ইতিহাস – দশম শ্রেণি – বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত) বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা (পর্ব – ১)
গত পর্বে আমরা সাহিত্য ও চিত্রশিল্পে জাতীয়তাবোধের বিচার ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা বাংলার ছাপাখানা সম্পর্কে জানবো।
ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মুদ্রণ শিল্পের বিকাশের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঔপনিবেশিক শাসন সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বাংলাতে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলো ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের চেয়ে আগে প্রবেশ করেছিল। যদিও দেশের মানুষকে শিক্ষিত করার চেয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এক অনুগত কেরানি সম্প্রদায় তৈরী করাই ছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের মূল লক্ষ্য। একে অনেক ঐতিহাসিক ব্রিটিশদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদও বলে থাকেন।
এই আধিপত্যের ভিত্তি কিন্তু ছিল আধুনিক মুদ্রণব্যবস্থা। অচিরেই এই মুদ্রণব্যবস্থার দৌলতেই ভারতের এক বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে চিন্তার প্রসার ঘটলো। বাংলায় উনিশ শতকের নবজাগরণের পশ্চাতে মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভূমিকা কিছু কম ছিল না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই বাঙালিরা মুদ্রণ ব্যবসায় প্রবেশ করে। কালক্রমে মুদ্রণ দুনিয়া হয়ে উঠলো শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের মতবিনিময়ের মাধ্যম।
এর ফল ছিল দ্বিবিধ। একদিকে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে ভদ্রলোক বাঙালি তাদের রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছিল। অন্যদিকে কিছু উদ্যোগী বাঙালির দৌলতে মুদ্রণ মাধ্যম এক সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা করল যা ঔপনিবেশিক সরকারের কপালেও চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়।
বাংলার ছাপাখানা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা↓
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ
তোমাদের কথা প্রসঙ্গে একবার বলেছিলাম যে ইউরোপে আধুনিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশে ছাপাখানা এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
যে মুদ্রণ যন্ত্র ছাপাখানার ভিত্তিস্বরুপ তাঁর প্রবর্তক ছিলেন জার্মানির গুটেনবার্গ। সেই ছাপাখানা ভারতে প্রথম এনেছিল পর্তুগীজরা তাদের গোয়ার উপনিবেশে।
অষ্টাদশ শতকের শেষদিকের বাংলায় ৪০ জন ছাপাখানা মালিকের নাম পাওয়া যায়। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ইউরোপীয় এবং কোনো না কোনো সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত। এঁদের মধ্যে জেমস অগাস্টাস হিকির নাম প্রণিধানযোগ্য।
১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘বেঙ্গল গেজেট’ সংবাদপত্রটি ভারতের প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র হিসেবে সুপরিচিত।
প্রথমদিককার ছাপাখানাগুলিতে মূলতঃ ইংরেজি সংবাদপত্রই ছাপা হত।
UPDATE: পড়া মনে রাখার সেরা উপায়↓
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ছাপাখানা
ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুদ্রণ ব্যবস্থা আরো উন্নত হয়। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ছাপাখানার সংখ্যা। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে কলকাতা শহরেই ১৭ টি ছাপাখানার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সমসাময়িক অন্যান্য বিখ্যাত ছাপাখানার মধ্যে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলায় লোকশিক্ষা প্রসারে কিছু খ্রিস্টান মিশনারী উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। উইলিয়াম কেরি যেমন তাঁর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস থেকে ধর্মপুস্তক, নীতিশিক্ষা ও বিদেশী শিশুসাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশ করেন।
শহর ও শহরতলি থেকে যত গ্রামের দিকে শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে তত ক্রমবর্ধমান পুস্তকের চাহিদা মেটানোর জন্য ছাপাখানার সংখ্যাও বাড়তে থাকল। তাই দেখা গেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে বেশি সংখ্যায় নতুন ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময় থেকে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় স্বদেশী উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয়।
শ্রীরামপুর মিশন প্রেস, স্কুল বুক সোসাইটির প্রেস, আদি ব্রাহ্মসমাজ প্রেস, বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের সঙ্গে যুক্ত প্রেস ছাড়াও এইসময় ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু ছাপাখানা গড়ে উঠেছিল।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, দ্বারকানাথ বিদ্যভুষণ, কাঙাল হরিনাথের মত স্বনামধন্য ব্যক্তিরাও ছাপাখানা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ছাপাখানা প্রসারে ভারতীয় তথা বাঙালিদের অবদান
ছাপাখানার উন্নতিকল্পে যে সকল ভারতীয় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়।
১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ই প্রথম ভারতীয় হিসেবে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে ছাপাখানা স্থাপন করেন। তাঁর সম্পাদনায় ‘ সংবাদ কৌমুদী’ ও ‘মিরাত-উল-আখবার’ পত্রিকা দুটি এখান থেকেই প্রকাশিত হত।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট’ ঔপনিবেশিক ভারতের শাসনকাঠামোকে গণতান্ত্রিক ব্রিটেনের অনুরূপ করে সাজানোর ফলে শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যেও স্বরাজের অভিলাষ জাগ্রত হয়। ছাপা অক্ষরের লিখন, পঠন ও প্রকাশনা তিনটিই ভদ্রলোক শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় এই সময়ের ছাপাখানাগুলি থেকে জাতীয়তাবাদী প্রচারধর্মী লেখাই বেশি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে হেমেন্দ্রকুমার, শিশিরকুমার ও মতিলাল ঘোষের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র উল্লেখ করা যায়।
ঔপনিবেশিক সরকার ক্রমশঃ বুঝতে পারছিল যে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা একদা তাদের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করলেও এখন তার সুযোগ নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তাদের গলার কাঁটা হয়ে উঠছে। ‘অমৃতবাজারের’ মত স্পষ্টবাদী সংবাদপত্রগুলির উপর নেমে আসে ‘দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইনের’ মত কালা কানুনের খাঁড়া। কিন্তু শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কিভাবে ভাষা বদলে ‘অমৃতবাজার’ তার কাজ চালিয়ে গিয়েছিল সে গল্প তো তোমাদের আগেই করেছি। পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল কালপর্বে জাতীয়তাবাদী লেখাপত্র প্রকাশের প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পায়। পাল্লা দিয়ে বাড়ে ছাপাখানার বহুবিধ ব্যবহার।
শিক্ষাবিস্তারে ছাপা বইয়ের ভূমিকা
ভারত তথা বাংলায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে মূলতঃ তিন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল – টোল, মক্তব-মাদ্রাসা এবং পাঠশালা।
প্রথম দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান ছিল হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের উচ্চবংশীয় ছাত্রদের জন্য। অন্যদিকে সাধারণ দরিদ্র খেটে খাওয়া পরিবারের সন্তানেরা পাঠশালা থেকে ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষালাভ করত।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ছাপাখানা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার যৌথ প্রভাবে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার চেহারাটা আমূল পাল্টে যায়। এই পর্বে প্রথমে বেসরকারি ও পরে সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি ভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন হয়। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগের মধ্যেই দেশীয় ভাষায় বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাদানের জন্য সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু স্কুল গড়ে ওঠে। সাথে সাথেই বাড়তে থাকে বাংলা ভাষায় মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা। শিক্ষায় ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপের পূর্বকালীন পাঠশালাগুলির ওপর কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে রাষ্ট্রের প্রয়োজন নয়, বিভিন্ন সামাজিক স্তর থেকে আসা ছাত্রদের সাধ্য ও ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখেই মূলতঃ পাঠশালাগুলিতে শিক্ষাদান করা হত।
ঔপনিবেশিক আমলে সরকার অনুমোদিত পাঠ্যক্রমের ধারণা আসায় শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণও বৃদ্ধি পেল। একই পাঠ্যক্রম অনুসারে রচিত পাঠ্যপুস্তকের অনেকগুলি প্রতিলিপি বা কপির প্রয়োজন হল। এই বিপুল পরিমাণ চাহিদা মেটানো একমাত্র ছাপাখানা গুলির পক্ষেই সম্ভব ছিল।
ছাপাখানা ও পাঠ্যপুস্তক
এবার এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক কি কি ধরনের পাঠ্যপুস্তক সে আমলে ছাপা হত। মূলতঃ পাঠ্যপুস্তকের যোগান দেওয়ার দেওয়ার জন্যই ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া পাঠ্যপুস্তক রচনা, মুদ্রণ ও সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘ক্যালকাটা খ্রিষ্টান ট্র্যাক্ট অ্যান্ড স্কুল বুক সোসাইটি’ এবং ‘ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি’ উল্লেখযোগ্য।
গোটা উনবিংশ শতাব্দীর পরিসংখ্যান তুলে আনলে দেখা যায়, প্রায় পাঁচশোর মত (অক্ষর পরিচয়ের বই) এই পর্বে ছাপা হয়েছিল। অন্যান্য মুদ্রিত পুস্তকের মধ্যে নীতিশিক্ষার বইয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। উদাহরণ হিসেবে বিদ্যাসাগরের কথামালার কথা বলা যায়। এছাড়া অঙ্ক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বইও ছাপা হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে জীববিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, প্রযুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের বইও ছাপা হতে শুরু করে।
ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ছাপাখানার ব্যবহার
ঊনবিংশ শতকে ছাপাখানার ব্যবহার শুধুমাত্র পাঠ্যবই মুদ্রণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এই সময়েই বাংলা সাহিত্য তার সর্বোচ্চ মানে পৌঁছাচ্ছিল। ১৮৬০ এর দশক থেকেই বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস সম্বলিত সাময়িকপত্র, পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস, বেসরকারি উদ্যোগে রচিত পাঠ্যবই ইত্যাদি মুদ্রিত সামগ্রীর তালিকায় যুক্ত হওয়ায় ছাপাখানার কাজের পরিধি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। সংস্কৃত প্রেস, গুপ্ত প্রেস, বিডন প্রেস ইত্যাদির কল্যাণে কলকাতার মুদ্রণ ব্যবসা রমরমিয়ে চলতে শুরু করে। অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণকে ব্যবসায়িক রূপ দেওয়াতে নিউ স্কুল বুক ছিল পথিকৃৎ। কলকাতাকেন্দ্রিক ছাপাখানাগুলির পাশাপাশি পূর্ববঙ্গের সুলভ, গিরিশ, ইস্টবেঙ্গল, বাঙ্গালা, ওরিয়েন্টাল প্রভৃতি ছাপাখানাও এই ব্যবসায় যথেষ্ট উন্নতি করেছিল।
এইভাবে বাংলা সাহিত্যের উন্নতিতে পরোক্ষে সাহায্য করে এই যুগের ছাপাখানাগুলি পাঠক সমাজের মধ্যে এক ধরনের আনন্দপাঠের সংস্কৃতি তৈরী করে। হাজার হোক, বিভিন্ন বয়সের পাঠকের উপযোগী সাহিত্য মুদ্রণ ও বিপণনের প্রক্রিয়াটি তো এদের ঘিরেই চলত। কলকাতার চিৎপুর অঞ্চলের বটতলা প্রেসের সৌজন্যে নিম্নবর্গের মানুষও আনন্দপাঠের রস আস্বাদন করার সুযোগ পেয়েছিল।
তবে বাংলা শিশুসাহিত্যের বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও তাঁর ইউ. রায় এন্ড সন্স যে অবদান রেখেছিল তা একটি স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে।
UPDATE: পড়া মনে রাখার সেরা উপায়↓
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫)
বাঙালি জীবনের সঙ্গে যে ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বদের নাম মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আশা করি, সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ আর ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমা দুটি তোমাদের দেখা। এই গুপি-বাঘা চরিত্রদ্বয় উপেন্দ্রকিশোরেরই সৃষ্টি। সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে ওনার পৌত্র। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে পূর্ববাংলার কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামে এই বহুমুখী প্রতিভার জন্ম হয়।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পূর্বনাম ছিল কামদারঞ্জন রায়।
আত্মীয় ও ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরীর গৃহে প্রতিপালিত হয়েছিলেন বলে তিনি পরে ‘রায়চৌধুরী’ উপাধি নেন।
প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির কন্যা বিধুমুখী ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের পত্নী।
অন্যান্য নানান প্রতিভা থাকলেও শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বেশি জনপ্রিয়। পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনীগুলিকে সহজ, ছেলেভোলানো ভাষায় তিনি আপামর বাঙালি কচিকাচাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর রচিত ‘ছেলেদের রামায়ণ’, ‘ছেলেদের মহাভারত’ ছাড়া আজও বাঙালি শিশুদের শৈশব কল্পনা করা যায় না। তবে তাঁর কৃতিত্বের যে দিকটি অপেক্ষাকৃত কম চর্চিত সেটা হল, তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি মুদ্রণ প্রযুক্তির উন্নতিতে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।
আরো পড়ো – বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা
ইউ. রায় এন্ড সন্স
১৮৬৫ সালে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর নিজস্ব ছাপাখানা ‘ইউ. রায় এন্ড সন্স’। এটি সম্ভবত সেইসময়ে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাপেক্ষা উচ্চমানের ছাপাখানা ছিল।
এদেশে বহুবর্নের চিত্র মুদ্রণের অভাব অনুভব করে উপেন্দ্রকিশোর মুদ্রণশিল্পের উন্নতিকল্পে তাঁর মন প্রাণ নিয়োজিত করেন। লন্ডনের ‘এ. ডব্লিউ. পেনরোজ অ্যান্ড কোং’ থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনিয়ে তিনি কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে তাঁর ছাপাখানা স্থাপন করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ময়মনসিংহের জমিদারি বিক্রয় করে তিনি এইসব যন্ত্রপাতির খরচ তুলেছিলেন।
ইউ. রায় এন্ড সন্স-এর বিশেষত্ব ছিল হাফটোন ক্যামেরায় ছবি মুদ্রণ ও হাফটোন ব্লকে হরফ ছাপা।
এ ব্যাপারে অনেক মজাদার কাহিনী তোমরা লেখকের ‘সেকালের কথা’ বইতে পাবে। প্রথম বাঙালি হিসেবে একটি মাত্র ৬০ ডিগ্রির আয়তাকার স্ক্রিন ও ডায়াফ্রেমের সাহায্যে তিনটি রঙের হাফটোন ছবির নেগেটিভ তৈরী করে উপেন্দ্রকিশোর নজির সৃষ্টি করেন।
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে এই মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানটিকে উপেন্দ্রকিশোরের গড়পাড় রোডের বাসভবনে নিয়ে আসার পর বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার মুদ্রণ শুরু হয়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে এই পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম। উপেন্দ্রকিশোরের অবর্তমানে তাঁর পুত্র-পৌত্ররাও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই পত্রিকার মাধ্যমে শিশুদের মুখে হাসি ফুটিয়ে গেছেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র, বাংলার ননসেন্স কমেডির প্রবাদপুরুষ সুকুমার রায়ও নানাভাবে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তবে দুর্ভাগ্য যে, ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে উপেন্দ্রকিশোরের ও ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে সুকুমার রায়ের অকালমৃত্যুর পর গড়পাড় রোড বাসভবনের মালিকানা বদল হবার সঙ্গে সঙ্গেই ইউ. রায় এন্ড সন্সও বন্ধ হয়ে যায়।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ঔপনিবেশিক বাংলায় বিজ্ঞানের বিকাশ
লেখক পরিচিতি
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এম ফিল পাঠরত রাতুল বিশ্বাস। ইতিহাসচর্চার পাশাপাশি লেখা-লিখিতেও সমান উৎসাহী রাতুল।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_hist_5a