ইতিহাস – দশম শ্রেণি – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন (পর্ব – ১)
শুরু হল বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন অধ্যায়ের আলোচনা; প্রথম পর্বে থাকছে বিশ শতকের ভারতে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
প্রেক্ষাপট
বিশ শতকের রাজনৈতিকভাবে অস্থির ভারতবর্ষে কৃষক আন্দোলনের সাথে জাতীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ সংযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূলত বিশ শতকের প্রথমার্ধে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল জাতীয় কংগ্রেস, কিন্তু দ্বিতীয় দশকের পর থেকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে ধীরে ধীরে বামপন্থী আন্দোলনের মিশ্রণ ঘটতে দেখা যায়।
কৃষক আন্দোলন আক্ষরিক অর্থে শুধুমাত্র গরীব চাষিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এই সব আন্দোলন আদপে হয়ে উঠেছিল অসহায় দরিদ্র মানুষদের ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে বেঁচে থাকার লড়াই।
আমরা শুরুতেই এই ধরণের কিছু আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করে নেব।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ও কৃষক সম্প্রদায়
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রথম কুড়ি বছর অর্থাৎ 1885 – 1905 সময়কাল ছিল মূলত কংগ্রেসের নরমপন্থী নীতির যুগ, অর্থাৎ ভারতের একটি শিক্ষিত সম্প্রদায় গোটা ভারতবাসীর তরফ থেকে তাদের সকলের বিভিন্ন দাবী ব্রিটিশ শাসকদের সামনে তুলে ধরত, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাতে বিশেষ কিছু লাভ হতো না। তাই এই নীতির বিরোধিতা করে সেই সময় বাংলা জুড়ে বিভিন্ন সভা সমিতি গড়ে উঠতে শুরু করে যেগুলো মূলত গোপনে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য যুবকদের তৈরি করত, মূলত বাংলা ছিল এই সব আন্দোলনের পীঠস্থান।
তাই ব্রিটিশ শক্তি বাংলার ঐক্যকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য 1905 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে বাংলাকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এর প্রভাবে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়, মূলত চার প্রকারে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেগুলি হল –
ক) ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন, খ) স্বদেশী আন্দোলন, গ) বিদেশি দ্রব্য বয়কট আন্দোলন, ঘ) সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপ।
এই সকল প্রকার আন্দোলনই ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক, তবে এগুলোর মধ্যে স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনই একমাত্র গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, তবে বলা যায় সেই অর্থে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে পারেনি। কারণ এই সব গ্রামের গরীব কৃষকরা পুলিশি অত্যাচার, দক্ষ নেতৃবৃন্দের অভাবে এবং অশিক্ষার কারণে খুব বেশি দিন এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত থাকতে না পারলেও এই সূচনা পরবর্তী সময়ের জন্য তাদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে শিখিয়ে ছিল।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলন
বিশ শতকের গোড়ায় ঘটা আন্দোলনগুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল গান্ধিজির নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। বাংলা, বিহার যুক্তপ্রদেশে এই আন্দোলনের আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এবং এতে কৃষকদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ্যনীয়। এই আন্দোলনের বিভিন্ন উদ্দেশ্যের মধ্যে কৃষক স্বার্থকেও গান্ধিজি যুক্ত করেছিলেন।
বহু জায়গায় কৃষকরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেয়। সেই সময় রাজস্থানের বিজলিয়ার কৃষক বিদ্রোহ এবং দক্ষিণে মালাবার উপকূলের মোপলা বিদ্রোহ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। খিলাফত আন্দোলনের প্রভাবে বহু মুসলিম কৃষক এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। 1922 খ্রিস্টাব্দে চৌরিচৌরায় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলে গান্ধিজি এই আন্দোলন বন্ধ করে দেন।
কৃষক আন্দোলন
ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে এরপর বিভিন্ন কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, আমরা সেই সব আন্দোলনগুলি সম্পর্কে এবার আলোচনা করবো।
বাংলা
বিশ শতকে বাংলায় কৃষক আন্দোলনের পীঠস্থান ছিল মেদিনীপুর। সরকারের ইউনিয়ন বোর্ড তৈরি করে তার খরচ বহন করার জন্য গরীব কৃষকদের ওপর চৌকিদারি কর 50% বৃদ্ধি করে, এর প্রতিবাদে ব্যারিস্টার বীরেন্দ্রনাথ শাসমল তাঁর পেশা ছেড়ে কৃষক স্বার্থরক্ষার্থে আন্দোলনে যোগদান করেন। তারা এই ইউনিয়ন বোর্ড ও করকে বয়কট করে। এই আন্দোলনে বীরেন্দ্রনাথের সুযোগ্য সহকারী ছিলেন তমলুকের শ্রীনাথচন্দ্র দাস এবং কাঁথির নিকুঞ্জ বিহারী মাইতি।
উত্তরপ্রদেশ
উত্তরপ্রদেশে কৃষক আন্দোলনে বাবা রামচন্দ্র এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার থেকে জমিদার শ্রেণি বিভিন্ন উপায়ে কৃষকদের নিপীড়ন করত। যেমন – জমিতে বেগার খাটানো, জমি বেদখল করা, আবার অনেক সময় বেআইনিভাবে খাজনা তারা গরীব অসহায় কৃষকদের থেকে আদায় করত। এরফলে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল।
সেই ক্ষোভই রামচন্দ্রের নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন প্রতাপগড়, ফৈজাবাদ ও রায়বেরেলিতে কিষাণ আন্দোলনের রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। অযোধ্যা কিষাণ সভা 1920 খ্রিস্টাব্দে নেহেরু ও রামচন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল। যদিও বহু ইতিহাসবিদ এই আন্দোলনে কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, গান্ধিজি কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য রক্ষার্থে কৃষক সম্প্রদায় ও জমিদার শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্বকে প্রশ্রয় দেননি বলেই বহু ঐতিহাসিক মনে করেছেন।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
একা আন্দোলন
কৃষক নেতা মাদারি পাসির নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশের বরাবাঁকি, সীতাপুর, উত্তর পশ্চিম অযোধ্যা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। শস্যের দাম হিসাবে নগদ খাজনার মূল্য নির্ধারণকে কেন্দ্র করেই এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল 1921 – 1922 খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীকালে মাদারি পাসি গ্রেফতার হলে আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ
বিংশ শতকের গোড়ার দিকে যে সমস্ত কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে গুজরাটের বারদৌলি সত্যাগ্রহ অন্যতম। অসহযোগ পরবর্তী ও আইন অমান্য পূর্ববর্তী সময়ে (1928) ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলের রাজস্ব 22% বৃদ্ধি করে দেয়, যেখানে আন্তর্জাতিক স্তরে ঐ সময় তুলোর দাম কমে গিয়েছিল। এছাড়াও উচ্চবর্ণের উচ্চবিত্তকর্তিক নিম্নবিত্তদের প্রতি অত্যাচার চরমে ওঠে, এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে একটি গান্ধিবাদি কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা বারদৌলি সত্যাগ্রহ নামে খ্যাত। সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সময় সরকারকে রাজস্ব প্রদান করা বন্ধ করে দিয়েছিল।
এই আন্দোলনে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্যাটেল কন্যা মনিবেন প্যাটেল সহ বহু মহিলা এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন (প্রচলিত আছে বল্লভ ভাই প্যাটেলকে ‘সর্দার’ উপাধি এই অঞ্চলের মহিলারাই প্রদান করেছিল)।
ভারতের অন্যান্য কিছু অঞ্চল
• রাজস্থানের বিজয় সিং পথিক ও মানিকলাল বর্মার নেতৃত্বে বিজলিয়ায় কৃষক বিদ্রোহ (1920-21) হয়েছিল। এছাড়া মারোয়াড় ও আলোয়ারে কৃষক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল।
• বলপূর্বক কর আদায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতির প্রতিবাদে বিহারের ভাগলপুর, মুঙ্গের, দ্বারভাঙ্গার কৃষকরা বিদ্রোহ (1919-20) করেছিলেন।
• কেরালার মালাবার উপকূলে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন 1921 খ্রিস্টাব্দে জমিদার শ্রেণির নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক কৃষক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল, যা মোপলা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
• অন্ধ্রপ্রদেশে মহাজনি শোষণের বিরুদ্ধে আদিবাসি রাম্পা উপজাতি সম্প্রদায় আল্লুরি সীতারাম রাজুর নেতৃত্বে বিদ্রোহ (1922-24) শুরু করেছিল।
আইন অমান্য আন্দোলন ও কৃষক সমাজ
1930 সালে গুজরাটের ডান্ডিতে লবণ আইন ভঙ্গ করে গান্ধিজি আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করলেও এর বিস্তৃতি ছিল ভারতের এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে। বাংলায় এই কংগ্রেসি আন্দোলনের প্রধান সমর্থক ছিলেন মূলত বিত্তবান কৃষকরা, তারা একদিকে ভাগচাষিদের অধিকারের বিরুদ্ধে ছিলেন আবার অন্যদিকে বড় জমিদারদেরও সমর্থন করতেন না।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
এদের হাত ধরেই বাংলার আরামবাগ, তমলুক এবং পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন প্রদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলা ছাড়াও এর ব্যাপকতা অযোধ্যা, বিহার, যুক্তপ্রদেশ, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। আন্দোলনে কৃষকদের অংশগ্রহণ ছিল আকর্ষণীয়। কিছু অঞ্চলে আইন অমান্য ও কৃষক আন্দোলনের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যেতনা, যেমন উত্তরপ্রদেশ। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়াই গান্ধিজির আরউইনের সাথে বৈঠক এবং চুক্তি করার সিদ্ধান্ত, ভারতীয় কৃষক সমাজকে কংগ্রেসের ওপর আশাহত করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও কৃষক সম্প্রদায়
1942, ভারত তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক মাহেন্দ্রক্ষণ, একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যদিকে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির জোড়া চাপে ব্রিটিশবাহিনী টালমাটাল।
এমতাবস্থায় কংগ্রেস নেতৃত্ব স্বাধীনতা লাভের আশায় 1942 এর 8ই আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা করে, সমগ্র দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে।
গান্ধিজি শ্লোগান দেন “Do or Die”, সমগ্র ভারত নিজেদের সমস্ত ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। কৃষক সম্প্রদায়ও এর ব্যাতিক্রমী হয় না। আগের সমস্ত আন্দোলনেই কৃষকরা নিজেদের দুরাবস্থা, জমিদের শ্রেণির নিপীড়নের বিরুদ্ধেই মূলত গর্জে উঠেছিল, কিন্তু এই আন্দোলনে কৃষক, শ্রমিক, জমিদার, মহাজনসহ বিভিন্ন মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়।
গান্ধিজির চেষ্টা সত্ত্বেও এই আন্দোলনকে অহিংস রাখা যায়নি। হিংসাত্মক ঘটনা বিভিন্ন স্থানে ঘটতে শুরু করে। সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি করা হয়। বিভিন্ন স্থানে সরকারকে অগ্রাহ্য করে নতুন সরকার গঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকারের কড়া দমন নীতি প্রকাশ্যে আন্দোলনকে স্তিমিত করলেও গোপনে চলতে থাকে আন্দোলন যা ব্রিটিশ সরকারের মনের মধ্যে বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – বিশ শতকের ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ
লেখিকা পরিচিতি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_hist_6a