prachin-banglar-somaj-sahityo
Class-11

প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সাহিত্য – প্রথম পর্ব

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (দ্বিতীয় অধ্যায়)


এর আগে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এবং বিশ্বের ভাষা ও পরিবার সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করবো।

আদ্যিকালের বাংলা ভাষা

বন্ধুরা আজকে শুরুতেই আমরা চলে যাবো আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগের বাংলায়। তখনও বাংলা মানে পশ্চিমবঙ্গ কিংবা বাংলাদেশ হয়নি। ভারতের বুকে বাংলা তখন এক অখণ্ড বিস্তৃত ভূমি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা’।
হ্যাঁ, বন্ধুরা তখন এই বিস্তৃত অঞ্চলকে সত্যই বঙ্গদেশ বলা হতো।

বলা হয় আবুল ফজলের লেখা
‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে প্রথম এই বাংলা বা বাঙ্গালা নামটির উল্লেখ আছে।

উত্তরে বিরাট পর্বত, দুই দিকে কঠিন শিলাকীর্ণ ভূমি, দক্ষিণে সমুদ্র নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলা।

এই ভূখণ্ড আগে নানা জনপদে বিভক্ত ছিল বঙ্গ, গৌড়, পুণ্ড্র, রাঢ়, সুহ্ম ইত্যাদি কত কী!

এই বাংলাতেই আজ থেকে বারোশো বছর আগে অষ্টম ও নবম শতকে পাল রাজারা শাসন করতেন। ইতিহাসে তোমরা নিশ্চয়ই জেনেছো এই পাল রাজবংশের কথা। এই পাল রাজবংশের সময়কাল থেকে বাংলা জুড়ে একটা বিশেষ ধর্মের প্রভাব ও প্রাধান্য গড়ে উঠতে থাকে আর এই প্রসঙ্গেই লেখা হয়েছিল আদ্যিকালের বাংলার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন। সে অনেক গল্প। একে একে বলা যাক।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

বহু বহু কাল আগে থেকেই বাংলার মানুষের মধ্যে ধর্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। এই ধর্মবিশ্বাসও যুগে যুগে বদলেছে। একেক রাজা এসেছেন, একেক ধর্ম প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলায় বিদেশি পর্যটকদেরও আগমন ঘটেছে একসময়। তারা আবার বাইরের দেশ থেকে নতুন ধর্মের বিস্তার ঘটাতে এই বাংলায় এসে ছড়িয়ে গিয়েছেন তাদের সেই ধর্ম। বহু আগে থেকেই বাংলায় বৈদিক ধর্মের পাশাপাশি মূলস্রোতের বাইরে আজীবিক, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম গৌণ ধর্মের মতো বিস্তার লাভ করেছিল। বলা ভালো এই ধর্মগুলি ছিল বেদের বিরোধী।

গুপ্ত যুগের আগে থেকেই বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন দেখা যায়। ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আসেন পর্যটক ইউয়ান –চোয়াং এবং তিনি সেকালের বাংলার কর্ণসুবর্ণ, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, হরিকেল প্রভৃতি অংশে প্রচুর বৌদ্ধ বিহারের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন।

তার পরে পর্যটক ইৎ-সিং ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এসেও এই বৌদ্ধদের প্রাধান্য লক্ষ করেছিলেন। গুপ্তযুগের পরে পাল যুগেই বৌদ্ধধর্ম রাজার পৃষ্ঠপোষকতা পায়। বাংলা জুড়ে দিকে দিকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সঙ্ঘারামে, বিহারে বুদ্ধের উপাসনা শুরু করে। পাল রাজাদের প্রত্যেকেই ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধ এবং বন্ধুরা যদি বাংলার ইতিহাসের দিকে একবার তাকাও তাহলে দেখবে যে অষ্টম শতক থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা জুড়ে প্রবলভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব দেখা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে সেন আমলে যদিও বাংলায় বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে এই বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধ চরমে ওঠে।

হিন্দু বৈদিক ধর্মের মানুষেরা বৌদ্ধদের অবলুপ্ত করে দিতে চাইতেন। কিন্তু কালের নিয়মে সংখ্যালঘু হয়ে, প্রবল অত্যাচার সহ্য করেও বৌদ্ধরা তাদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হল আদ্যিকালের বাংলা ভাষার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই এই ধর্ম নিয়ে পড়লাম কেন? তোমরা অনেকেই হয়তো সেটা বুঝতে পারছো না। আসল কথাটি হল, বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল যে সাহিত্যকর্মের ভিতরে তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে আছে ধর্মবিশ্বাস এবং নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার-আচরণ ইত্যাদি। আমরা ধীরে ধীরে সেই সব কথা জানবো।

চর্যাপদ

সময়টা ১৯০৭ সাল। নেপালের রাজদরবার থেকে বাঙালি পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী খুঁজে পেলেন একটি প্রাচীন পুঁথি। পুঁথির নাম ছিল ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’।

আর এই ঘটনার নয় বছর পরে ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশ পায় একটি বই ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’।

সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে যায় বাংলায়। এর আগে কেউ ভাবতেও পারেনি বাংলা ভাষার ইতিহাসে এরকম একটি উৎসের নিদর্শন থাকতে পারে। কী ছিল এই বইতে? সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ যাকে বলা হয় ‘চর্যাগীতি’ আর ছিল কিছু দোহা এবং ‘ডাকার্নব’ বলে আরেকটি পুঁথি। পরবর্তীকালে এই পদগুলিই চর্যাপদ হিসেবে পরিচিত হয়।

সাড়ে ছেচল্লিশটি বলা হয় কারণ একটি অসম্পূর্ণ পদ পাওয়া গিয়েছিল। এই পদের সঙ্গে মুনি দত্তের সংস্কৃত ভাষায় লেখা পদগুলির টীকাও ছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের পরে প্রবোধচন্দ্র বাগচী নামে আরেক পণ্ডিত নেপালের ঐ রাজদরবার থেকেই চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদ খুঁজে পান। সেখানে আবার একান্নটি পদ রয়েছে। দুয়ে মিলে বোঝা গেল চর্যার আসল পুঁথিটিতেও ছিল একান্নটি পদ। কোনোভাবে বাকি পদগুলি পাওয়া যায়নি।
এই সেই চর্যাপদ –
বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন। আদ্যিকালের বাংলা ভাষার নিদর্শন কেমন ছিল জানতে ইচ্ছে করে না?

ভাষাতাত্ত্বিকেরা বলেন চর্যাপদের মধ্যে নব্য ভারতীয় আর্যভাষার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস যারা পড়েনি তারা কীভাবে বুঝবে এই নব্য ভারতীয় আর্যভাষা কী বস্তু! এই বিষয়ে বিশদে জানতে পারবে বন্ধুরা ভাষার ইতিহাসের পর্বগুলিতে। এক ঝলক দেখে নিতে পারো।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

খুব সংক্ষেপে এখানে বলি, আর্যরা ভারতে প্রবেশের পর তাদের যে ভাষা যা কিনা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের একটি অংশবিশেষ তা বিবর্তিত হতে শুরু করে। ভারতীয় আর্য নামে পরিচিত সেই ভাষাবংশের একেবারে আধুনিক পর্যায়ের নাম নব্য ভারতীয় আর্যভাষা।

ভাষার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখেতে পাবে বন্ধুরা দশম থেকে দ্বাদশ শতকের আগে বাংলায় শৌরসেনী ও মাগধী অপভ্রংশের বিস্তার প্রচলন ছিল। আসলে সংস্কৃত ভাষাটি কেবল পণ্ডিত ব্রাহ্মণদের মধ্যেই প্রচারিত হয়েছিল এবং এই ভাষার জটিলতার কারণে নিরক্ষর আপামর সাধারণ মানুষ সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। তারা সে সময় কথা বলতো প্রাকৃত ভাষায়।

এই প্রাকৃত ভাষা থেকেই পরে শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং মাগধী অপভ্রংশের উৎপত্তি ঘটেছে। এই অপভ্রংশগুলিই নব্য ভারতীয় আর্যভাষার পর্যায়ে পড়ে। চর্যাপদে কিন্তু এই মাগধী অপভ্রংশের প্রয়োগ দেখা যায়।

এই ব্যাপারটা তোমরা হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারছো না বা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। সেইজন্য এই অংশের পরে তোমরা ভাষার ইতিহাসের অধ্যায়টি একবার পড়ে নিও, দেখবে ঠিকই বুঝতে পেরে গেছো। মোদ্দা কথা হল, চর্যাপদে যে ভাষা দেখা গেছে তা ভাষাতাত্ত্বিকেরা বলেছেন নব্য ভারতীয় আর্যভাষার নিদর্শন এবং সেটা সময়ের হিসেবে মোটামুটিভাবে দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে প্রচলিত ছিল এই বাংলায়।

আবার বাংলা ভাষার বিবর্তনের কথা যদি দেখো, তাহলে ভাষার ইতিহাসে পড়বে যে চর্যাপদে যে বাংলা ভাষা আবিষ্কার করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তাকে আদি বাংলা বলা হয়। এরও সময়কাল ঐ একই। ফলে এ থেকে এই সত্যেই উপনীত হওয়া যায়, চর্যাপদ যারাই লিখে থাকুন না কেন, এটির রচনাকাল মোটামুটিভাবে দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে। তবে এটা কিন্তু খ্রিস্টের জন্মের আগের ঘটনা তাই ভুল করেও বন্ধুরা খ্রিস্টাব্দ লিখো না।

চর্যাপদের রচনাকাল লিখতে হলে লিখবে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে অথবা খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যে।

খ্রিস্টাব্দ আর খ্রিস্টপূর্বের গোলকধাঁধায় সকলেই পড়ে, তাই আগেই সুলুক সমাধান দিয়ে রাখলাম।

কারা লিখলেন এই চর্যাপদ?

আর কেনই বা লিখলেন? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করে। বড়ো কোনো বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে অর্থ উপার্জনের আশা ছিল না নিশ্চয়ই! কিংবা এইসব লিখে সেই সমাজে তাদের কি খুব নামডাক হয়েছিল? তোমরা শুনলে অবাক হবে, চর্যাপদ যারা লিখেছেন তারা সেকালের সমাজে অন্ত্যজ-প্রান্তিক মানুষ ছিলেন। সমাজের মূলস্রোতের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের যে বর্ণাশ্রম প্রথা প্রাচীন ভারতীয় সমাজে চালু ছিল, তার প্রভাবে ব্রাহ্মণদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল তাদেরও। অদ্ভুতভাবে এইসব দুঃখ-কষ্টের কথা সবই চর্যাপদের মধ্যে লিখে গেছেন এর কবিরা।

আলোচনার শুরুতেই যে ধর্মের কথা বলছিলাম, তার সূত্র ধরে বলি চর্যাপদ আসলে বৌদ্ধ ধর্মের সাধনা পদ্ধতির গভীর ও জটিল তাত্ত্বিক ধারণার কথা। এখন এই কথার অর্থ একেবারে বুঝতে পারবে না। ধীরে ধীরে এই আলোচনার মধ্য দিয়েই সব উত্তর পেয়ে যাবে তোমরা।

তোমরা জেনে রাখো, চর্যাপদের কবিরা সকলেই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ছিলেন। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ এক রূপের বা শাখার সিদ্ধপুরুষ তথা যোগী। তাদের জীবন ছিল সাধনার জীবন। আমাদের শৈব ধর্ম বা শাক্ত ধর্মের সাধনার মধ্যে যেমন গভীর তন্ত্রের প্রভাব ও প্রয়োগ রয়েছে, বৌদ্ধ ধর্মেও তা রয়েছে।

[এর পরের পর্বে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।]

চর্যাপদের কবিদের নামগুলো এই ফাঁকে জেনে নাও। কাহ্নপাদ, লুই পাদ, ভুসুক পাদ, সবর পাদ, চাটিল পাদ প্রমুখ।

এদের মধ্যে কাহ্নপাদের লেখা পদের সংখ্যাই সবথেকে বেশি- বারোটি!

তথ্য হিসেবে এটাও মনে রাখতে হবে তোমাদের। তবে পুরো চর্যাপদ বিচার করে দেখা গেছে মোট চব্বিশ জন পদকর্তা কবি রয়েছেন। এদের নামের শেষে প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই দেখতে পাবে ‘পাদ’ রয়েছে। এটা একটি ধর্মবিশ্বাসের চিহ্নবিশেষ। এদের বলা হয় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য। এই রকম চুরাশি জন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের সিন্ধান পেয়েছেন ঐতিহাসিকেরা যাদের জীবনযাপন ছিল অদ্ভুত রকমের। তা সে নিয়ে এখন আর তোমাদের বোর করবো না।

আরেকটা বিষয় তোমাদের জানাই। চর্যাপদ নিয়ে এত কথা হল, চর্যাপদগুলি আসলে ছিল কেমন সেটা দেখবে না? আমাদের প্রাচীন বাংলার নিদর্শন ঠিক কীরকম ছিল তা দেখা বা পড়া অবশ্যই দরকার আমাদের। চলো দেখে নিই –

‘কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।।’

কিছু বোঝা যাচ্ছে? আমার ধারণা প্রথমবার পড়ে তোমরা হয়তো বিশ্বাস করে নিয়েছো যে এ লেখা বাংলা কিছুতেই হতে পারে না। বাংলা হলে তোমরা ঠিকই বুঝতে, কী তাই তো? কিন্তু না, এ লেখা বাংলাতেই লেখা। আদি-মধ্য বাংলার এটাই প্রকৃত রূপ। পদটি লিখেছেন লুই পা। এখানেই হল আসল মজা, আসল ম্যাজিক।

প্রাচীনকালে যেমন সমাজে ধাঁধার প্রচলন ছিল, সেই একটা কথার অর্থ এক, কিন্তু এমনভাবে বলা হবে যাতে বুদ্ধি করে আসল অর্থটা বের করতে হয়। এখনও তোমরা ধাঁধার ব্যবহার দেখে থাকবে। এই পদগুলো আসলে সেই ধাঁধা একেকটা। মানে এতে বলা হয়েছে এক, আর আসল অর্থ আরেক। বুঝলে না তো? দাঁড়াও সহজ করে বলি। বিখ্যাত সব সাহিত্য সমালোচক এবং ঐতিহাসিকেরা চর্যাপদের ভাষাকে বলেছেন ‘সন্ধা ভাষা’।

দিনের পরে আঁধার নেমে এলে যেমন অল্প দেখা যায়, অল্প দেখা যায় না ঠিক সেভাবেই চর্যার ভাষা খানিক বোঝা যায় না। এই পদগুলির প্রতিটিরই দুই রকম অর্থ রয়েছে, একটি তার আক্ষরিক অর্থ বা বাহ্যিক অর্থ এবং অন্য অর্থটি এই পদের ব্যঞ্জনার্থ বা গূঢ়ার্থ।

তাই বললাম যে এগুলো সব একেকটা ধাঁধা। তাহলে তোমাদের আরো একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে চর্যাপদের ভাষাকে সন্ধা ভাষা বলে এবং এর কারণটাও কিন্তু তোমাদের মনে রাখা উচিত। যেমন ধরো উপরের পদটাই – ভালো করে একবার পড়ো। এর আক্ষরিক অর্থ করলে দাঁড়ায় –
কায়ারূপ একটি গাছের পাঁচটি ডাল। চিত্ত চঞ্চল এবং কাল অতিবাহিত হচ্ছে।

এ কথা বললে কিছুই বোঝা যায় না সেভাবে। আসলে কবিরাও এভাবে কিছুই বোঝাতে চাননি।

চর্যার কবিদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল পদের মধ্য দিয়ে তাঁদের নিজেদের সাধনার কথা, সিদ্ধিলাভের উপায়ের কথা বলে যাওয়া যাতে পরবর্তী প্রজন্মের সাধকেরা সিদ্ধিলাভ করতে পারেন এবং তাঁর পূর্বসুরিদের সম্পর্কে জানতে পারেন।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

এবারে ভাবো বন্ধুরা, যে সময় এই চর্যাপদ লেখা হচ্ছে সেই সময় ভারতে কিন্তু বৌদ্ধদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। একদিকে হিন্দুদের প্রবল অত্যাচার আর অন্যদিকে তুর্কীদের আক্রমণের সম্ভাবনায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাংলা থেকে অন্যত্র যাওয়ার তোড়জোড় করছেন।
তাই বাংলায় বসে এই সব পদগুলি লেখা হলেও তুর্কীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পাহাড় পেরিয়ে দুর্গম পথ বেয়ে সমস্ত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা চলে গিয়েছিল নেপালে। তাই ওখানেই পাওয়া যায় এই বাংলার প্রাচীনতম পুঁথিটি। সত্যই রোমাঞ্চকর ব্যাপার তাই না! আরো একটা চর্যার পদ দেখো –

‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।
হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশি’

এর আক্ষরিক অর্থ হল – টিলার উপর আমার ঘর, আমার আশেপাশে কোনো প্রতিবেশি নেই। এদিকে আমার হাঁড়িতে ভাত নেই, নিত্যদিন তাই উপবাস চলে।

এই পদটা তবুও একটু সহজে বোঝা গেল তাই না? এতে একটা গল্পও আছে। এক ব্যক্তির অভাবের কথা, একাকিত্বের কথা আছে। এতেও কিন্তু সেই গুঢ়ার্থ রয়েছে, মানে এই গল্পের ভিতর দিয়েও আরো একটা কিছু বোঝাতে চেয়েছেন কবি। এই আরো একটু যে কি আসলে তা জানতে গেলে চর্যার কবিদের মূল ধর্মসাধনার বিষয়টি সহজ করে বুঝে নিতে হবে। আগেই বলেছি চর্যাপদে ধর্মটাই সব। তাই ধর্ম বুঝলে, পদের মর্মও বোঝা যাবে।
তবে আজ আর নয়, মাথা ভার হয়ে যাবে আরো জানলে। তাই আজ ছুটি। দেখা হবে আবার পরের ক্লাসে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → দ্বিতীয় পর্ব


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_Somaj_sahityo_1