সহজে ব্যাকরণ সিরিজ (ত্রয়োদশ পর্ব) – কারকের প্রকারভেদ
এসে গেছি বন্ধুরা, আগের পর্বে আমরা কারকের ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা কারকের ছয়টি প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করব।
কর্তৃকারক
কর্তৃকারকের ক্ষেত্রে প্রথমে আমাদের জেনে নিতে হবে চারটি ভাগ –
প্রযোজক কর্তা ও প্রযোজ্য কর্তা
আমরা অনেকেই সিনেমা দেখি। তা সিনেমা করতে তো অনেক টাকা লাগে। সেই টাকা দেয় কে? পরিচালক? না, একদমই না। পরিচালকের কাজ শুধু সিনেমাটা ভালোভাবে তৈরি করা। টাকা যা লাগে তা কিন্তু দেয় অন্য একজন যাকে বলা হয় প্রযোজক বা প্রোডিউসার।
তার মানে কি হল?
যে টাকা দিয়ে কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করায় তাকেই প্রযোজক বলে। ঠিক এই ধারণাটা মাথায় রেখেই বুঝে ফেলা যায় প্রযোজক কর্তা। বাক্যে কোনো কর্তা যদি অন্য কর্তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়, তাহলে যে কর্তা কাজ করাচ্ছে তাকে আমরা বলবো প্রযোজক কর্তা আর যে কাজ করছে বা যাকে দিয়ে করানো হচ্ছে তাকে বলা হবে প্রযোজ্য কর্তা।
যেমন ধরো –
মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন।
এই বাক্যে দুটি কর্তা আছে বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই- মা এবং শিশু। এখন চাঁদ দেখানোটা হল ক্রিয়া বা কাজ। সেটা মা করাচ্ছেন বলে ‘মা’ এখানে প্রযোজক কর্তা আর ‘শিশু’ যেহেতু চাঁদ দেখছে সে হল প্রযোজ্য কর্তা। একইরকমভাবে করে দেখো –
শিক্ষক আমাদের ইংরেজি পড়াচ্ছেন।
এই বাক্যের কর্তাদুটি তোমরা নিজেরা নির্ণয় করার চেষ্টা করে দেখো।
সমধাতুজ কর্তা
এই শব্দটা ভালোভাবে লক্ষ করো। ‘সমধাতুজ’ কথার অর্থ হল একই ধাতু থেকে উৎপন্ন বা জাত। এখন আমরা সকলেই জেনে গিয়েছি যে ক্রিয়া তৈরি হয় ধাতু থেকে। যদি কোনো বাক্যে দেখা যায় এমন যে, বাক্যের ক্রিয়া যে ধাতু থেকে তৈরি হয়েছে সেই একই ধাতু থেকে ক্রিয়ার কর্তাও তৈরি হয়েছে। তখন ঐ বিশেষ কর্তাটিকে বলা হবে সমধাতুজ কর্তা।
সহজ করে বললে বাক্যের ক্রিয়া এবং বিশেষ্য একই ধাতু থেকে তৈরি হলে সেই বিশেষ্যটি হবে কর্তা আর তাকেই বলা হবে সমধাতুজ কর্তা।
যেমন ধরো –
রাঁধুনি হয়েছ আর শুক্তো রাঁধতে পারো না?
এই বাক্যে দেখো লাল রঙে চিহ্নিত হয়ে আছে বিশেষ্য আর ক্রিয়াটি। দুটি কিন্তু একই ধাতু থেকে তৈরি – রাঁধ্। তাই প্রথমে যে বিশেষ্যটি বাক্যের কর্তা হিসেবে বসেছে তাকেই বলা হবে সমধাতুজ কর্তা। এরকম আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যায় –
এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে।
এখানেও একইরকমভাবে ‘ঘট্’ ধাতু থেকে ‘ঘটনা’ বিশেষ্য আর ‘ঘটে’ ক্রিয়া তৈরি হয়েছে বলে ঘটনা পদটি হবে সমধাতুজ কর্তা।
নিরপেক্ষ কর্তা
এখানে আগে একটা বিষয় জেনে নিতে হবে। আশা করি তোমরা সকলেই ক্রিয়ার ক্লাসটি করেছো। সেখানে আমি বলেছিলাম, ক্রিয়া দুই প্রকারের হয় – সমাপিকা আর অসমাপিকা। যদি ভুলে গিয়ে থাকো আরেকবার ক্রিয়া ক্লাসটিতে ফিরে গিয়ে দেখে নিতে পারো। তা সেই দুই প্রকার ক্রিয়াই যদি একটি বাক্যে থাকে আর কোনো সময় যদি সমাপিকা এবং অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা ভিন্ন হয় তাহলে অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তাকে আমরা নিরপেক্ষ কর্তা বলবো। ব্যাপারটা সহজে বোঝা গেল না নিশ্চয়ই।
দাঁড়াও আগে উদাহরণটা দেখো –
তুমি চলে গেলে আমি বাড়ি দেখাশুনা করবো।
এই বাক্যে সমাপিকা ক্রিয়া হল ‘দেখাশুনা করবো’ আর এই সমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা ‘আমি’। অন্যদিকে অসমাপিকা ক্রিয়াটি হল ‘চলে গেলে’ আর এই অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা হল ‘তুমি’।
এখন বুঝতে হবে যে বাক্যে তুমি না থাকলেও বাক্যের অর্থ সেভাবে বদলাবে না। অর্থাৎ ‘তুমি চলে গেলে’ এই অংশটা বাক্যের ক্ষেত্রে বিশেষ জরুরি না হলেও এর উপরেই সমাপিকা ক্রিয়া নির্ভরশীল। তাই অসমাপিকা ক্রিয়া এখানে নিরপেক্ষ। এর কোনো দায়িত্ব নেই। তাই এই বাক্যে ‘তুমি’ হল নিরপেক্ষ কর্তা। আশা করি বুঝতে পেরেছো।
এই চারটি ছাড়াও আরো দুইটি প্রকারভেদ রয়েছে কর্তৃকারকের। একটিকে বলে অনুক্ত কর্তা আর অন্যটি হল ব্যতিহার কর্তা। তোমরা যখন বাচ্য শিখবে, সেখানে জানবে ভাববাচ্য বলে একটি বিষয় আছে। এই বাচ্যে একটি উক্তিকেই ঘুরিয়ে বলা হয়। সেইসব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে কর্তা থাকে না। ঐ কর্তাকে ব্যাকরণে বলা হয় অনুক্ত কর্তা।
যেমন – তোমার খাওয়া হয়ে গেছে।
এখানে তুমি খেয়ে নিয়েছ না বলে অন্যভাবে বলা হল বলে ‘তুমি’ কর্তার বদলে ‘তোমার’ এসে কর্তার প্রাধান্য খানিক কমিয়ে দিল। তাই এই বাক্যে ‘তোমার’ হল অনুক্ত কর্তা। আবার একের বেশি কর্তা যদি একই কাজে নিযুক্ত হয়, তখন তাকে বলা হয় ব্যতিহার কর্তা। মনে রাখার সুবিধের জন্য, ব্যতিহার মানে ধরে নেবে জোড়া।
উদাহরণে চোখ রাখো – রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়।
আরো পড়ো→ ধ্বনির ধারণা | বর্ণ | বাক্য | সন্ধি
এখানে একই কর্তা দুবার পরপর প্রযুক্ত হয়েছে একই কাজে, তাই ‘রাজায় রাজায়’ হয়ে গেল ব্যতিহার কর্তা।
সবশেষে বলতে হয় উহ্য কর্তার কথা। এটা খুবই সহজ। বাক্যে কর্তা নেই, তাকে দেখা না গেলেও তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় যদি তাহলে সেই অদৃশ্য কর্তাকেই উহ্য কর্তা বলা হয়। এমন অনেক বাক্য আমরা বলি, বিশেষত আদেশ-অনুরোধ-উপদেশের ক্ষেত্রে এই উহ্য কর্তা দেখা যায়।
যেমন – (তুমি) পড়তে বোসো।
(তুমি) রোদে দৌড়িও না।
(আপনি) ভিতরে আসুন।
উপরের প্রতিটি বাক্যেই ব্র্যাকেটে লেখা কর্তা না থেকেও নেই। তাই ঐগুলি হল উহ্য কর্তা।
কর্মকারক
এরপরে আমরা দেখে নিই কর্মকারকের ভাগগুলি। এখানেও সেই চারটি ভাগ রয়েছে। চলো দেখে নিই।
মুখ্য কর্ম ও গৌণ কর্ম
যে ক্রিয়ার কর্ম থাকে তাকে আমরা কী বলি? মনে আছে? সকর্মক ক্রিয়া। এই সকর্মক ক্রিয়ারই দুই প্রকার কর্ম থাকে – মুখ্য কর্ম এবং গৌণ কর্ম। সহজভাবে বললে এই কর্মের একটি প্রাণীবাচক এবং অন্যটি বস্তুবাচক। প্রাণীবাচক কর্মটি হল গৌণ কর্ম আর বস্তুবাচক কর্মটি হল মুখ্য কর্ম। মুখ্য কর্মে কোনো বিভক্তি না থাকলেও, গৌণ কর্মে বিভক্তি থাকে।
একটা উদাহরণ দেখে নিই চলো –
তুমি আমাকে বইটি দাও।
এই বাক্যে কর্ম দুটি। কীভাবে নির্ণয় করবে কর্ম কোনটা? নিশ্চয়ই মনে আছে। বাক্যের ক্রিয়া হল ‘দাও’। এই ক্রিয়াকে দুটি প্রশ্ন করলে দুটি কর্ম পাওয়া যাবে।
কী দাও? – বইটি (বস্তুবাচক – মুখ্য কর্ম)
কাকে দাও? – আমাকে (প্রাণীবাচক – গৌণকর্ম)
তাহলে কীভাবে এই দুই প্রকার কর্ম নির্ণয় করবে আশা করি বুঝতে পেরেছো। এরপরে আমরা আরো ভাগগুলি জেনে নিই চলো।
সমধাতুজ কর্ম
কর্তৃকারকের আলোচনাতেই সমধাতুজ ব্যাপারটা তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তোমরা খুব সহজেই বুঝে নিয়েছিলে। এই কর্মকারকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় একই। কোনো বাক্যের ক্রিয়া আর কর্ম যদি একই ধাতু থেকে উৎপন্ন হয় তাহলে তাকে সমধাতুজ কর্ম বলা হবে।
যেমন –
কী পড়া পড়ছো তুমি?
এমন বাঁচা বেঁচে কী লাভ !
ভালো খেলা খেলেছ।
উপরের সবকটি বাক্যেই দেখা যাচ্ছে পাশাপাশি লাল রঙে চিহ্নিত দুটি করে পদ রয়েছে। প্রথমটি কর্ম আর পরেরটি ক্রিয়া যেগুলি একই ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাই বাক্যগুলিতে বাঁচা, পড়া, খেলা এই পদগুলি হল সমধাতুজ কর্ম।
কর্মের বীপ্সা
সেই যে পড়লে একটু আগে ব্যতিহার মানে জোড়া মনে আছে? সেটা ছিল ব্যতিহার কর্তা। আর একই জিনিস কর্মের ক্ষেত্রে ঘটলে তাকে বলা হয় কর্মের বীপ্সা। বিপাশা নয় কিন্তু। বীপ্সা। অভিধান খুলে দেখবে, ‘বীপ্সা’ কথার মানে কিন্তু ‘পুনরাবৃত্তি’। কীরকম ব্যাপারটা নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে, চলো উদাহরণ দেখো –
সকাল থেকে ছেলেটাকে পড় পড় করে যাচ্ছো, এখন তো একটু ছাড়ো ওকে।
এখানে ঐ পড় পড় হয়ে গেল কর্মের বীপ্সা। কেন কর্মই হল যদি প্রশ্ন করি কী বলবে? আগে দেখো ক্রিয়া কোনটা – ‘করে যাচ্ছো’। এবারে একে ‘কী’ দিয়ে প্রশ্ন করলেই উত্তরে ‘পড় পড়’ পাবে। তাতেই বোঝা গেল যে এটা হল এই বাক্যের কর্ম।
করণ কারক
এবারে চট করে জেনে নেবো করণকারকের ভাগগুলি। এই করণের ক্ষেত্রে একটা মজা আছে। এখানে তো চেনার নিয়ম হল আগেই বলেছি ‘কী দিয়ে’ প্রশ্ন করতে হবে ক্রিয়াকে। এখন এই যা দিয়ে করা হচ্ছে কোনো কাজ, সেটা কী প্রকার তাই দিয়েই ভাগগুলি তৈরি। তাই বোঝা বা মনে রাখা জলের মতন সহজ।
উদাহরণগুলিতে লাল রঙে চিহ্নিত শব্দগুলিই একেকপ্রকারের করণ কারক। আশা করি এভাবে তালিকার মাধ্যমে খুব সহজেই বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে তোমাদের কাছে। এবারে শেষ পর্যায়ে আমরা এসে গিয়েছি। শুধুমাত্র দুটি কারকের ভাগ জানলেই আমাদের কারকের ক্লাস সম্পূর্ণ হবে। আর তারপরই তোমাদের ছুটি।
অপাদান কারক ও অধিকরণ কারক
তবে যাবার আগে, জেনে নাও অপাদান আর অধিকরণ কারকের সম্পর্কে। এই যে অপাদান যা কেবল ‘থেকে’ অনুসর্গের ইঙ্গিত দিয়ে চিহ্নিত হয় তাও কিন্তু চার প্রকার হয়ে থাকে –
আর অধিকরণ কারকের ক্ষেত্রেও এইরকম তিনটি প্রধান ভাগ রয়েছে। স্থান বোঝালে স্থানাধিকরণ, সময় বোঝালে সময়াধিকরণ বা কালাধিকরণ আর প্রকার তথা বিষয় বোঝালে বিষয়াধিকরণ হয়ে থাকে।
তিন প্রকার কারকেরই উদাহরণগুলি খেয়াল করো, তাহলেই বুঝতে পারবে।
আরো পড়ো→ সর্বনাম | বিশেষণ | ক্রিয়া | ধাতু
ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে। (ঘর – স্থান / স্থানাধিকরণ)
তনিমা ফিরবে সেই কাল সকালে। (সকাল – সময় / কালাধিকরণ)
ইংরেজিতে চোস্ত হলে কি হবে, বাংলাটাই ভালো বলতে পারে না। (ইংরেজি – বিষয় / বিষয়াধিকরণ)
আশা করি অনায়াসেই তোমরা বিষয়গুলি ধরতে পেরেছো। এবার ব্যাকরণের বই দেখে উদাহরণ দেখে যাও আরো যত পারো, তাহলেই আসল শেখা হবে। আর অভ্যাস তো আবশ্যিক। তাহলেই দেখবে কারক নিয়ে সমস্যা একেবারে সমাধান হয়ে গেছে। এরই মধ্য দিয়ে আজকের সহজে ব্যাকরণের ক্লাসে ছুটি। আবার পরের ক্লাসে চলে আসবো ব্যাকরণ বুঝতে। আমাদের মন্ত্র হবে, সহজ করে বুঝবো, ব্যাকরণ শিখবো। আজকের মতো টাটা বন্ধুরা।
ত্রয়োদশ পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → উপসর্গ ও অনুসর্গ
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখাটি, অডিও, ভিডিও বা অন্য কোন ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতিঃ
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
karok-2