বাংলা – নবম শ্রেণি – নোঙর (পদ্য)
লেখক পরিচিতি:
আমাদের পাঠ্যাংশের অন্তর্গত ‘নোঙর’ কবিতাটি কবি অজিত দত্তের লেখা ‘সাদা মেঘ কালো পাহাড়’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। কবি অজিত দত্ত উনবিংশ শতাব্দীর এক বিশিষ্ট কবি। দীর্ঘকাল অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বহু সাহিত্য পত্রিকার প্রধান লেখক ছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল – ‘কুসুমের মাস’, ‘পাতালকন্যা’, ‘নষ্টচাঁদ’ ইত্যাদি।
[আরো পড়ো – ‘নোঙর’ কবিতায় নোঙর কিসের প্রতীক?]
কবিতাটির নামকরণ:
‘নোঙর’ একটি রূপকধর্মী কবিতা। এখানে ‘বাণিজ্যতরী’ কবির জীবন, ‘পণ্য’ হল কবির মনের দুর্জয় আকাংখা, বিশ্বের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করার বুক ভরা ইচ্ছা, ‘নোঙর’ হল তার জীবনের সামাজিক বন্ধন, যা তাঁকে আটকে রেখেছে। ‘নদীর স্রোত’ হল বহির্বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ, যা কবির মনকে বারে-বারে আন্দোলিত করেছে।
নোঙর কি?
নোঙর একটি ধাতব যন্ত্র বিশেষ যার লম্বা ধাতব অংশের সাথে অনেকগুলো বর্শার ফলরা মত অংশ থাকে। এই সূঁচালো অংশটি নদীর বা সমুদ্রের কিনারে মাটিতে আটকানো থাকে এবং লম্বা হাতের মতো অংশের সাথে নৌকা বা জাহাজের কাছি লাগানো থাকে। সেই কাছির আরেক প্রান্ত লাগানো থাকে জাহাজ বা নৌকার সাথে। যদি কোনো জাহাজ বা নৌকা এভাবে তীরে ‘নোঙর’ দিয়ে আবদ্ধ থাকে, তবে যতই স্রোত আসুক না কেন, যতই জোয়ারের জল নৌকাকে ধাক্কা মারুক না কেন, যতই মাস্তুল ফুলে ফেঁপে উঠুক না কেন, নৌকা স্থানচ্যুত হয় না।
নোঙর কবিতাটির সারাংশ
কবিতাটির আক্ষরিক অর্থ হল, বহুদূর সপ্তসিন্ধুপারে যাবার জন্য প্রস্তুত পণ্য সামগ্রীভরা কবির বাণিজ্যতরী নদীর তটের কাছে বাঁধা পড়ে আছে। নদীর স্রোত, হাজার দাঁড় বাওয়া, জোয়ারের ঢেউ বা মাস্তুলের হাওয়া কোনো কিছুই নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের বুকে ভাসাতে পারে না। কারণ নৌকাটির নোঙর মাটিতে প্রোথিত হয়ে থাকায় নৌকাটি একই স্থানে আবদ্ধ থাকে।
এই রূপকধর্মী কবিতাটিতে কবির মন সিন্ধুপার অর্থাৎ বহু দূরের জগতের ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য উদ্বেল হয়ে উঠেছে। তিনি সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টাও করছেন। সারারাত তাঁর মনের মধ্যে অনুরণিত হতে থাকে বিশেষ কিছু করার স্বপ্ন, যা কবিতায় ‘সারারাত দাঁড় টানার’ সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
জোয়ারের সময় নদীর জলরাশি স্ফীত হয়ে ওঠে। তটে বাঁধা নৌকাকে নদীর স্রোত আঘাত করে, কিন্তু নৌকা নোঙর দিয়ে বাঁধা থাকার কারণে স্রোত নৌকাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।
স্রোতগুলি তরীকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে সমুদ্রের দিকে বয়ে চলে। ঠিক তেমনি কবির মনও সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কিছু করার ইচ্ছা, জোয়ারের জলের মতোই বার বার মনের তন্ত্রীতে আঘাত করতে থাকে। কিন্তু সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ জীবনতরীকে স্থানচ্যুত করতে পারে না । ঘটনা প্রবাহ অবিরাম তার পরিণতির দিকে ছুটে চলে।
জোয়ারের বিপরীতে ভাঁটার অবস্থান। জোয়ারের জল স্ফীতি ভাঁটায় অন্তর্হিত। স্রোতের দুর্দমনীয় গতিপথ হয় রুদ্ধ। তেমনই কবির মনের প্রবল ইচ্ছেকে কার্যকর করতে না পারার অসহায়তা কবি মনকে করে তোলে ম্রিয়মান, যা হল কবিতায় বর্ণিত ‘ভাঁটার শোষণ’। সাংসারিক জীবন তটে আবদ্ধ কবির জীবন তরী জোয়ার ভাঁটার স্রোতে আন্দোলিত হয়। কবির মনের ইচ্ছেকে বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হয় সামাজিক বন্ধন স্বরূপ নোঙরের কাছে।
‘মাস্তুল’ হল নৌকার মাথায় কাঠের অংশ বিশেষ, যার সঙ্গে কাপড় (পাল) বেঁধে দেওয়া হয়, যখন হাওয়া বইতে থাকে, নৌকাও তর তর করে সেই হাওয়ার সঙ্গে এগিয়ে যেতে থাকে। খুব জোরে হাওয়া দিলেও, পালে হাওয়া লাগলেও নোঙরে বাঁধা নৌকা একই জায়গায় স্থির থাকে। বিভিন্ন দায়িত্ব ভারে কবি এতই নিমজ্জিত যে মাস্তুলের হাওয়া অর্থাৎ সুগভীর সুদূরের আহ্বানও তাঁকে অজানার পথে এগিয়ে যেতে দেয় না।
কবির গভীর চিন্তার নিজস্ব মুহূর্তগুলিতে সাগর গর্জন অর্থাৎ সুদূরের আহ্বান তাঁর মনকে আকুল করে তোলে। প্রতিবারই তাঁর ইচ্ছা করে বাইরের জগতের ডাকে সাড়া দিয়ে বর্তমানকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।
আগেকার দিনে জলপথে পরিভ্রমণ করার সময় নাবিকেরা আকাশে উপস্থিত ধ্রুবতারা বা অন্যান্য তারার মাধ্যমে দিক নির্ণয় করে জাহাজ চালনা করত।
নবম শ্রেণির অন্যান্য বিভাগগুলি দেখুন –
- নবম শ্রেণি – বাংলা
- নবম শ্রেণি – ইতিহাস
- নবম শ্রেণি – ভূগোল
- নবম শ্রেণি – ভৌতবিজ্ঞান
- নবম শ্রেণি – জীবনবিজ্ঞান
- নবম শ্রেণি – গণিত
এখানে কবি বলতে চাইছেন, তিনিও যতবারই বাইরের জগতে বা বহির্বিশ্বে পদার্পনের লক্ষ্য স্থির করেন। মনের মধ্যে ততই অচেনাকে চেনা, দুর্জয়কে জয় করার ইচ্ছা অনবরত দাঁড় (প্রচেষ্টা) টানতে থাকে। কিন্তু যতই কবি তাঁর ‘লক্ষ্য’ স্থির করুন না কেন, তবুও না না সামাজিক বন্ধন কবিকে তাঁর সেই নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌছাতে দেয় না।
আমাদের পরিচিত ক্ষুদ্র – সাধারণ জীবনের বাইরে আছে এক বিশাল জগৎ, যা মানুষের মনকে অবিরাম হাতছানি দিয়ে ডাকে। কিন্তু বহু বন্ধনে আবদ্ধ জীবন, স্নেহ মায়া মমতার বন্ধন কাটিয়ে অনির্দিষ্ট সমুদ্রযাত্রায় অংশ গ্রহণ করতে পারে না। ঠিক যেমন নোঙর দ্বারা আবদ্ধ নৌকা, প্রবল স্রোতেও যা নৌকাকে স্থানচ্যুত হতে দেয় না। নদীর তটের মায়া কাটিয়ে তরী ‘সপ্তসিন্ধুপার’ অর্থাৎ দূরের জগতে যেতে পারে না।
কবিতার বিস্তারিত আলোচনা↓
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX_Beng_Nongor