শ্রেণি – দশম শ্রেণি বিষয়: ইতিহাস । অধ্যায়: ইতিহাসের ধারণা (পর্ব -৫) |
এই মানব জগৎ সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ শিল্পচর্চার সাথে যুক্ত রয়েছে। শিল্পচর্চার সাথে জাতির আত্মপরিচয় মিশে আছে। কোনো মানব গোষ্ঠীর শিল্পচর্চার ইতিহাস থেকে তার সাংস্কৃতিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার আভাস পাওয়া যায়। সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, চলচ্চিত্র এসবই হল শিল্প চর্চার এক একটি ধারা। এই বিষয়গুলির ইতিহাস আধুনিক ইতিহাস চর্চার বিষয় রূপে গণ্য হয়েছে। এই প্রতিটি বিষয়ের পিছনে একটি করে ইতিহাস আছে এবং এসব নিয়ে পন্ডিতরা প্রচুর গবেষণা করেছেন। 1980-র দশক থেকে সংস্কৃতির ইতিহাস চর্চা শুরু হয়েছে। আমরা এবার একে একে এই সবকটা বিষয়ের কিছু ধারণা লাভ করবো।
সঙ্গীত ও নৃত্য
সঙ্গীতপ্রেমী নয় এমন মানুষ পাওয়া আজকের যুগে অসম্ভব। কিন্তু এই সঙ্গীত শুরু হল কবে থেকে?
প্রকৃতি থেকে আগত বিভিন্ন ধ্বনি বা আওয়াজ যেমন – পাখির ডাক, বিভিন্ন জন্তুর ডাক, শুকনো পাতার আওয়াজ, ঝর্ণার জলের শব্দ, বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ, প্রভৃতির সাথে সংযুক্ত হয়ে সংগীত সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে শিস দেওয়া, মুখে নানা শব্দ করা বা গুন গুন করে গান গাওয়ার সাথে কোনো কিছুকে বাজিয়ে, হাতের বা পায়ের তাল ঠুকে সুরের মাধ্যমে সংগীতের সৃষ্টি হল। আদিম যুগের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে প্রথম সঙ্গীত শুরু হয়।
প্রাচীনযুগে মানুষ প্রকৃতিকে পূজো করত। ঝড়, জল প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তিকে ভয় করত তারা। তারা ভাবতো দেব-দেবীরা হয়তো তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তাই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে। তখন সেই দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে তারা নানারকম সঙ্গীত নৃত্যের আয়োজন করতে শুরু করল। তোমরা দেখে থাকবে এখনকার দিনেও বজ্রপাত হলে মা-ঠাকুমারা জোরে জোরে শাঁখ বাজায়।
ভারতে যত রকম নৃত্যকলা প্রচলিত আছে তা সকলই ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে। দেশের বিভিন্ন মন্দিরে দেবদাসী প্রথা প্রচলিত ছিল। দেবদাসীরা নৃত্য ও সংগীতের মাধ্যমে দেবতার সেবা করতো। তবে দেবদাসীদের নাচ কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণের অভিজাতরাই উপভোগ করত সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের সেই নাচের কোনো স্থান ছিল না। তাদের একটি নিত্যশৈলীই এক একটি নৃত্যকলার জন্ম দেয়। যেমন – ওড়িশি, ভারতনাট্যম, কথাকলি, মনিপুরী, কুচিপুরি, মোহিনীআট্যম, ভাংড়া, ডান্ডিয়া, ছৌ, বিহু, গর্বা এইসকল নৃত্যশৈলীর সাথে কোনো না কোনো ধর্মীয় উৎসবের যোগ আছে।
লোকসংস্কৃতির সাথে, আদিবাসী জীবনের সঙ্গে নাচের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই সাঁওতালি নাচে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের জীবনের সব উৎসবের সাথেই নাচ জুড়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইম্ফলের গোবিন্দজী মন্দিরে মনিপুরী নৃত্য দেখে তা শান্তিনিকেতনে হিসেবে শেখাতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে নৃত্য এখনকার যুগে একটি প্রচলিত ও জনপ্রিয় নৃত্যশৈলী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে পৌষমেলা ও বসন্ত উৎসবের প্রচলন করলে সেখানেও সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনা দেখা যায়। আবার উদয় শংকর পাশ্চাত্য রীতিতে প্রাচ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে নৃত্য প্রদর্শন করে সকলের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। আর এই সকল কারণে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি নাচের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
যখন নৃত্য ও সংগীত বিষয়ে ইতিহাস চর্চায় জাতি বর্ণ ধর্ম লিঙ্গের ভেদাভেদ বা বৈষম্য, ভাষাভিত্তিক প্রাদেশিকতা উঠে আসে তখন এই ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
ভারতের নৃত্য ও সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানা, তাদের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট এই শিল্পশৈলীর পরিবেশনে ব্রাহ্মণদের সাথে সমাজের অন্যান্য মানুষের দ্বন্দ্ব, তার প্রভাব, তার সাথে শিল্পীদের জীবনযাত্রা, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান এসবই ইতিহাস চর্চার বিষয়ভুক্ত।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
নৃত্য এবং সংগীতের ইতিহাস নিয়ে তোমরা যদি চর্চা করতে চাও তাহলে তোমাদের অবশ্যই পড়তে হবে ক্যারেল ওয়েলসের লেখার ‘ডান্স এ ভেরি সোশ্যাল হিস্ট্রি’ এবং চার্লস রাসেল ডে র লেখা ‘দ্যা মিউজিক এন্ড মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্টস অফ সার্দান ইন্ডিয়া এন্ড দ্যা ডেকান’ এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই। নৃত্য এবং সংগীতের ইতিহাসচর্চার পাশাপাশি প্রাসঙ্গিকভাবেই বাদ্যযন্ত্রের কথা উঠে আসে এবং তাদের শিল্পী এবং তাদের জীবনযাত্রাও কিন্তু এই ইতিহাস চর্চার এক অন্যতম উপাদান। সুধীর চক্রবর্তীর লেখা থেকে আমরা জানতে পারি নানা ধরনের গানের ধারা মিলে কিভাবে বাংলা গান সমৃদ্ধ হয়েছে।
শিল্পচর্চার ইতিহাস সম্পর্কিত আলোচনা ↓
নাটক
সঙ্গীত এবং নৃত্যের পরে স্থান হল নাটকের। কিন্তু নাটক কিভাবে প্রথম শুরু হয়েছিল সে কিন্তু একটা মজার বিষয়। প্রাচীন ভারতে মুনি-ঋষিরা অনেকক্ষণ ধরে যজ্ঞ করতো। কোনো কোনো যজ্ঞ কয়েক দিন অথবা এক মাস ধরে চলতো। তখন মুনি-ঋষি এবং যজমানরা দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা যাগযজ্ঞর কারণে একঘেয়ে লাগতো। তাদের একঘেয়েমি দূর করার জন্য তখন আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
তারা তখন দিনের শেষে সন্ধ্যাবেলায় আগুনের চারপাশে ঘিরে বসত এবং তারা নিজেদের মধ্যে অনেক গল্প করতো। আর একজনের গল্পের কথাগুলোকে সাজিয়ে নিয়ে এক একটা নাটক বানানো হতো। তাতে অভিনয় করতো সে যুগে বিভিন্ন সাধারণ মানুষ।
বর্তমানে আমরা নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য-এ শব্দগুলো জানলেও বেদের যুগ থেকেই কিন্তু এইসব জিনিসের সূত্রপাত হয়। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে নট বা অভিনেতার উল্লেখ আছে, এছাড়া শিলালিন ও কৃশাশ্ব নামে দু’জন নাট্যাচার্যের কথা জানতে পারি। ভরতের লেখা নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থে আমরা রঙ্গমঞ্চের উল্লেখ পাই।
এ তো গেল প্রাচীন যুগের নাট্যচর্চার কথা।
এবার আসি ভারতের আধুনিক যুগের নাট্যচর্চার কথায়। অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতকে ইউরোপের পাশাপাশি ভারতেও নাট্যচর্চার প্রসার হয়।
বাংলায় নাট্যচর্চা শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে অষ্টাদশ শতকের শেষদিক থেকে। স্বাধীনতার পরে এর প্রসার ব্যাপকভাবে ঘটতে থাকে। নাটকের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটানো ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন নাট্যইতিহাস চর্চায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। আধুনিককালে কিন্তু অনেক গবেষক গুরুত্ব দিয়েই নাটকের ইতিহাস চর্চা করে চলেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস’, সত্যজীবন মুখোপাধ্যায়ের ‘দৃশ্যকাব্য পরিচয়’, আশুতোষ ভট্টাচার্যের ‘বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস’ বালদুন ধীনগড়ার ‘ন্যাশনাল থিয়েটার ফর ইন্ডিয়া’।
চলচ্চিত্র
বর্তমানে আমরা ক্যামেরা ছাড়া এক সেকেন্ডও থাকতে পারিনা। গণমাধ্যম হিসেবে ক্যামেরা এখন সবথেকে শক্তিশালী যন্ত্র। আধুনিক যুগে সিনেমা বা চলচ্চিত্র বিনোদন জগতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বলে মনে করা হয়। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের ভাবনা থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক ঘটনা, সমাজের নানা সমস্যা, সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। তাই চলচ্চিত্রের ইতিহাস চর্চা বর্তমানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে উঠেছে।
তার আগে আমাদের জানতে হবে এই চলচ্চিত্র বা সিনেমার পথ চলা শুরু হয় কিভাবে। 1895 সালের 28 শে ডিসেম্বর প্যারিসের হোটেল দি ক্যাফে তে অগাস্ট লুমিয়ের এবং লুই লুমিয়ের নামে দুই ভাই প্রথম চলচ্চিত্র বা সিনেমা শুরু করে। আর ভারতীয় উপমহাদেশে কিন্তু চলচ্চিত্র আরো 17 বছর পর আসে। তখন একে বলা হতো ‘বায়োস্কোপ’ বাংলায় বলা হতো ‘ছবি’। 1913 সালের 21 এপ্রিল ভারতের ‘অলিম্পিয়া থিয়েটারে’ দাদা সাহেব ফালকে পরিচালিত ‘রাজা হারিশ্চন্দ্র’ নামে নির্বাক চলচ্চিত্র সর্বপ্রথম প্রদর্শিত হয়। এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে পথ চলা শুরু হয়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
বর্তমানে ভারত এবং বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অনেক নামিদামি ফিল্ম ইনস্টিটিউশন গড়ে উঠেছে ফিল্ম সম্বন্ধে পড়াশোনা করার জন্য। কলকাতা ও পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউশনে অভিনয় ও পরিচালনা শিখে প্রচুর অভিনেতা- অভিনেত্রী ও পরিচালক সুনামের সাথে কাজ করছেন। এর পাশাপাশি এখানে চলচ্চিত্র চর্চাও হয়, যা ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎকে আরো উন্নত করছে।
তোমরাও যদি চলচ্চিত্র নিয়ে চর্চা করতে চাও তাহলে তোমরা ফ্রান্সেসকো ক্যাসেটির ‘থিওরিস অব সিনেমা’, ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘চলচ্চিত্র, মানুষ এবং আরো কিছু’, সত্যজিৎ রায়ের ‘একেই বলে শুটিং’ ও ‘বিষয় চলচ্চিত্র্ তপন সিনহার ‘চলচ্চিত্র আজীবন’, ফারহানা মিলির ‘সিনেমা এলো কেমন করে’, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় এর ‘দেখার রকমফের : ঋত্বিক ও সত্যজিৎ’ এই গ্রন্থ গুলো পড়ে দেখতে পারো।
পঞ্চম পর্ব সমাপ্ত।
লেখিকা পরিচিতিঃ
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের (স্নাতকোত্তর) প্রাক্তন ছাত্রী কাজল মণ্ডলের পেশা এবং নেশা ইতিহাস চর্চা। অন্য কাজের অবসরে গান শুনতে এবং দাবা খেলতে ভালোবাসেন কাজল।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_Hist_1e