ইতিহাস– নবম শ্রেণি – উনবিংশ শতকের ইউরোপ – রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী সংঘাত(চতুর্থ পর্ব)
আমরা আগের অধ্যায়ে জেনেছি যে নেপোলিয়নের জার্মানি আক্রমণের আগে সম্পূর্ণ জার্মানি প্রায় তিনশটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। নেপোলিয়ন সম্পূর্ণ জার্মানিকে উনচল্লিশটি রাজ্যে একত্রিত করেন এবং ‘কনফেডারেশন অফ দি রাইন’ নামে নামকরণ করেন।
নেপোলিয়নের পতনের পরে ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত নীতি অনুযায়ী এই ‘কনফেডারেশন অফ দি রাইন’ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু জার্মানির ক্ষেত্রে এই নীতি গৃহীত হয়নি। জার্মানিতে এই ‘রাইন রাষ্ট্রসংঘ’ বজায় থাকে। তবে যে রাজারা নেপোলিয়ন কর্তৃক বিতারিত হয়েছিলেন তারা আবার এই রাষ্ট্রে স্থান পান। অষ্ট্রিয়া এই রাষ্ট্রসঙ্ঘের সভাপতি নিযুক্ত হন।
আমরা আগে এটাও জেনেছি, জার্মানির অন্যতম স্বাধীন এবং শক্তিশালি রাজ্য ছিল প্রাশিয়া। অষ্ট্রিয়া ছিল একটি জার্মানি বহির্ভূত শক্তি। ফলে ভিয়েনা সম্মেলনের পরে অষ্ট্রিয়া জার্মানির চলিকাশক্তিতে রূপান্তরিত হলে দেশের নাগরিক অসন্তুষ্ট হয়।
জার্মান নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের পরিস্ফুটন ঘটে, মূলত বুদ্ধিজীবীদের (অধ্যাপক, দার্শনিক, সাহিত্যিক ইত্যাদি) মাধ্যমে ‘সর্ব জার্মানবাদ বা Pan Germanism’ নামে এক নতুন মতাদর্শের উৎপত্তি হয়। এই মতাদর্শ মূলত ছাত্রদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। এই অধ্যায়ের দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখেছি যে অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ কিভাবে তাঁর পুলিশ ও বাহিনী প্রয়োগ করে এই মতাদর্শ হত্যা করতে চেয়েছিলেন।
ঐক্যবদ্ধ জার্মানির বিস্তারিত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
ফ্রাঙ্কফোর্ট আন্দোলন
শুধু তাই নয়, ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে জার্মানির বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দিলেও মেটারনিখ তা কঠোর হাতে দমন করেন। কিন্তু ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফ্রান্সের ফ্রেব্রুয়ারির বিপ্লব ইউরোপ জুড়ে তার গভীর ছাপ ফেলে। জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াতে গনআন্দোলন শুরু হয়। মেটারনিখ এই বিপ্লব দমন করতে না পেরে ইংল্যান্ড পালিয়ে যান। জার্মান আন্দোলনকারীরা জার্মানির ফ্রাঙ্কফোর্ট শহরে এক প্রতিনিধি সভার আহ্বান করেন। ইতিহাসের পাতায় এই সভা ফ্রাঙ্কফোর্ট আন্দোলন নামে খ্যাত। এই সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র জার্মানিকে একত্রিত করা এবং একক সংবিধান রচনা করা।
জার্মান জাতীয়াতাবাদে প্রাশিয়ার প্রভাব
বিভক্ত জার্মানে প্রাশিয়া রাজ্য ছিল অন্যতম শক্তি। প্রাশিয়া জার্মানিকে একত্রিত করার জন্য দীর্ঘ দিন ধরেই লড়াই চালাচ্ছিল। ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাশিয়ার উদ্যগে জোলভেরাইন নামে যখন একটি শুল্কসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন প্রাশিয়ার ভুমিকা আরো বৃদ্ধি পায়।
[আরো পড়ুন – জোলভেরাইন কাকে বলে।]
বিসমার্ক (Bismarck)
জার্মানকে সংঘটিত করার সবচেয়ে বড় কারিগর ছিলেন এই মানুষটি। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উইলিয়াম প্রাশিয়ার সিংহাসন আরোহণ করলে অটো ফন বিসমার্ক তাঁর প্রধানমন্ত্রী হন।
বিসমার্ক ছিলেন একজন ধুরন্ধর রাজনৈতিক এবং প্রখর কূটনীতিক। তাঁর অন্যতম লক্ষ্য ছিল জার্মানিকে একত্রিত করা কিন্তু তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন রাজতন্ত্র এবং শক্তিশালী সামরিক শক্তির সাহায্যেই একমাত্র সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম থেকেই প্রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে শক্তিশালী করার কাজ শুরু করেন। তাঁর নীতিগুলি ‘রক্ত – লৌহ নীতি’ (Blood and Iron Policy) নামে পরিচিত ছিল। তাঁর সময়ে প্রাশিয়া তিনটি প্রধান যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। এই তিনটি যুদ্ধই জার্মানিকে একত্রিত করার কাজে সাহায্য করেছিল।
প্রথম যুদ্ধ – ডেনমার্কের সাথে যুদ্ধ
স্লেজউইগ এবং হলস্টেন নামক জার্মানির দুটি প্রদেশ প্রাথমিক ভাবে ডেনমার্কের অন্তর্গত ছিল এবং এটি আইনত স্বীকৃত ছিল। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ডেনমার্কের রাজা এই প্রদেশদুটি ডেনমার্কের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে প্রাশিয়ার বিরোধ করে; যুদ্ধ শুরু হয়।
এখানে একটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয় বিসমার্ক খুব ভালোভাবেই জানতেন যে জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়ার প্রভাব কমাতে না পারলে জার্মানিকে একত্রিত করা সম্ভব নয়। তা স্বত্বেও ডেনমার্কের সাথে যুদ্ধে প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়ার সাহায্য চায় এবং অস্ট্রিয়া তা গ্রহণ করে। এই যুগ্মবাহিনীর হাতে ডেনমার্কের পরাজয় হয়। ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ খ্রিসচিয়ান ভিয়েনা চুক্তির (১৮৬৪) সাহায্যে স্লেজউইগ এবং হলস্টেন থেকে ডেনমার্কের দাবী প্রত্যাহার করেন।
মজার ব্যাপার এই স্লেজউইগ এবং হলস্টেন জার্মানি না অস্ট্রিয়া কার দখলে আসবে তা নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। প্রাথমিক ভাবে এই বিবাদ মিটে গেলেও পরবর্তীতে এই বিবাদ যুদ্ধের দিকে গড়ায়।
দ্বিতীয় যুদ্ধ – অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধ
বিসমার্কের মূল লক্ষ্য ছিল অস্ট্রিয়াকে জার্মানিতে দুর্বল করা। যুদ্ধ বাঁধলে অস্ট্রিয়া যাতে অন্য কোন রাষ্ট্রের থেকে সাহায্য না পায়, তাই বিসমার্ক কূটনৈতিক ভাবে ফ্রান্সকে নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য করেন। অপর দিকে ইতালির শত্রু দেশ অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জার্মানি ইতালিকেও তাদের পাশে পায়।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রাশিয়া অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ স্যাডোয়ার যুদ্ধ নামে খ্যাত; অস্ট্রিয়া এই যুদ্ধে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের ফলে অস্ট্রিয়া এবং প্রাশিয়ার মধ্যে প্রাগের সন্ধি সাক্ষরিত হয়। এর ফলে জার্মান রাষ্ট্রসংঘের বিলুপ্তি ঘটে। প্রাশিয়ার নেতৃত্বে উত্তর জার্মানি গঠিত হয়। অপরদিকে ইতালি ভেনিশিয়া প্রদেশ লাভ করে।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
তৃতীয় যুদ্ধ – ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ
উত্তর জার্মানি সংঘবদ্ধ হলেও দক্ষিন জার্মানি তখনও বিভক্ত ছিল। দক্ষিন জার্মানিতে ফ্রান্সের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তাই দক্ষিন জার্মানিকে একত্রিত করার জন্য প্রাশিয়ার ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল। বিসমার্ক এই জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
এদিকে অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধে যোগদান না করা ছিল ফ্রান্সের একটি ভুল। এই যুদ্ধের ফলে প্রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পায়, ফ্রান্স সম্রাট এতে যথেষ্ট চিন্তান্বিত হন। পরবর্তী সময়ে স্পেনের রাজ সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এর ফল ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার যুদ্ধের মধ্যে পড়ে।
এমস্ টেলিগ্রাম
স্পেনের রানি ইসাবেলা গনআন্দোলনের ফলে বিতারিত হলে স্পেনবাসী প্রাশিয়ার রাজবংশীয় (হোহেনজোলার্ন ) প্রিন্স লিওপোল্ডকে স্পেনের রাজ সিংহাসনে বসার জন্য অনুরোধ করেন। প্রাশিয়া বংশদ্ভুত রাজা স্পেনের শাসক হলে, প্রাশিয়ার আরো শক্তিবৃদ্ধি হবে এবং এর ফলে ফ্রান্সের সার্বভৌমত্ব খর্ব হতে পারে এই ভেবে ফ্রান্স স্পেনবাসীর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।
ফ্রান্সের আপত্তির কারণে লিওপোল্ড রাজা হবার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। কিন্তু তাতেও ফ্রান্সের সম্রাট আশ্বস্ত হতে পারলেন না, তিনি ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত কাউন্ট বেনিদিতি-কে এমস্ নামক স্থানে প্রাশিয়ার সম্রাটের কাছে পাঠালেন।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
বেনিদিতির উদ্দেশ্য ছিল প্রাশিয়া সম্রাট উইলিয়ামের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়, যে তিনি কোনভাবেই লিওপোল্ডকে ভবিষ্যতে স্পেনের ক্ষমতা দখলে সাহায্য করবেন না। প্রাশিয়া সম্রাট এই দাবী মানতে অসম্মত হন। রাষ্ট্রদূত বেনিদিতির সম্রাটের সাথে হওয়া কথোপকথন এমস্ থেকে টেলিগ্রাম মারফৎ প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক-কে জানান। দক্ষ কূটনৈতিক বিসমার্ক এই সুযোগের ব্যবহার করেন। বিসমার্ক ঐ টেলিগ্রামের কিছু অংশ বাদ দিয়ে প্রাশিয়ার সংবাদপত্রে ছাপিয়ে দেন; যার মর্ম দাড়ায় এই যে প্রাশিয়ার সম্রাট ফ্রান্স রাষ্ট্রদূতকে অপমান করেছেন। ফ্রান্সে এই ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং এটি যুদ্ধ অবধি গড়ায়।
এই ঘটনা ইতিহাসে এমস টেলিগ্রাম নামে খ্যাত।
সেডানের যুদ্ধ
ফ্রান্সের জনগনের দাবীতে ফ্রান্স সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন প্রাশিয়া আক্রমণ করেন, এই যুদ্ধ সেডানের যুদ্ধ (১৮৭০) নামে খ্যাত । কিন্তু অযাচিত এই আক্রমণের ফলে ফ্রান্স অন্য কোন দেশের সমর্থন লাভ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু প্রাশিয়া ইতালির সমর্থন লাভ করে। তাদের সৈন্যবাহিনীর কাছে ফ্রান্সের বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় হয়। এমনকি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন নিজে বন্দী হন। যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।
অতঃপর ফ্রান্স এবং প্রাশিয়ার মধ্যে ফ্রাঙ্ক ফোর্টের সন্ধি হয়। এর ফলে ফ্রান্স, এলসাস এবং লোরেন প্রাশিয়াকে দিতে বাধ্য হয় এবং তাদের প্রচুর আর্থিক ক্ষতিপুরন দিতে হয়। প্রাশিয়ার দক্ষিণ জার্মানি দখল করার আর কোন বাঁধা থাকে না।
অবশেষে জার্মানি ঐক্যবন্ধ হয় এবং প্রাশিয়া সম্রাট প্রথম উইলিয়াম জার্মানির সম্রাট বা কাইজার উপাধিতে ভূষিত হন।
পরবর্তী পর্ব – অটোমান সাম্রাজ্য এবং বলকান জাতিয়াতাবাদ ।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-His-3D