শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: ভূগোল । অধ্যায় – চাপ বলয় ও বায়ুপ্রবাহ
আগের পর্বে আমরা জেনেছি শিলা সম্পর্কে। এই পর্বে আমরা চাপ বলয় ও বায়ুপ্রবাহ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
সৌরজগতে পৃথিবী একমাত্র গ্রহ, যার চারদিকে বায়ুমণ্ডলের বলয় রয়েছে। বায়ু একটি প্রাকৃতিক শক্তি যার ওজন আছে, বায়ু পৃথিবী পৃষ্ঠে চাপ দেয়। এই চাপই বায়ুর চাপ। স্থান ও সময় বিশেষে এই চাপের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কোথাও বায়ুর চাপ বেশি (উচ্চ), কোথাও বায়ুর চাপ কম (নিম্ন)। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বায়ুচাপের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। সমান বায়ুচাপযুক্ত অঞ্চলগুলিকে একটি কাল্পনিক রেখা দিয়ে যুক্ত করলে একটি চাপ বলয় পাওয়া যায়। পৃথিবী পৃষ্ঠের ওপর নির্দিষ্ট দূরত্বে সমধর্মী বায়ুস্তর অনুভুমিকভাবে প্রায় হাজার কিলোমিটার জুড়ে পুরো পৃথিবীকে কয়েকটি বলয়ের আকারে বেষ্টন করে আছে, এগুলি হল বায়ুচাপ বলয়।
পৃথিবীতে মোট সাতটি চাপবলয় রয়েছে, যথা – নিরক্ষীয় নিম্ন বায়ুচাপ অঞ্চল, কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চ বায়ুচাপ অঞ্চল, সুমেরু ও কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্ন বায়ুচাপ অঞ্চল এবং সুমেরু ও কুমেরু উচ্চ বায়ুচাপ অঞ্চল।
প্রত্যেকটি চাপ বলয়ের চাপের তারতম্যের কারণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে নেওয়া যাক।
নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়
নিরক্ষরেখার দুপাশে 0° থেকে 5° অক্ষরেখা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল হল নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারাবছর সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পড়ে। ফলে এখনকার বায়ু সারাবছর উষ্ণ থাকে। স্থল্ভাগের তুলনায় জল্ভাগ বেশি থাকায় উষ্ণ বায়ুর জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বেশি হয়। এই হালকা জলীয় বাষ্পযুক্ত বায়ু প্রসারিত হয়ে ওপরে উঠে যায়, এখানে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে কোন বায়ু প্রবাহিত হয়না। ফলে এখানে বায়ু চলাচল বোঝা যায় না, শান্তভাব বিরাজ করে। তাই এই অঞ্চলের আরেক নাম নিরক্ষীয় শান্ত বলয়। এই ঊর্ধ্বগামী বায়ু পৃথিবীর আবর্তন গতির কারণে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছিটকে যায়, ফলে এই অঞ্চলে বায়ুর পরিমাণ কমে যায় ও নিম্নচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়।
কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চ বায়ুচাপ অঞ্চল
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে 25° থেকে 35° অক্ষরেখার মধ্যবর্তী অঞ্চল যথাক্রমে কর্কটীয় ও মকরীয় অঞ্চল নামে পরিচিত। এইদুটি অঞ্চলে দুটি উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি হয়েছে। নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে আসা উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু উপরে উঠে ক্রমশ ঠাণ্ডা ও ভারী হয়ে ঘনত্ব বেড়ে যায়। নিরক্ষীয় ও মেরুবৃত্তের অঞ্চলের এই ঊর্ধ্বগামী বায়ু পৃথিবীর আবর্তন গতির কারণে বিক্ষিপ্ত হয়। এই বায়ু পড়ে শীতল ও ভারী হয়ে নীচের দিকে নেমে এসে দুই ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থান করে। মেরু অঞ্চলের ঠাণ্ডা ও শুষ্ক বায়ুও এই অঞ্চলে এসে মিলিত হওয়ার ফলে এখানে ভারী ও ঠাণ্ডা বায়ুর পরিমাণ বেড়ে যায় ও উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়।
মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় অঞ্চল
উভয় গোলার্ধে 60° থেকে 70° অক্ষরেখার মাঝের অঞ্চল অর্থাৎ সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত বরাবর দুটি নিম্ন চাপবলয় অবস্থান করে। এই দুটি চাপবলয় উত্তর গোলার্ধে সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় ও দক্ষিণ গোলার্ধে কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্ন বায়ুচাপ বলয় রয়েছে। দুই গোলার্ধে মেরু অঞ্চলের তুলনায় পার্শ্ববর্তী মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় অঞ্চলের উষ্ণতা বেশি হয়। ফলে এই অঞ্চলের বায়ু হালকা হয়ে ওপরে ওঠে ও প্রসারিত হয়। ক্রান্তীয় ও মেরু অঞ্চলে এই বায়ু বিক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে বায়ুর পরিমাণে কম থাকে ফলে বায়ুর ঘনত্ব কম হয়ে বায়ুর নিম্নচাপ বলয় সৃষ্টি হয়।
মেরু অঞ্চল
দুই গোলার্ধে 80° অক্ষরেখার থেকে মেরু বিন্দু মধ্যবর্তী অঞ্চলে দুটি বায়ু চাপবলয় সৃষ্টি হয়েছে। দুই মেরু অঞ্চল সারাবছর হিমাঙ্কের নীচে থাকায় বরফে ঢাকা থাকে, তাই এখানকার বাতাস ভীষণ ভারী আর শীতল। সূর্যরশ্মি প্রায় সারাবছর তির্যকভাবে পড়ার ফলে বাষ্পীভবনের পরিমাণ খুব কম।
• বায়ুপ্রবাহ
চাপের সমতা বজায় রাখার জন্য বায়ু সবসময় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। দুটো অঞ্চলের মধ্যে চাপের পার্থক্য থাকায় বায়ুর প্রবাহ সৃষ্টি হয়। উচ্চচাপ ও নিম্নচাপ অঞ্চলের মধ্যে চাপের পার্থক্য বেশি হলে বায়ুর গতিবেগ বাড়ে, আবার চাপের পার্থক্য কমলে বায়ু ধীরগতিতে বয়। চাপের পার্থক্য না থাকলে শান্ত আবহাওয়া বিরাজ করে।
• পৃথিবীর আবর্তন গতির কারণে পৃথিবী পৃষ্ঠের যেকোনো গতিশীল বস্তুর ওপর একধরনের বল কাজ করে যা বস্তুগুলোর দিকের পরিবর্তন করে থাকে। গতিশীল বস্তুর বাইরে ছিটকে যাওয়ার এই প্রবণতাকে কেন্দ্র বর্হিমুখী বল বলা হয়। এই গতিশীল বস্তুগুলির উপর একধরণের বল কাজ করে যা বস্তুগুলির দিক বিক্ষেপ ঘটায়, এর নাম কোরিওলিস বল। পৃথিবীতে বায়ু ও সমুদ্রের স্রোতের ওপর এই বল কাজ করে।
এই কোরিওলিস বলের কারণে উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে চলাচলের সময় বায়ু সোজাপথে প্রবাহিত না হয়ে উত্তর গোলার্ধে তার প্রবাহের ডানদিকে বেঁকে ও দক্ষিণ গোলার্ধে তার প্রবাহের বাঁদিকে বেঁকে চলাচল করে। মার্কিন আবহবিদ উইলিয়াম ফেরেল প্রথম এই বিষয়টি উল্লেখ করায় এটি ফেরেলের সূত্র নামে পরিচিত।
নিয়ত বায়ুপ্রবাহ
সারবছর ধরে নিয়মিতভাবে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে একই দিকে প্রায় একই গতিবেগে প্রবাহিত বায়ু হল নিয়ত বায়ু। নিয়ত বায়ু তিন ধরণের – আয়নবায়ু, পশ্চিমা বায়ু, মেরু বায়ু।
আয়ন বায়ু
কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে সারাবছর ধরে প্রায় নিয়মিতভাবে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত বায়ু হল আয়ন বায়ু। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে 5° থেকে 25° অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই বায়ু প্রবাহিত হয়।
অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান | ভূগোল
পশ্চিমা বায়ু
কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে যথাক্রমে সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত বায়ু হল পশ্চিমা বায়ু। পশ্চিম দিক থেকে চলাচল করে বলে এই বায়ুর নাম পশ্চিমা বায়ু। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে 35° থেকে 60° অক্ষরেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয়।
মেরু বায়ু
দুই গোলার্ধের মেরুদেশীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে শুষ্ক ও শীতল মেরুবায়ু মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারাবছর ধরে প্রবাহিত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে 70° থেকে 80° মধ্যবর্তী অক্ষরেখায় এই বায়ু প্রবাহিত হয়। মেরুবায়ুর কারণে দুই গোলার্ধে মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে মাঝেমাঝে তুষার ঝড় হয়।
বায়ুচাপ বলয়ের অবস্থান পরিবর্তন
জলবিষুব ও মহাবিষুবের দিন বায়ুচাপ বলয়গুলো নিজের অবস্থানে থাকে। সূর্যের উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়নের সময় বায়ুচাপ বলয়গুলো 5° থেকে 10° অক্ষরেখা পর্যন্ত উত্তরে ও দক্ষিণে সরে যায়। একে বলে বায়ুচাপ বলয়ের অবস্থান পরিবর্তন। এই অবস্থানের পরিবর্তন দুই গোলার্ধের 30 থেকে 40 অক্ষরেখার মধ্যের অঞ্চলের জলবায়ুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে আয়ন বায়ু ও শীতকালে পশ্চিমা বায়ুর দ্বারা প্রভাবিত হয়।
সাময়িক বায়ু
বছরের একটা নির্দিষ্ট ঋতুতে বা দিনের ও রাতের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে যে বায়ু চলাচল করে তাকে সাময়িক বায়ু বলে।
• সমুদ্রবায়ু ও স্থলবায়ু
স্থলভাগ ও জলভাগের অপরের বায়ুর তাপমাত্রার ও চাপের তারতম্যের কারণে সমুদ্র বা নদীর ধারে সমুদ্র ও স্থলবায়ুর প্রবাহ দেখা যায়। দিনের বেলা স্থলভাগের উষ্ণতা বেশি থাকায় হালকা বায়ু উপরের দিকে উঠে নিম্নচাপ সৃষ্টি করে,অপরদিকে সমুদ্রের জল তুলনামুলকভাবে শীতল হওয়ায় উচ্চচাপ সৃষ্টি হয়। ফলে দিনের বেলা সমুদ্র থেকে স্থলভাগের দিকে শীতল সমুদ্রবায়ু প্রবাহিত হয়। সূর্যাস্তের পর থেকে স্থলভাগ তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে পরে, কিন্ত সমুদ্রের অপরের বায়ু তখনও উষ্ণ থাকে। ফলে স্থলভাগ থেকে রাতের বেলায় সমুদ্রের দিকে শীতল স্থলবায়ু প্রবাহিত হয়।
• অ্যানাবেটিক ও ক্যাটাবেটিক বায়ু
কোন পার্বত্য অঞ্চলে মাঝের উপত্যকায় দিনের বেলায় হালকা বায়ু পর্বতের ঢাল বরাবর নীচ থেকে উপরের দিকে উঠে যায়, এর নাম অ্যানাবেটিক বায়ু বা উপত্যকা বায়ু। আবার রাত্রিবেলায় দ্রুত তাপ বিকিরণের পরে পর্বতের ঢালের বায়ু শীতল হয়ে যায়। এই উচ্চচাপের ভারী বায়ু পর্বতের ঢাল বরাবর নীচে নামে, এর নাম ক্যাটাবেটিক বায়ু বা পার্বত্য বায়ু।
স্থানীয় বায়ু
পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রবাহিত বায়ু হল স্থানীয় বায়ু। যে অঞ্চলে এই বায়ু প্রবাহিত হয় সেখানকার স্থানীয় ভাষায় এই বায়ুর নামকরণ করা হয়। যেমন – ভারতে প্রবাহিত স্থানীয় বায়ু হল লু এবং আঁধি।
আকস্মিক বায়ু
পৃথিবীপৃষ্ঠে স্বল্প পরিসর স্থানে চাপের পার্থক্যের কারণে হঠাৎ করে অনিয়মিত বায়প্রবাহই হল আকস্মিক বায়ু।
এটি দুইপ্রকারের হয় যথা – ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘূর্ণবাত।
ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে ঘূর্ণবাত হয়ে থাকে, এটি সাধারণত বিধ্বংসী প্রকৃতির হয়। উচ্চ অক্ষাংশে প্রতীপ ঘূর্ণবাত হয়,বায়ুর গতিবেগঘূর্ণবাতের চেয়ে তুলনামুলকভাবে অনেক কম থাকে। এক্ষেত্রে আকাশ মেঘমুক্ত এবং আবহাওয়া শুষ্ক, রোদ ঝলমলে হয়ে থাকে।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → মেঘ – বৃষ্টি
লেখিকা পরিচিতিঃ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্রী শ্রীপর্ণা পাল। পড়াশোনার পাশাপাশি, গান গাইতে এবং ভ্রমণে শ্রীপর্ণা সমান উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
VIII_Geo_4a