সহজে ব্যাকরণ সিরিজ (চতুর্দশ পর্ব) – উপসর্গ ও অনুসর্গ
কেমন আছো বন্ধুরা? এত দীর্ঘ সময় ধরে তোমাদের সঙ্গে এই সহজে ব্যাকরণের ক্লাসে আমরা কত কিছুই না আলোচনা করেছি। ব্যাকরণের জটিলতাকে যথাসম্ভব উপভোগ্য ও সহজ করে তোমাদের সামনে উপস্থাপন করছিলাম এতদিন। আজ বিদায় জানাতে হবে। সরাসরি ক্লাসে না এলেও যে লেখাগুলি থেকে গেল তার মধ্যে দিয়েই তোমাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে যাবে নিশ্চিত।
আজ সহজে ব্যাকরণের শেষ ক্লাস। আজ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বেশি ভারি কিছু পড়বো না আমরা। আজ জানবো উপসর্গ আর অনুসর্গের বিষয়টা। খুবই সহজ বিষয়। চলো ক্লাস শুরু করা যাক।
দেখো উপসর্গ আর অনুসর্গ বিষয়টা কিন্তু বাংলা ভাষার নিজস্ব নয়। মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকেই এই ধারণাটি বাংলায় এসেছে। তাই এর মূল কাঠামোটি সংস্কৃত ব্যাকরণের মতো, তবে বাংলার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য তোমরা পড়তে গিয়েই খেয়াল করবে।
প্রথমেই জেনে নিতে হবে যে উপসর্গ আর অনুসর্গ আসলে কী?
মনে করে দেখো ইংরেজিতে তোমরা prefix আর suffix-এর নাম শুনেছো। শব্দের আগে যে বর্ণগুচ্ছ বসে তাকে prefix আর পরে যে বর্ণগুচ্ছ বসে তাকে বলে suffix বলা হয়। ঠিক একইরকমভাবে মনে রাখবে উপসর্গ শব্দের আগে বসে আর অনুসর্গ শব্দের পরে বসে। ‘উপ’ কথার মানে হল আগে আর ‘অনু’ মানে হল পরে।
এ তো গেল ধারণা। ব্যাকরণে এর সংজ্ঞা কী দিচ্ছে দেখা যাক।
যে সব শব্দখণ্ড শব্দ বা ধাতুর আগে যুক্ত হয়ে ধাতু বা শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটায় তাকে বলে উপসর্গ। আর যে সকল শব্দ বা অব্যয় বাক্যের মধ্যে বিশেষ্য বা সর্বনামের পরে আলাদাভাবে বসে বিভক্তির কাজ করে তাকে বলা হয় অনুসর্গ।
তাহলে আশা করি প্রাথমিক ধারণাটা পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেছে। এবারে এক করে বিশদে আলোচনা করা যাক।
বন্ধুরা উপসর্গ মূলত তিন প্রকারের হয়ে থাকে।
Ø সংস্কৃত উপসর্গ
Ø বিদেশি উপসর্গ
Ø বাংলা উপসর্গ
আগে একটা উদাহরণ দিয়ে নিই। তাহলে সহজে বুঝতে পারবে। যেমন ধরো ‘হার’ এই শব্দের আগে কত রকম উপসর্গ যুক্ত হয়ে নতুন অর্থযুক্ত শব্দ তৈরি হতে পারে। দেখো তোমরা –
প্র–হার = প্রহার
উপ–হার = উপহার
বি–হার = বিহার
আবার ‘বাদ’ শব্দের সঙ্গেও একইভাবে উপসর্গ যুক্ত হতে পারে। দেখে নেওয়া যাক –
আরো পড়ো→ ধ্বনির ধারণা | বর্ণ | বাক্য | সন্ধি
অপ–বাদ = অপবাদ
বি-বাদ = বিবাদ
বর-বাদ = বরবাদ
প্র-বাদ = প্রবাদ
আ-বাদ = আবাদ
অনু-বাদ = অনুবাদ
তাহলে তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছো কিভাবে উপসর্গ যুক্ত হবার কারণে শব্দের অর্থও বদলে যাচ্ছে। এবারে আমরা উপসর্গের ভাগগুলি দেখে নিই। তোমাদের এতে বুঝতে সুবিধে হবে। সবার প্রথমে বলতে হয় সংস্কৃত উপসর্গের কথা। সংস্কৃত উপসর্গ মূলত কুড়িটি। পরপর সেগুলি নীচে লিখে দেওয়া হল দেখো বন্ধুরা –
প্র, পরা, অপ, সম, নি, অব, অনু, নিঃ, দুঃ, বি, অধি, সু, উৎ, পরি, প্রতি, অভি, অতি, অপি, উপ, আ
এই এতগুলি উপসর্গ কিভাবে শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয় তা একটা তালিকার মাধ্যমে তোমাদের সামনে উপস্থাপন করবো।
বন্ধুরা ভালো করে দেখো রঙিন বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছগুলি সবই হল সংস্কৃত উপসর্গ। এখানে তোমরা বুঝতে পারবে একই উপসর্গ যুক্ত হয়ে কতরকম শব্দ গঠিত হতে পারে। তবে উপরের উদাহরণগুলির মধ্যে দুই জায়গায় উপসর্গ চিহ্নিত করা নেই। সেগুলি নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার।
প্রথমে দেখো সঙ্গত, সমাদর, সংস্কার এগুলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটা সন্ধির মতোই।
সম্-গত = সঙ্গত
সম্-আদর = সমাদর
সম্-কার = সংস্কার
আবার উন্নতি, উচ্ছ্বাস, উদ্ধার এই শব্দগুলির ক্ষেত্রেও সেই একইভাবে সন্ধির মতো উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। দেখে নাও বন্ধুরা।
উৎ-নতি = উন্নতি
উৎ-শ্বাস = উচ্ছ্বাস
উৎ-হার = উদ্ধার
এবারে আমরা জানবো কিছু বিদেশি উপসর্গের ব্যাপারে।বিদেশি উপসর্গ বলতে বাংলা ভাষায় যে সব বিদেশি ভাষার প্রভাব পড়েছে সেইখান থেকেই কিছু বর্ণগুচ্ছ উপসর্গ হিসেবে বাংলায় ব্যবহৃত হয়েছে। তোমরা এই উপসর্গগুলি সম্পর্কে জানতে পারলে বিদেশি শব্দগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা পাবে। দেখে নাও বন্ধুরা –
এখানেও একইভাবে রঙিন বর্ণগুচ্ছগুলি হল বিদেশি উপসর্গ। আর উপরের উদাহরণের সকল শব্দই বিদেশি শব্দ যা আমরা বাংলায় স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করি। আর সবার শেষে রয়েছে বাংলা মৌলিক উপসর্গ। এই উপসর্গগুলি একেবারে স্বতন্ত্র। বাংলা ভাষার নিজস্ব। অ, আ, অনা, কু, সু, না, নি, বি, পাতি, হা, ভর, রাম এসবই বাংলা উপসর্গের দৃষ্টান্ত। এবারে দেখে নেওয়া যাক কিভাবে শব্দের মধ্যে এগুলি ব্যবহৃত হয়।
এই হল আমাদের উপসর্গ। আশা করি তোমরা এই উদাহরণগুলি দেখে পুরো বিষয়টা ভালো মতো বুঝতে পেরেছ। এরপরে চল দেখে নিই অনুসর্গ কী জিনিস।
উপসর্গের ঠিক উলটো এই অনুসর্গ।
আগেই বলেছি অনুসর্গ আলাদা শব্দ হিসেবে বিশেষ্য বা বিশেষণের পরে বসে। এই অনুসর্গের আরো দুটি নাম রয়েছে। কখনো একেক বলা হয় কর্মপ্রবচনীয় আবার কখনো পরসর্গও বলা হয়। শব্দের পরে যুক্ত হয় বলে এর নাম পরসর্গ। কিন্তু কর্মপ্রবচনীয় বলার কারণ হল এগুলি বাক্যের কর্মের প্রসারক হিসেবে কাজ করে। এখন এই অনুসর্গের ক্ষেত্রেও কিন্তু মূলত তিনটি ভাগ লক্ষ্য করা যায় উপসর্গের মতো। তবে ভাগগুলি একটু আলাদা। চলো দেখে নিই।
Ø শব্দজাত অনুসর্গ –
প্রতি, জন্য, অপেক্ষা, নিমিত্ত, বিনা
Ø ক্রিয়াজাত অনুসর্গ –
করে, বলে, হতে, ধরে
Ø বিদেশি অনুসর্গ –
বরাবর, বাদে, দরুণ, বনাম
তবে এছাড়াও আরো কিছু ভাগ দেখা যায় অনুসর্গের মধ্যে। যেমন – অপেক্ষা, অভিমুখে, উপরে, কর্তৃক ইত্যাদিকে বলা হয়ে থাকে সংস্কৃত উপসর্গ। আবার মজার বিষয় হল একই অনুসর্গ বাক্যে কোন পদের পরে বসছে তার উপর নির্ভর করে তার প্রকারভেদ বদলে যায়। দেখে নাও মজাটা।
‘চেয়ে’ অনুসর্গটি বিভিন্নভাবে বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত হতে পারে।
উদাহরণ দেখো –
প্রাণের চেয়ে প্রিয়, আমার চেয়ে বড়, মন্দের চেয়ে ভালো
এই উদাহরণগুলিতে প্রথমটিতে প্রাণ হল বিশেষ্য, আমার হল সর্বনাম আর মন্দের হল বিশেষণ। ফলে বুঝতেই পারছো একই অনুসর্গ একবার বিশেষ্য, একবার বিশেষণ আর একবার সর্বনামের পরে বসছে বলে একে কখনো বিশেষ্য অনুসর্গ, কখনো বিশেষণ অনুসর্গ আর কখনো বা সর্বনাম অনুসর্গ বলা হয়ে থাকে। আবার দেখা গেছে বিভক্তি দিয়ে যেমন কারক নির্ণয় করা যায়, তেমনি অনুসর্গ দিয়েও কারক নির্ণয় করা যায়।
সবশেষে উপসর্গ আর অনুসর্গের কিছু পার্থক্য তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করে আজকের ক্লাস শেষ করবো।
আরো পড়ো→ সর্বনাম | বিশেষণ | ক্রিয়া | ধাতু
উপসর্গ আর অনুসর্গের পার্থক্য
ক. অনুসর্গ বিভক্তির মতো ব্যবহৃত হলেও, উপসর্গ বিভক্তির মতো ব্যবহৃত হয় না।
খ. উপসর্গ স্বাধীন পদ হিসেবে বাক্যে ব্যবহৃত হতে পারে না, অনুসর্গ কিন্তু বাক্যে পৃথকভাবে বসতে পারে।
গ. অনুসর্গের নিজস্ব অর্থ থাকলেও, উপসর্গের কোনো অর্থ নেই।
ঘ. অনুসর্গ শব্দের পরে পৃথকভাবে বসে আর উপসর্গ শব্দের সঙ্গে বিভক্তির মতো যুক্ত হয়ে বসে।
তাহলে সহজে ব্যাকরণের ক্লাস এখানেই শেষ। ভালো থেকো সকলে। ব্যাকরণের এই ক্লাসগুলি কেমন লাগলো তোমাদের জানিও।
চতুর্দশ পর্ব সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখাটি, অডিও, ভিডিও বা অন্য কোন ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতিঃ
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
uposorgo-onusorgo