ইতিহাস– নবম শ্রেণি – বিশ শতকে ইউরোপ (চতুর্থ পর্ব)
আগের পর্বে আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ভার্সাই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা বিশ শতকের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, বিজয়ী দেশগুলির মধ্যে আমেরিকার অর্থনীতি ভীষণভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ এবং সাধারণ জনগণ মনে করতে শুরু করেন যে, এই অর্থনৈতিক তীব্রতার দীর্ঘদিন কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু এই অনুমানকে মিথ্যা প্রমাণিত করে, ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকার শেয়ার বাজারে (ওয়াল স্ট্রিট) ধস নামে। বাজারের এই অপ্রত্যাশিত পতন দেখে বিনিয়োগকারীরা ভীত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন।
শুধু তাই নয়, বাজারের পতন দেখে চিন্তিত হয়ে আমেরিকান জনগণ ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা তুলতে শুরু করেন। ব্যাংকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ মজুত না থাকার কারণে ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে ৫৭০০টি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায় এবং ৩৫০০০টি ব্যাংক তাদের কাজকর্ম বন্ধ রাখে। মার্কিন অর্থনীতি ভেঙে পড়ে এবং এর প্রভাব ইউরোপ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
মহামন্দার কারণ
১৯২১ সালের আমেরিকার মহামন্দার কারণনিয়ে বিতর্ক থাকলেও কয়েকটি কারণে ইতিহাসবিদরা সহমত পোষণ করেন। সেগুলি হল –
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্য ও শিল্পদ্রব্য রপ্তানি করতো। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশে শিল্পউৎপাদন শুরু করে এবং নিজ উৎপাদনে জোর দেয় ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাপ্তানি কমে যায়।
আমেরিকা নিজ উৎপাদিত শিল্পপণ্য বেশি বিক্রির তাগিদে বিদেশী পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করে, অনুরূপভাবে অন্য দেশগুলিও মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করে। এর ফলে বিদেশের বাজারে মার্কিন পণ্যের বিক্রি হ্রাস পায়।
প্রথমিকভাবে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে মার্কিন শিল্পপতিরা প্রয়োজনের অধিক পণ্য উৎপাদন করে। এরপর বিক্রি কমে গেলে তারা উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয় এবং শ্রমিক ছাঁটাই অথবা বেতন হ্রাস হয়। এই জনগণের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে বাজার আবার বিপর্যস্ত হয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে স্বর্ণবিনিময় মানের অবনতি হয়, এর সরাসরি প্রভাব পড়ে মার্কিন অর্থনীতিতে। আবার অপর দিকে রাশিয়ার নতুন বলসেভিক সরকার, পূর্বতন জারের নেওয়া সমস্ত ঋণ ফেরত দিতে অস্বীকার করে, এর ফলে মিত্র শক্তির দেশগুলি অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত হয় এবং তাদের ঋণ ফেরত দেবার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
মহামন্দার প্রভাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মহামন্দা শুরু হলেও এর প্রভাব ছিল বিশ্বব্যাপী।
প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন হ্রাস পায় এবং শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়। অপর দিকে সরকার বেকারত্ব হ্রাস করার উদ্দেশ্যে রাস্তাঘাট ও বাড়ি নির্মাণের জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ্য করে।
দ্বিতীয়ত, ভার্সাই চুক্তি জার্মানির অর্থনৈতিক কাটামো ভেঙে দেয়, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসাবে জার্মানিকে বিপুল অর্থ বিজয়ী দেশগুলিকে দিতে হত। এই অর্থ তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঋণ নিত। মহামন্দার ফলে আমেরিকার পক্ষে জার্মানিকে অর্থ ঋণ দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই জার্মানি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
তৃতীয়ত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিপুল অর্থ ঋণ নিয়েছিল। এই ঋণ তারা জার্মানির থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া অর্থ থেকে পূরণ করতো। জার্মানির অর্থনৈতিক কাটামো ভেঙে গেলে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশ ক্ষতির মুখে পড়ে।
চতুর্থত, ইউরোপের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে গেলে, এই সুযোগে জার্মানিতে হিটলার এবং ইটালিতে মুসোলিনির মতো একনায়ক শাসকের আবির্ভাব হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ান বা রাশিয়ার সাথে ইউরোপের এবং আমেরিকার সরাসরি কোনো যোগ না থাকার ফলে, রাশিয়ায় মন্দার প্রভাব পড়েনি।
হুভার স্থগিতকরণ
বিশ্বের এই সংকটময় অবস্থায়, মার্কিন রাষ্ট্রপতি হুভার, ১৯৩১ সালের ২০শে জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেয় সব ঋণ পরিশোধ একবছরের জন্য স্থগিত রাখেন, এই ঘটনা হুভার স্থগিতকরণ বা Hoover Moratorium নামে খ্যাত।
ক্ষমতার কেন্দ্র হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান
আমরা জানি, দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের মূল চালিকাশক্তি ছিল ইউরোপের হাতে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই পট পরিবর্তন হতে শুরু করে।
প্রথমদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু প্রথমবিশ্ব যুদ্ধের শেষের দিকে আমেরিকার সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি মিত্রশক্তিকে যুদ্ধে জিততে সাহায্য করেছিল। এরপর থেকেই বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এমনকি, যুদ্ধের পরে যে জাতিসংঘ তৈরি হয়েছিল তা ছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি উর্ড্রো উইলসন মস্তিস্ক প্রসুত। যদিও মার্কিন বিদেশনীতির মূলমন্ত্র ছিল ‘চুড়ান্ত নিরপেক্ষতা এবং সাবধানতা’, তাই তারা জাতিসংঘে যুক্ত না হলেও জাতিসংঘের কাজে বিশেষ সহযোগিতা করতে শুরু করে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে জেনেভা নিরস্ত্রিকরণ সম্মেলনে যোগদান করে এবং বিশ্বের অন্যতম একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে নেতৃত্ব প্রদান করে।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-His-5-d