ইতিহাস– নবম শ্রেণি – বিশ শতকে ইউরোপ (সপ্তম পর্ব)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্পেন রাষ্ট্র একনায়ক শাসনতন্ত্রের শিকার হয়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে স্পেন ছিল একটি রাজতান্ত্রিক দুর্বল রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের রাজনীতি মূলত চালিত হত জমিদার এবং সামন্তপ্রভুদের দ্বারা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্পেন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে স্পেনের শাসনভার পরিচালিত হত বুরবোঁ রাজবংশীয় রাজা ত্রয়োদশ অ্যালফানসো দ্বারা।
যুদ্ধের পর রাজনৈতিক এবং ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চাপে স্পেনে অচলাঅবস্থা তৈরি হয়। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে পাঁচ বার দেশের মন্ত্রীসভা পরিবর্তিত হয়। এই অচলাবস্থার মাঝে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক প্রশাসক প্রাইমো – ডি – রিভেরা স্পেনের শাসনভার দখল করেন। তিনি পার্লামেন্ট দখল করে, নিজেকে একনায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে প্রবল জনরোষের সামনে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
স্পেনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণ মানুষ তাদের নীতিতে খুশি হলেও, স্পেনের অভিজাত শ্রেণি এবং দক্ষিনপন্থীরা অখুশি ছিলেন। তাদের ক্রমাগত বিরোধীতার ফলে দেশে আবার অচলাবস্থা ফিরে আসে। এরপাশাপাশি বিশ্ব মহামন্দার প্রভাবেও স্পেনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে আবার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দক্ষিনপন্থীরা নির্বাচিত হন। কিন্তু তাদের নীতি এবং কার্যকলাপের ফলে দেশে বিক্ষোভ, ধর্মঘটের সৃষ্টি হলে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রপতি জামোরা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন সরকার গঠনের ডাক দেন।
পপুলার ফ্রন্ট গঠন ও বিক্ষোভ
১৯৩৬ এর নির্বাচনে প্রজাতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টরা জোট গঠন করেন, এই জোটের নামকরণ হয় ‘পপুলার ফ্রন্ট’। বিরোধীপক্ষ অর্থাৎ দক্ষিনপন্থী দলগুলি প্রথম থেকে এই পপুলার ফ্রন্টের বিরোধিতা করেন এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ সঙ্ঘটিত হয়। এই অবস্থায় সরকারের অনুগত্যহীনতার অভিযোগে বেশ কয়েকজন সামরিক আধিকারিকদের বরখাস্ত করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জেনারেল ফ্রাঙ্কো, তাঁকে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসিত করা হয়।
এইপ্রকার নানাবিধ কারণে স্পেনের সামরিক বিভাগে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মরক্কোয় অবস্থিত সেনাদল প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং জেনারেল ফ্রাঙ্কো এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ
সমগ্র দেশ দুটি দলে ভাগ হয়ে যায়, প্রথম দল প্রজাতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্ট জোট অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রি সরকারকে সমর্থন করে। অপরদল অর্থাৎ বিভিন্ন দক্ষিনপন্থী দল, যাজক সম্প্রদায়, শিল্পপতি ও ভূস্বামীরা জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে সমর্থন করেন এই দলকে জাতীয়তাবাদী হিসাবে পরিচিতি দেওয়া হত।
দুটি দলের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে, তিন বছর যুদ্ধ চলার পর জেনারেল ফ্রাঙ্কোর দলের যুদ্ধে বিজয়ী হয়।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব
স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়। তবে স্পেনের গৃহযুদ্ধের আঁচ কিন্তু কেবলমাত্র স্পেনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এর আঁচে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও উতপ্ত হয়েছিল। ঐতিহাসিক ল্যাংসাম, স্পেনের এই গৃহযুদ্ধকে ‘ক্ষুদে বিশ্বযুদ্ধ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
এর কারন –
ক) স্পেনে কমিউনিস্ট আন্দোলনের আশঙ্কা করে হিটলার শাসিত জার্মানি এবং মুসোলিনি শাসিত ইতালি ফ্রাঙ্কোকে সমর্থন করেন। প্রায় ৫০ হাজার ইতালীয় স্বেচ্ছাসেবক এবং জার্মানির অস্ত্রভাণ্ডারের সাহায্য পায় ফ্রাঙ্কোর দল। এই দুই একনায়ক শাসক মনে করেছিলেন যে জেনারেল ফ্রাঙ্কো স্পেনের ক্ষমতা লাভ করলে ইউরোপে ফ্যাসিবাদি শক্তি শক্তিশালী হবে।
খ) কমিউনিস্ট আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করার জন্য রাশিয়ার বলশেভিক সরকার প্রজাতন্ত্রী জোটকে সাহায্য করার জন্য অস্ত্র, সামরিক পরামর্শদাতা দিয়ে সাহায্য করে।
গ) বিশ্বের বহু দেশ ইতালি এবং জার্মানির আগ্রাসন রোধ করার জন্য জোটবদ্ধ হয়। যদিও ইউরোপের অন্যতম দুই শক্তি ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়।
এইভাবে স্পেনের গৃহযুদ্ধ একনায়কতন্ত্র বনাম গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের গুরুত্ব
স্পেনের গৃহযুদ্ধের বেশকিছু গুরুত্ব লক্ষ্যনীয়।
প্রথমত, জেনারেল ফ্রাঙ্কো স্পেনের ক্ষমতা লাভ করলে ফ্যাসিবাদী শক্তি মজবুত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলার তার অস্ত্রভাণ্ডার পরীক্ষার সুযোগ পান।
দ্বিতীয়ত, এই যুদ্ধ সর্বসমক্ষে জাতিসংঘের দুর্বলতা তুলে ধরে।
অধ্যায় সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ বনাম গণতান্ত্রিক আদর্শের সংঘাত
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-His-5-7