shromik-andoloner-sathe-jatiyo-congress-bamponthee-rajnitir songjog
Madhyamik

বিশ শতকের ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ

ইতিহাসদশম শ্রেণি – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন (পর্ব – ২)

গত পর্বে আমরা বিশ শতকের ভারতে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা বিশ শতকের ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ সম্পর্কে জানবো।


বিশ শতকের ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ নিয়ে আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে↓


ভারতে কৃষক আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিক আন্দোলনগুলি ক্রমশ উনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। শ্রমিক আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে (অর্থাৎ, 1850 থেকে 1890) শ্রমিকদের অতি সামান্য মজুরীর বিনিময়ে খাটানোর প্রবণতা, মহিলা ও শিশুদের প্রতি চরম নির্যাতন, চরম বৈষম্য শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে। সারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে কিছু মানুষের প্রচেষ্টায় এই সঙ্ঘবদ্ধতা আন্দোলনের রূপ পায়, যেমন কলকাতার ব্রাহ্ম নেতা শশীপদ ব্যানার্জী, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার শ্রমিকদের উন্নয়নে ব্যাঙ্ক ও নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
বোম্বাইয়ে জ্যোতিবা ফুলে ও তার সহকারী লোখান্ডে সর্বপ্রথম শ্রমিকদের সংগঠিত করে বোম্বাই মিল হ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশান (1890) গড়ে তোলেন। এছাড়া মাদ্রাজের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ হয়েছিল। শেষে এই সকল আন্দোলনের চাপে লর্ড রিপনের আমলে 1881 সালে প্রথম ফ্যাক্টরি আইন পাশ হয়।

এই আইনে শিশু ও নারীদের কাজের সময় কমানো হয়, এবং সপ্তাহে একদিন ছুটির ব্যবস্থা কড়া হয়।

এর পরবর্তী পর্যায়ে শ্রমিকদের সংগঠন আরো দৃঢ় হয়। ট্রেড ইউনিয়নের প্রভাবে শ্রমিক আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে (অর্থাৎ,1901-1914) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে এই আন্দোলনগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অশ্বিনী কুমার ব্যানার্জী, প্রভাত কুমার রায়চৌধুরির নেতৃত্বে বহু কারখানায় ধর্মঘট হয়। আসানসোল, জামালপুর রেল কারখানা থেকে শুরু করে হাওড়া বার্নপুর, চটকল, জুটমিলসহ বহু কারখানায় শ্রমিকদের সাধারণ দাবিদাওয়া পূরণের জন্য ধর্মঘট হয়।

এই পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল বাল গঙ্গাধর তিলক।

এই আন্দোলনগুলিতে তিলকের অবদান অনস্বীকার্য। তিলকের গ্রেফতারিতে আন্দোলনে ঘৃতাহুতি হয়, ফলস্বরূপ দ্বিতীয় ফ্যাক্টরি আইন পাশ হয়, শ্রমিকদের কাজের সময় নির্দিষ্ট হয়। যা শ্রমিক অসন্তোষকে প্রশমিত করতে পারলেও মালিক শ্রেণিকে ক্ষুব্ধ করে।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও ভারতীয় শ্রমিক সমাজ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বব্যাপী তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপনিবেশে শ্রমিকদের অবস্থাকে শোচনীয় করে তুলেছিল। মালিক পক্ষ এবং অর্থনৈতিক অচলতার প্রবল আক্রমন শ্রমিকদের আরো ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। 1917 সালে রাশিয়ার বিপ্লব ভারতীয় শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করে, তারা বুঝতে পারে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে না পারলে এই শোষণের হাত থেকে মুক্তি নেই। কুখ্যাত রাওলাট আইন এই সময় জারি হলে তার বিরুদ্ধে শ্রমিকরা বাকি সাধারণ ভারতীয়দের সাথে গর্জে ওঠে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে 1920-1922 সালের মধ্যেই মাদ্রাজের মাদুরা মিলস, জামালপুরের রেল কারখানা, বোম্বাইয়ের কাপড় কল থেকে শুরু করে কানপুর, শোলাপুর, হায়দ্রাবাদ, পাটনা, ঝরিয়া, রানিগঞ্জ, বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকরা ধর্মঘটে সামিল হয়। এই শ্রমিক আন্দোলনকে আরো দৃঢ়তা দিতে বামপন্থী ও কংগ্রেসি বহু নেতা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়। বহু শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে উঠতে শুরু করে।


jump magazine smart note book


1918 খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে বি.পি.ওয়াদিয়া মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন স্থাপিত হয় (বহু ঐতিহাসিকের মতে এটি ছিল ভারতের প্রথম শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন)।

বাংলায় ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, মৃণাল কান্তি বসু সহ বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ বহু ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলেন, 1922 সালের মধ্যেই বাংলায় ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭৫।

1920 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC)। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন লালা লাজপত রায়।

প্রধানত শ্রমিকদের শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে তাদের ন্যায্য দাবী আদায়ে বহু বামপন্থী নেতা সামিল হয়। রাশিয়ার আদর্শ ও মার্কসীয় ভাবধারার প্রভাব ব্যাপকভাবে শ্রমিক আন্দোলনে পড়ে। যা শ্রমিক আন্দোলনকে বামপন্থী আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। বাংলায় বহু বিশিষ্ট বামপন্থী নেতৃবৃন্দ যেমন মুজফফর আহমেদ, ধরণী গোস্বামী, গোপেন চক্রবর্তী, মাদ্রাজের সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়া, বোম্বাইয়ের শ্রীপদ ডাঙ্গে ছিলেন এদের মধ্যে অন্যতম।

আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারতীয় শ্রমিক সমাজ

গান্ধিজির আইন অমান্য আন্দোলনের দাবীগুলির সাথে শ্রমিকদের দাবীদাওয়ার প্রত্যক্ষ
যোগাযোগ না থাকলেও আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মত। এই আন্দোলনে শোলাপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গান্ধিজির গ্রেফতারের (7ই মে, 1930) পর আন্দোলনকারীরা ব্যাপক বিক্ষোভ চালায়। সরকারি প্রশাসনিক বিভিন্ন দপ্তরে হামলা চালিয়ে এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করে। বাংলা, বিহার, মহারাষ্ট্র সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিক্ষিপ্ত শ্রমিক হরতাল, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
তবে আইন অমান্য আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ 1932 এর পড়ে শ্রমিক আন্দোলনের সংখ্যা ও তার ব্যাপকতা তীব্রতর হয়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও ভারতীয় শ্রমিক সমাজ

1942 এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে বামপন্থীরা সমর্থন করেনি এবং কংগ্রেসি নেতাদের বিভিন্ন শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপ কংগ্রেসের সাথে শ্রমিক আন্দোলনের দূরত্ব তৈরি করে। তাই বামপন্থী মনোভাবাপন্ন শ্রমিক সমাজ যে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ সেই অর্থে করবেনা তা বলাই বাহুল্য।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলন শুরু হওয়ার একদিন বাদে গান্ধিজিসহ কংগ্রেসের বড় বড় নেতারা গ্রেফতার হলে সারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে সপ্তাহব্যাপী হরতাল শুরু হয়। আমেদাবাদের কাপড় কল, জামশেদপুরে টাটার ইস্পাত কারখানা থেকে শুরু করে দিল্লী, লখনউ, মাদ্রাজ, নাগপুর, কানপুর প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকরা হরতাল শুরু করে।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি

1925 সালের 1লা নভেম্বর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্গত লেবার স্বরাজ পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। কুতুবুদ্দিন আহমেদ, কবি নজরুল ইসলাম, হেমন্ত সরকার সহ বিভিন্ন বামপন্থায় বিশ্বাসী ব্যাক্তিবর্গ এই কার্যে সম্পন্ন করেন।

পরবর্তীকালে এই লেবার স্বরাজ পার্টির নাম বদলে হয় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি

এই পার্টির বিভিন্ন প্রাদেশিক শাখা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তাদের কাজ শুরু করে। 1928 সালে সাইমন কমিশনের প্রতিবাদে কলকাতা ও বোম্বাইয়ে এই সংগঠনের উদ্যোগে ধর্মঘট পালন হয়।
তবে 1929 সালে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় বহু বামপন্থী নেতাদের গ্রেফতার ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠনের সাথে সম্পর্কের অবনতি পরবর্তীকালে এই সংগঠনটিকে চিরতরে বিলুপ্ত করে।

অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গান্ধিজির ভূমিকা

ঐতিহাসিকরা গান্ধিজির ভূমিকাকে এক এক ভাবে ব্যাখা করেছেন। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে গান্ধিজি মূলত জাতির মঙ্গলের উদ্দ্যেশে কিছু দাবীদাওয়া আদায়ের জন্য ব্রিটিশ শাসকদের সাথে দ্বন্দে অবতীর্ণ হতেন, এবং পরিশেষে সন্ধির সাহায্যে নিতেন। মূলত তিনি সমাজ সেবামূলক, ও জনসংযোগের ব্যাপ্তির দ্বারা দেশবাসিকে জাতিয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতেন, এবং তিনি সেই কাজে সফল।

তার নেতৃত্বে যে তিনটি (অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন) আন্দোলন হয়েছিল, তার প্রত্যেকটি গোষ্ঠীস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। আবার ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে গান্ধিজি কখনই অনিয়ন্ত্রিত গন আন্দোলনকেও সমর্থন করেননি, যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ চৌরিচৌরার প্রতিবাদে আন্দোলন প্রত্যাহার। তিনি কৃষক বা শ্রমিকদের সশস্ত্র আন্দোলনকে সমর্থন করেননি।

গান্ধিজি চাইতেন, কৃষক বা শ্রমিক স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি জমিদার ও মালিকপক্ষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, তাই গান্ধিজির ডাকে সব সম্প্রদায় তাদের বিভেদ ভুলে জাতিয়তাবোধকে সামনে রেখে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। আর এতেই গান্ধিজির সাফল্য।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণের চরিত্র

লেখিকা পরিচিতি

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X_hist_6b