niyoto-bayu-samoyik-bayur-dharona
Madhyamik

নিয়ত বায়ু ও সাময়িক বায়ুর ধারণা

ভূগোলদশম শ্রেণি – বায়ুমণ্ডল (অষ্টম পর্ব)

আগের পর্বে আমরা বায়ুচাপের ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা নিয়ত বায়ু ও সাময়িক বায়ুর ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

নিয়ত বায়ু কাকে বলে?

পৃথিবীর স্থায়ী চাপ বলয় গুলির অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে একটি নির্দিষ্ট দিকে সারাবছর নিয়মিতভাবে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে নিয়ত বায়ু বলা হয়।

এই নিয়ত বায়ু তিন প্রকারের হয়, যথা – আয়ন বায়ু, পশ্চিমা বায়ু ও মেরু বায়ু।

আয়ন বায়ু

আয়ন শব্দের অর্থ হল ‘পথ’। ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারাবছর যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে আয়ন বায়ু বলা হয়। আগে এই বায়ুর পথ ধরেই পালতোলা জাহাজ বাণিজ্যের চলাচল করত তাই একে ও ‘বাণিজ্য বায়ু’ বলা হয়।

আয়ন বায়ুর বিস্তার ও প্রবাহ

আয়ন বায়ু উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে নিরক্ষরেখার দুদিকে মোটামুটি 5° থেকে 25° অক্ষরেখার মধ্যে প্রবাহিত হয়।
উত্তর গোলার্ধে এই বায়ু কর্কটক্রান্তিয় উচ্চচাপ বলয় থেকে প্রবাহিত হওয়ার সময় এই বায়ু ফেরেলের সূত্র অনুযায়ী ডান দিকে বেঁকে যায় এবং উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু নামে পরিচিত হয়। আবার দক্ষিণ গোলার্ধে মকরক্রান্তিয় উচ্চচাপ বলয় থেকে প্রবাহিত বায়ুর বাম দিকে বেঁকে যায়, তাই একে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু বলা হয়। এই দুই বায়ু নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় বরাবর মিলিত হয়।

এই মিলনস্থলকে ITCZ (Intertropical Convergence Zone) বা আন্ত ক্রান্তীয় অভিসৃতি অঞ্চল বলা হয়। এই অঞ্চলে কোনো বায়ুর কোনো পার্শ্ব প্রবাহ না থাকায়, একে নিরক্ষীয় শান্ত বলয় ডোলড্রাম অঞ্চল বলা হয়।

পশ্চিমা বায়ু কাকে বলে?

কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে মেরু বৃত্তীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে পশ্চিমা বায়ু বলা হয়। পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয় বলে এই বায়ুকে পশ্চিমা বায়ু নামেও অভিহিত করা হয়।

পশ্চিমা বায়ুর বিস্তার ও প্রবাহ

উত্তর গোলার্ধে 35° থেকে 60° অক্ষরেখার মধ্যে এই বায়ু প্রবাহিত হয়। কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে উত্তর মেরু বৃত্তীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে এই বায়ু প্রবাহিত হওয়ার সময় ফেরেলের সূত্র অনুযায়ী ডান দিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু নামে পরিচিত হয়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

আবার মকরীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে দক্ষিণ মেরু বৃত্তীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় এই বায়ু বাম দিকে বেঁকে উত্তর পশ্চিম পশ্চিম বায়ু নামে পরিচিত হয়।দক্ষিণ গোলার্ধে যেহেতু জল ভাগ বেশি থাকে তাই জলের সঙ্গে কম ঘর্ষণজনিত বাধার কারণে উন্মুক্ত সমুদ্রের উপর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়।

এই কারণে এই অঞ্চলে পশ্চিমা বায়ু সাহসী পশ্চিমা বায়ু বা প্রবল পশ্চিমা বায়ু নামে পরিচিত হয়। পশ্চিমা বায়ুর গতিবেগের  বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন অক্ষাংশে পশ্চিমা বায়ুর নাম বিভিন্ন হয়। যেমন – 40° দক্ষিণ অক্ষরেখা পশ্চিমা বায়ু গর্জনশীল চল্লিশা; 50° দক্ষিণ অক্ষ রেখায় পশ্চিমা বায়ু ক্রোধোন্মত্ত পঞ্চাশ এবং 60° দক্ষিণ অক্ষ রেখায় তীক্ষ্ণ চিৎকারকারি ষাট নামে পরিচিত।

মেরু বায়ু কাকে বলে?

সুমেরু ও কুমেরু উচ্চচাপ বলয় থেকে সারা বছর মেরু বৃত্তীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে মেরু বায়ু বলা হয়।

মেরু বায়ুর বিস্তার ও প্রবাহ

উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে 70° থেকে 80° অক্ষরেখার মধ্যে এই বায়ু প্রবাহিত হয়।
ফেরেলের সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে এই বায়ু ডান দিকে বেঁকে গিয়ে উত্তর-পূর্ব মেরু বায়ু নামে পরিচিত হয় এবং দক্ষিণ মেরুতে বাম দিকে বেঁকে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব মেরু বায়ু নামে পরিচিত হয়। দক্ষিণ গোলার্ধে জলভাগের পরিমান বেশি থাকায় উত্তর গোলার্ধের তুলনায় দক্ষিণ গোলার্ধের মেরু বায়ু প্রবাহিত হয়।

সাময়িক বায়ু কাকে বলে?

স্থলভাগ ও জলভাগের ভূ-প্রাকৃতিক বৈষম্য ও বায়ুচাপের তারতম্যের প্রভাবে দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে বা বছরের একটি বিভিন্ন ঋতুতে নিয়মিতভাবে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে সাময়িক বায়ু বলা হয়।

এই সাময়িক বায়ুকে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায় যেমন স্থলবায়ু, সমুদ্র বায়ু, মৌসুমী বায়ু, পার্বত্য বায়ু, উপত্যকা বায়ু।

স্থলবায়ু কাকে বলে?

স্থল এবং জল ভৌত চরিত্রের দিক থেকে ভিন্ন হওয়ায় তাপ শোষণ এবং বিকিরণ ভিন্নভাবে করে থাকে। রাত্রিবেলা উপকূল অঞ্চলের স্থলভাগ সমুদ্র অপেক্ষা দ্রুত তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে পড়ে। সেই অনুযায়ী সমুদ্র উষ্ণ থাকে ফলে স্থলভাগে উচ্চচাপ ও জলভাগের উপর নিম্নচাপ অবস্থান করে। এর ফলে স্থলভাগ থেকে জলভাগের দিকে একটি আনুভূমিক চাপ ঢাল এর সৃষ্টি হয়। তখন স্থলভাগ থেকে সমুদ্রের দিকে যে বায়ু প্রবাহিত হয় একে সমুদ্র বায়ু বলা হয়। ভোর বেলায় এই স্থলবায়ু বেশি বেগে প্রবাহিত হয়।

স্থল বায়ু

সমুদ্র বায়ু কাকে বলে?

বিপরীতভাবে দিনের বেলায় উপকূল সংলগ্ন স্থলভাগ সমুদ্র অপেক্ষা বেশি তাপ শোষণ করে উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। সমুদ্র সেই অনুপাতে তাপ শোষণ করে না এবং স্থলভাগ অপেক্ষা শীতল থাকে। এর ফলে সমুদ্র থেকে স্থলভাগের দিকে একটি চাপ ঢাল সৃষ্টি হয়। যার ফলে উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলে সমুদ্র থেকে বাতাস দ্রুতবেগে স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হয় যাকে সমুদ্র বায়ু বলা হয়। এই সমুদ্র বায়ুর কারণেই উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু সমভাবাপন্ন হয় সন্ধ্যার সময়ে এই সমুদ্র বায়ুর বেগ সবথেকে বেশি হয়।

সমুদ্র বায়ু

মৌসুমী বায়ুর কাকে বলে?

আরবি শব্দ ‘মৌসম ‘ বা মালয় শব্দ ‘মনসিন ‘ থেকেই মৌসুমী কথাটি এসেছে যার অর্থ হলো ‘ ঋতু’। যে বায়ু গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে এবং শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়, তাকে মৌসুমী বায়ু বলা হয়। এই বায়ুর উৎপত্তির অনেকটা স্থলবায়ু ও সমুদ্র বায়ুর মতই কিন্তু এর বিস্তার ও ব্যাপকতা স্থলবায়ু ও সমুদ্র বায়ু থেকে অনেক বেশি এবং এই বায়ু জলবায়ুর উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে থাকে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

সমুদ্রের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ুর স্থলভাগের উপর দিকে প্রবাহিত হয়। শীতকালে স্থলভাগের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে শুষ্ক বায়ু শীতকালীন মৌসুমী বায়ু রুপে সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। ফন, ট্রেওয়ার্থা প্রমূখ আবহাওয়াবিদদের মতে ‘মৌসুমী বায়ু হলো স্থলবায়ু ও সমুদ্র বায়ুর বৃহৎ সংস্করণ’।

পার্বত্য বায়ু কাকে বলে?

পার্বত্য অঞ্চলে রাতের বেলা পার্বত্য গাত্র তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে পড়ে। এর ফলে উপত্যকার সংলগ্ন বায়ু শীতল ও ভারী হয়ে উপত্যকার নিচের দিকে নেমে আসে এই বায়ুকে নিম্ন ঢাল বায়ু বা ক্যাটাবেটিক বায়ু বলা হয়। যখন এই ক্যাটাবেটিক বায়ু উপত্যকার নিচের অংশ দখল করে তখন অপেক্ষাকৃত উষ্ণ বায়ু উপত্যকার উপরের অংশ দখল করার জন্য ঝড়ো বাতাসের মত ছুটে আসে। তখন একে পার্বত্য বায়ু বলা হয়। এই বায়ু সূর্যোদয়ের আগে সারা রাত ঝড় এর মতো বইতে থাকে। এই ক্যাটাবেটিক বায়ুর ফলে বৈপরীত্য উত্তাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়।

ক্যাটাবেটিক বায়ু

উপত্যকা বায়ু কাকে বলে?

দিনের বেলায় পার্বত্য উপত্যকা সূর্যরশ্মি দ্বারা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ফলে পর্বত গাত্র সংলগ্ন বায়ু গরম ও হালকা হয়ে পর্বতের ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। এই ঊর্ধ্বগামী বায়ুকে উপত্যকা বায়ু বা ঊর্ধ্ব ঢাল বায়ু এবং ইংরেজিতে অ্যানাবেটিক বায়ু বলা হয়।

অ্যানাবেটিক বায়ু
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → স্থানীয় ও আকস্মিক বায়ুর ধারণা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-geo-2-h