natorer-kotha
WB-Class-8

নাটোরের কথা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর | প্রেক্ষাপট ও বিষয়সংক্ষেপ

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: বাংলা। নাটোরের কথা (গল্প)

লেখক পরিচিতি

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন খ্যাতনামা শিল্পী। তাঁর প্রতিভা সাহিত্য থেকে শুরু করে চিত্রাঙ্কন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে তাঁর আরও একটি পরিচয় ছিল তিনি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো। তাঁর বিখ্যাত কিছু সৃষ্টি ‘ভূতপতরির দেশ’, ‘শকুন্তলা”, ‘খাজাঞ্চির খাতা’, ‘রাজকাহিনী’, ‘ক্ষীরের পুতুল’ প্রভৃতি।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশী আন্দোলনের সময় ‘ভারতমাতা’ চিত্র অঙ্কন করেছিলেন।


নাটোরের কথা গল্পের বিস্তারিত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে ↓


রচনার উৎস

বর্তমান পাঠ্যাংশটি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।

নাটোর গল্পের প্রেক্ষাপট

‘নাটোর’ গল্পটিতে লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০১ সালে আয়োজিত প্রভেন্সিয়াল
কনফারেন্সের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রায় ১১০ বছর পূর্বের এই ‘প্রভেন্সিয়াল
কনফারেন্সের’ গুরুত্ব বুঝতে গেলে আমাদের এই ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ বেশ কয়েকটি প্রভিন্সে বা প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত ছিল, মানে আজকের ভারতে যেমন বিভিন্ন রাজ্য দেখতে পাই, সেই সময়ে তা ছিল বিভিন্ন প্রভিন্সে বিভক্ত। এদের মধ্যে বেঙ্গল প্রভিন্স ছিল সর্বাধিক বৃহত্তম এবং গুরুত্বপূর্ণ।

সেই সময়ে ভারতবাসীর মধ্যে ধীরে ধীরে জাতীয়তা বোধ গড়ে উঠছিল এবং কিভাবে ব্রিটিশ শাসন রদ্‌ করে, ভারতীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় তার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন কনফারেন্স বা অধিবেশনে তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা মিলিত হতেন, তাঁদের ভাবনা সবার সাথে ভাগ করে নিতেন এবং দলগতভাবে তাঁরা আগামী কর্মপন্থা ঠিক করতেন।

একথা ভেবে আমাদের গর্ব হবে যে, সেই সময়কার দিক্‌পাল রাজনীতিবিদ এবং চিন্তাবিদদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বাঙালি। যেমন এই গল্পে আমরা স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, লালমোহন ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবিকাকা), সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি দিক্‌পাল চিন্তাবিদের উল্লেখ পাই।

এই কনফারেন্স বা অধিবেশনগুলি আয়োজন করার নির্দিষ্ট কোন স্থান ছিল না। সাধারণত, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে এগুলি আয়োজন করা হত। ১৯০১ সালে বেঙ্গল প্রভিন্সের প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন নাটোরে আয়োজিত হয়। যার বর্ণনা নিয়ে এই গল্পের সুত্রপাত। প্রসঙ্গত, বর্তমানে নাটোর বাংলাদেশের একটি জেলা।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান

নাটোর গল্পের বিষয় সংক্ষেপ

গল্পটি মূলত শুরু হয়েছে অবিভক্ত বাংলার রাজশাহীর নাটোরে অনুষ্ঠিত এক প্রভিনশিয়াল কনফারেন্সকে ঘিরে।

লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন নিতান্তই “ছোকরা” (যুবক)। তিনি তাঁর কাকা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উমেশ চন্দ্র বোনারজী, লাল মোহন ঘোষ,সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সহ কংগ্রেসের বহু তাবড় তাবড় ব্যাক্তিত্ব নাটোরের তৎকালীন রাজা জগদিন্দ্রনাথের (ওরফে নাটোর) আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিলেন। প্রভিনশিয়াল কনফারেন্সের আয়োজন শুরু হল। সকলে মিলে মহা সমারোহে তাঁরা নাটোরের উদ্দ্যেশে যাত্রা করলেন।

সেই যাত্রার জন্য স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করলেন স্বয়ং নাটোর। সে এক রাজকীয় ব্যবস্থা। প্রত্যেক স্টেশনে তদারকির জন্য লোক থেকে শুরু করে পদ্মা পারাপারের জন্য স্টিমার এমনকি সমস্ত মালপত্র তোলার জন্যেও বিশেষ লোকজন সব কিছুরই উত্তম ব্যবস্থা ছিল।

ডেকের টেবিলে খাওয়া দাওয়ার জন্য এক রাজকীয় আয়োজন করা হয়েছিল। একদিকে সব তাবড় তাবড় ব্যাক্তিবর্গ আর অন্যদিকে লেখকের মতন যুবকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে খাবার যাই আসে সবই আগে যায় বড়দের দিকে। সেইখানেই এক ‘দৈত্যের’ প্লেটেই খাবারের বেশি অংশ চলে যায়। ‘ছেলে ছোকরাদের’ জন্য আর বিশেষ কিছুই বাকি থাকেনা। কাটলেট থেকে পুডিং সবই সেই হোমরা চোমরা ব্যাক্তির ‘পেটপুজোয়’ লেগে যায়।

“সত্যি বাপু, অমন জাইগ্যান্টিক খাওয়া আমরা কেউ কখনো দেখিনি।”

এমতাবস্থায় অমন সব লোভনীয় খাবারের চোখের সামনে ‘সলিল সমাধি’ সইতে না পেরে বাধ্য হয়েই লেখকের এক সঙ্গী পরিবেশনকারীদের তাদের দিকেই খাবার আগে দেওয়ার অনুরোধ জানালেন।

এতে কাজ হল!

এরপর যুবকদের দুঃখ বুঝতে পেরে খাবার একসাথে দুদিকে আসতে শুরু করল। আর তাতেই সমস্যার সমাধান!

নাটোরে অবশেষে সকলে পৌঁছলেন। সেখানেও এক অভাবনীয় আয়োজন।

একেই বলে রাজসমাদর।সবকিছু তৈরি হাতের কাছে।

সুন্দর করে সাজানো বাড়ি বৈঠকখানা। জামা কাপড়ও গুছিয়ে তাদের জন্য রাখা। সর্বক্ষণ চাকরেরা ঘুরছে অতিথি আপ্যায়নে যাতে ত্রুটি না থাকে তা নিশ্চিত করতে। কাজকর্ম কিছুই নেই। লেখকসহ বাকি যুবকেরা আনন্দে ঘুরে বেড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছেন।

খাওয়া দাওয়া আড্ডার পাশাপাশি রবি ঠাকুর উপস্থিত থাকায় গানের আসরও জমে উঠেছিলো। রিসেপশান কমিটির প্রেসিডেন্ট স্বয়ং নাটোরও ছিলেন গান প্রিয় মানুষ। তাই আমোদ প্রমোদ ভালোই হচ্ছিলো।

মাছ, মাংস, ডিম, হরেক রকম মিষ্টি, রানিমার হাতে তৈরি পিঠে পায়েস এসব খেয়ে ঘুমিয়ে লেখকের দিন যেন রাজার হালে কাটছিল। ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই মুখের সামনে ‘গড়গড়া’ নিয়ে উপস্থিত চাকরেরা। সব মিলিয়ে এক অভিনব অতিথি আপ্যায়ন ব্যবস্থা।

লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী।

নাটোরের গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে চলতে থাকলো তাঁর স্কেচ। পুরনো ঘর মন্দির থেকে শুরু করে রানী ভবানির অন্দরমহল কিছুই লেখকের স্কেচের আঁকিবুঁকি থেকে বাঁচলনা। খাতার সাথে সাথে নাটোরের রাজার মনও ভরে উঠলো। তাঁর আবদার মেনে লেখক জোরকদমে বাড়ির বিভিন্ন সামগ্রীর স্কেচ করে চললেন। এর সাথে সাথে এমন আদর পেয়ে লেখকেরও অভিনব সব বায়না মাথায় চলে এল। নির্দ্বিধায় নাটোরও সে সব মেটাতে লাগলেন। যেমন গরম চায়ের সাথে গরম মিষ্টি খাবার বাসনা পূরণ করার জন্য নাটোর খাবার ঘরের বাইরেই হালুইকরদের (মিষ্টি তৈরি করেন যারা) বসিয়ে দিলেন মিষ্টি বানাতে। আর এই ভাবেই চলতে লাগলো নাটোর রাজার অতিথি আপ্যায়ন।

এল সেই বিশেষ ‘মুহূর্ত। বসলো রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স। কংগ্রেসের তাবড় তাবড় ব্যাক্তিদের সাথে ঠাকুর বাড়ির বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ ও রাজবাড়ির সদস্যদের উপস্থিতিতে কনফারেন্স শুরু হল। কিন্তু বাঁধল সমস্যা!

রবি ঠাকুর প্রস্তাব করলেন বাংলায় কনফারেন্স করার।

লেখকসহ সমস্ত যুবকবৃন্দ এই আবেদনে সমর্থন জানালেন। কিন্তু তাতে কি! বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা এই বিষয়ে কেউ রাজি নয়। জোর তর্ক বেঁধে গেল। শেষে দুটো দলে সকলে ভাগ হয়ে গেলেন। ঠিক হল এক দল বাংলায় বলবেন আর এক দল ইংরাজিতে। রবি ঠাকুরও ‘সোনার বাংলা…’ গান দিয়ে সভার সূচনা করলেন।

প্যান্ডেলে শুরু হল সভা। যেই না প্রেসিডেন্ট ‘ইংরাজিতে’ বলা শুরু করলেন ছেলেরাও ওমনি “বাংলা বাংলা….” চিৎকারে তাদের বলা বন্ধ করে দিল। এইরকমভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর শেষে ঘোরতর ইংরাজি বক্তা লালমোহন ঘোষ বাংলায় বক্তৃতা করলেন। সে কি চমৎকার বাংলা।

জয় হল বাংলা ভাষার।

সেই প্রথম তাঁরা বাংলা ভাষার জন্য এইভাবে সকলের সামনে লড়লেন। কনফারেন্স বাংলা ভাষাতেই সম্পন্ন হল।

এরপর অবশ্য গরম গরম মিষ্টি খাওয়া থামেনি। শুধু শুধু বারে বারে ছেলে ছোকরাদেরকে খাবার জন্য সাধাটা থেমেছিল। মুখের সামনে খাবার এলেই কারোর বলার আগেই তা তাঁরা পেটে চালান করে দিত।

নাটোর গল্পের মূল বক্তব্য

লেখক এমন এক সময়ের কথা এই গল্পে বর্ণনা করেছেন যখন ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের এক মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবান ভারতবাসী পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। তাঁরা দেশের দাবী দাওয়া ব্রিটিশদের কাছে তুলে ধরছেন দেশের মানুষের হয়ে। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বঙ্গভঙ্গ রদে যখন বয়কট আন্দোলন জোরদার হয়েছিল, তখন অন্যান্য দাবিগুলির পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাতে সভা, সমিতি, আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস শুরু হয়েছিল।

দেশের বেশিরভাগ মানুষ শিক্ষা থেকে বহু দূরে তাই ইংরাজি ভাষা দেশ শাসকদের জন্য সুবিধাজনক হলেও বিপুল সংখ্যক বাংলার মানুষ সেই সব আন্দোলন থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। যা কখনই কাম্য ছিলনা। রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে রাখীবন্ধনের মাধ্যমে মানুষে মানুষে সংহতি গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও জোর দিয়েছিলেন। সেইসময়েই রচিত ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘সোনার বাংলার’ মত কালজয়ী গান।

তাই নাটোরে অনুষ্ঠিত প্রভিনশিয়াল কনফারেন্স বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠিত করা ছিল এক অন্যতম পদক্ষেপ। লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তি নাটোরের রাজার রাজকীয় আয়োজনে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। বাংলার অসংখ্য সাধারণ, দরিদ্র, অশিক্ষিত মানুষের কাছে বাংলা ভাষার মাধ্যমে পৌঁছনোর, এর চেয়ে ভালো সূচনা আর হতেই পারতনা। আর সেই উদ্যোগই নাটোরের মাটিতে এক বিপুল জাঁকজমকের মধ্যে দিয়ে রবি ঠাকুরসহ বাংলার একদল সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত যুবক শুরু করেছিলেন।

সমাপ্ত। আরো পড়ো → ছন্নছাড়া কবিতার সম্পূর্ণ আলোচনা

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –