ভূগোল – দশম শ্রেণি – বায়ুমণ্ডল (চতুর্থ পর্ব)
আগের পর্বে আমরা ইনসোলেশনের ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতার তারতম্যে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বায়ুমণ্ডলের তাপের তারতম্যের কারণ
• অক্ষাংশ
বায়ুমন্ডলের উষ্ণতার তারতম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হল অক্ষাংশ। কোনো স্থানে আগত সূর্য রশ্মির পতনকোণ সেই অঞ্চলের অক্ষাংশের উপরে নির্ভরশীল। যেহেতু পৃথিবীর মেরু রেখা ° কোণে হেলে থাকে সেজন্য ভূপৃষ্ঠের পতনকোণ সর্বত্র সমান হয় না এবং দিন রাত্রির দৈর্ঘ্য পার্থক্য ঘটে থাকে।
সূর্যরশ্মির পতনকোণ
নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠের উপর লম্বভাবে পড়ে এবং নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে যত উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর দিকে যাওয়া যায় সূর্যরশ্মি ক্রমশ তির্যকভাবে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। সূর্যরশ্মি কোনো জায়গায় লম্বভাবে পড়লে সেই রশ্মিকে কম বায়ু স্তর ভেদ করে যেতে হয় এবং অল্প জায়গার উপরে পতিত হয় বলে সেই রশ্মির উত্তপ্ত করার ক্ষমতা বেশি হয়। অন্যদিকে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়লে সেই রশ্মিকে অনেকগুলি বায়ুস্তর ভেদ করে যেতে হয় এবং অনেকটা জায়গা জুড়ে পতিত হয় তার জন্য সেই রশ্মির উত্তপ্ত করার ক্ষমতাও কম হয়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
এই কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বেশি হয় এবং মেরু অঞ্চলে উষ্ণতা সবথেকে কম হয়। এই ভূপৃষ্ঠের উত্তাপের উপরেই বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ নির্ভর করে। ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ বেশি হলে বায়ুমণ্ডলও বেশি উত্তপ্ত হয়, অর্থাৎ কোনো অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে।
দিন রাত্রির দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি
কোনো অঞ্চলের দিন ও রাত্রির দৈর্ঘ্যের উপরেও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নির্ভর করে নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারাবছর 12 ঘন্টা দিন ও 12 ঘন্টা রাত্রি থাকায় এই অঞ্চলে সৌর বিকিরণের পরিমাণ সবথেকে বেশি হয় এবং স্বাভাবিকভাবে এই অঞ্চলে সূর্যরশ্মির প্রভাবও সবথেকে বেশি থাকে।
এই কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারাবছর বেশি উষ্ণতা বজায় থাকে এবং গ্রীষ্ম ও শীতকালে খুব একটা উষ্ণতার তারতম্য এখানে দেখা যায় না। অন্যদিকে উচ্চ অক্ষাংশে দিন রাত্রির দৈর্ঘ্যের ব্যপক পার্থক্য হওয়ায় উষ্ণতা কম হয়। এই অঞ্চলে ঋতুভেদেও উষ্ণতার তারতম্য দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, 34° উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত শ্রীনগরের তুলনায় তিরুবন্তপুরম (8°30′ উত্তর) অনেক বেশি উষ্ণ।
• উচ্চতা
উচ্চতা হল বায়ুমন্ডলের উষ্ণতার একটি অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। আমরা জানি বায়ুমন্ডলে নিচের দিকে উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে উষ্ণতা 6.4°C হারে কমতে থাকে, একে স্বাভাবিক উষ্ণতা হারের বিধি বা নরমাল ল্যাপস রেট বলা হয়।
এই কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি উচ্চতার অঞ্চলের থেকে উঁচু স্থানের অর্থাৎ পাহাড়-পর্বতের উষ্ণতা অনেক কম হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নিরক্ষরেখার কাছে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও কিলিমাঞ্জারো পর্বত অনেক উঁচু হওয়ায় এখানে সারা বছর বরফ জমে থাকে। লাদাখ, দার্জিলিং, সিমলা এসব অঞ্চলগুলি অনেক উচ্চতায় অবস্থিত হওয়ায় এখানে সারা বছর তাপমাত্রা কম থাকে।
বৈপরীত্য উত্তাপ
আমরা সবাই জানি স্বাভাবিকভাবে উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে উষ্ণতার পরিমাণ হ্রাস পায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে উষ্ণতা পরিমাণ হ্রাস না পেয়ে বরং বৃদ্ধি পায়। উষ্ণতার পরিবর্তনের এই ব্যতিক্রমী ঘটনাকেই বৈপরীত্য উত্তাপ বলা হয়। এই ব্যতিক্রমী ঘটনাটি মূলত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে রাত্রে বেলায় হয়ে থাকে।
নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে রাতের বেলায় পর্বতের ঢাল বেয়ে দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল, ঘন, ভারী বায়ু পর্বতের ঢাল বরাবর নিচের দিকে নামতে থাকে, যাকে ক্যাটাবেটিক বায়ু বলা হয়।
এইভাবে ক্যাটাবেটিক বায়ু দ্রুত নিচের দিকে নেমে উপত্যকায় জমা হয় এবং উপত্যকার উপরের দিকে গরম হালকা বায়ু অবস্থান করে। শীতল ভারী বায়ুস্তর এর উপরে গরম হালকা বায়ুস্তরের এই অবস্থানে বৈপরীত্য উত্তাপের ঘটনা সম্পাদন করে। মেরু এবং উপ মেরু অঞ্চলে ও ভূমি ভাগ বরফাবৃত থাকায় বৈপরীত্য উত্তাপের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়।
শহরে কারখানা যুক্ত অঞ্চলের চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়ার ফলে ফলে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন অঞ্চলের তুলনায় বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকের অঞ্চলের উত্তাপ বেশি থাকে যার ফলে বৈপরীত্য উত্তাপ সৃষ্টি হয়। শীতকালে সূর্যাস্তের পর ভূপৃষ্ঠ এবং তার সংলগ্ন বায়ু দ্রুত শীতল হয়ে ওঠে কিন্তু ভূপৃষ্ঠের উপরের দিকের বায়ু দ্রুত শীতল হয় না এর ফলে বৈপরীত্য উষ্ণতার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
• স্থলভাগের জলভাগের বন্টন
জল এবং স্থল ভৌত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একে অপরের থেকে পৃথক। সেই কারণে জল এবং স্থলের তাপ শোষণ ক্ষমতা ভিন্ন হওয়ার ফলে উষ্ণতার তারতম্য ঘটে থাকে। স্থলভাগের আপেক্ষিক তাপ কম হওয়ায় স্থলভাগ জলভাগ থেকে দ্রুত উত্তপ্ত হতে পারে তেমন আবার দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল হতে পারে। কিন্তু জলভাগের ক্ষেত্রে এই দুটো প্রক্রিয়ায় খুব ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়। এই কারণে মহাদেশগুলিতে চরমভাবাপন্ন জলবায়ু পরিলক্ষিত হয় এবং উপকূল অঞ্চলে বা সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে সমভাবাপন্ন সামুদ্রিক জলবায়ু দেখা যায়।
• সমুদ্রস্রোত
সমুদ্রস্রোতের ফলেও পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে উষ্ণতার তারতম্য ঘটে থাকে। সমুদ্রস্রোত দুই রকমের হতে পারে উষ্ণ সমুদ্র স্রোত ও শীতল সমুদ্রস্রোত। কোনো উপকূল অঞ্চলের পাশ থেকে উষ্ণ সমুদ্র স্রোত প্রবাহিত হলে সেই অঞ্চলটিকে সমুদ্রস্রোত উত্তপ্ত করে তোলে স্বাভাবিকভাবে কোনো উপকূল অঞ্চলের পাশ থেকে যদি শীতল সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, তবে সেই অঞ্চলের উষ্ণতা অনেক কম থাকে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে ইউরোপের উত্তর পশ্চিম অংশে সারাবছর উষ্ণতা বেশি থাকে অন্যদিকে শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে ল্যাব্রাডর উপকূলে শীতকালে বরফ জমে থাকে। উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
• বায়ুপ্রবাহ
পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের তাপমাত্রা উষ্ণ ও শীতল বায়ু প্রবাহের উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় গ্রীষ্মকালে উষ্ণ ও শুষ্ক ‘ লু ‘ বায়ুর প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতের উষ্ণতা বেড়ে যায়। আবার বর্ষাকালে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে উষ্ণতা প্রায় 10°C অবধি কমে যেতে পারে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
• ভূমির ঢাল
কোনো স্থানের ভূমির ঢাল সেই অঞ্চলের উষ্ণতার উপর প্রভাব ফেলে থাকে। সূর্যালোকের পতনকোণের ফলে এই উষ্ণতার তারতম্য ঘটে থাকে। ভূমির যে ঢালে সূর্যালোক লম্বভাবে পড়ে সেই ঢালে উষ্ণতা অপেক্ষাকৃত বেশি হয় এবং যে ঢালে সূর্যালোক তির্যকভাবে পতিত হয় সেই ঢালের উষ্ণতা তুলনামূলকভাবে কম হয়। এই জন্য উত্তর গোলার্ধে পর্বতের দক্ষিণমুখী এবং দক্ষিণ গোলার্ধের পর্বতের ঢালে সূর্যালোক বেশি পড়ে ফলে এই অঞ্চলের উষ্ণতা বেশি হয়।
• স্বাভাবিক উদ্ভিদ
গভীর অরণ্য থাকলে সেই অঞ্চলে সূর্যের রশ্মি সরাসরি প্রবেশ করতে না পারায় ফলে ভূপৃষ্ঠে সহজে সূর্য রশ্মি পতিত হতে পারে না। এই কারণে ভূপৃষ্ঠ কম উত্তপ্ত হয়। অন্যভাবে কোনো অঞ্চলে উদ্ভিদ না থাকলে সেই অঞ্চলে সরাসরি সূর্যরশ্মি পতিত হয় এবং ভূপৃষ্ঠ সহজে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এই কারণে বনাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উষ্ণতা অপেক্ষাকৃত কম হয়।
উদ্ভিদের প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন জলীয়বাষ্প বাতাসকে আদ্র রাখে। এই কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারাবছর লম্বভাবে সূর্যকিরণ পতিত হলেও নিরক্ষীয় বনাঞ্চলের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় না।
• মেঘাচ্ছন্নতা ও অধঃক্ষেপণ
আকাশ মেঘলা থাকলে সূর্য রশ্মি ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়ে দীর্ঘ তরঙ্গ রূপে মহাকাশে ফিরে যেতে পারে না, ফলে ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে। আবার আকাশ মেঘলা থাকলে দিনের বেলায় যে তাপমাত্রা ভূপৃষ্ঠে পতিত হয় রাত্রে বেলা সেই তাপমাত্রার বিকিরণ হয়ে আবার মহাশূন্য বিলীন হয়ে যায়। বৃষ্টিপাতের ফলে তাপমাত্রা সাময়িক পরিবর্তন ঘটে। যেমন, গ্রীষ্মকালে কালবৈশাখীর বৃষ্টিতে তীব্র গরম সাময়িকভাবে কমে যায় আবার পার্বত্য অঞ্চলে তুষারপাতের ফলে তাপমাত্রা অনেকটা কমে যায়।
• মাটির প্রকৃতি
বিভিন্ন প্রকার মাটির তাপ শোষণ করার ক্ষমতা ও বিভিন্ন হয় যেমন কালো এবং বালি মাটির তাপ শোষণ করার ক্ষমতা বেশি হয়। এই মাটি সহজেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আবার সহজেই তা ত্যাগ করে শীতল হয়ে পড়ে। এই কারণে দিনের বেলায় মরুভূমিতে উষ্ণতা খুব বেশি হয় আবার রাতের বেলা উষ্ণতা কমে যায়।
• নগরায়ন ও শিল্পায়ন
শহরাঞ্চলে কলকারখানা যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া উত্তাপ সেই অঞ্চলের উষ্ণতা বাড়িয়ে তুলে তাপ ক্ষেত্র তৈরি করে শহরাঞ্চলে ঘরবাড়ি নির্মাণ যান চলাচলের ফলে উৎপন্ন ধূলিকণা প্রচুর পরিমাণে বায়ুতে মিশ্রিত হয় এবং এই কণাগুলি সহজেই সৌর বিকিরণ ও পার্থিব বিকিরণ শোষণ করতে পারে।
এই কারণে শহরাঞ্চলের ভূমি সংলগ্ন বাতাস খুব উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দমদম বিমানবন্দর এলাকায় উষ্ণতা থেকে কলকাতা শহরের উষ্ণতার থেকে সবসময় দুই থেকে 3°C বেশি থাকে।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → তাপমন্ডল ও তাপের বন্টন
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-geo-2-d