপরের ক্লাসে আমরা এই বাংলা ভাষার উৎপত্তি আর বিবর্তন সম্পর্কে একটু বিস্তারে আলোচনা করবো। আমরা আজকে যে বাংলা ভাষায় কথা বলি, তা তো আর একবারে তৈরি হয়নি। বহু বিবর্তন এক্ষেত্রেও ঘটেছে।

একেবারে প্রথম যুগের বাংলার সঙ্গে আজকের হাল আমলের বাংলার ফারাক কতখানি সেটা পরের ক্লাসের আলোচনায় খুব স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারবে বন্ধুরা। তাই আজকের মত এখানেই এই ক্লাস শেষ করছি। আপাতত পরের ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করো। দেখা হবে খুব শীঘ্রই।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা – তৃতীয় পর্ব

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_Bhasa_Poribar_2