ditio biswa juddho o tarpor
WB-Class-9

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ বনাম গণতান্ত্রিক আদর্শের সংঘাত | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর

ইতিহাসনবম শ্রেণি – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর (প্রথম পর্ব)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে হোহেনজোলার্ন, হ্যাপসবার্গ এবং রোমানভ রাজবংশের পতনের পর ইউরোপে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং উদারতান্ত্রিক গণতন্ত্রের উত্থান শুরু হয়।

ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে ইউরোপে গণতন্ত্রবিরোধী আরো দুটি রাজনৈতিক ভাবধারা যথা সাম্যবাদী এবং একনায়কতান্ত্রিক ভাবধারার সৃষ্টি হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়ায় সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক এবং একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলি সাম্যবাদী ভাবধারার সাথে সমান দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে, ফলে সোভিয়েত রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছুসময় ব্রাত্য থাকতে হয়।

হিটলার

একনায়ক হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান হয় এবং অপরদিকে একনায়ক মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থায় হয়; এই দুই শক্তি মিলিত হয়ে ইউরোপে একনায়কতান্ত্রিক আদর্শের জন্ম দেয়। পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই আদর্শের বিস্তার ঘটে।

খুব স্বাভাবিক কারণেই গণতান্ত্রিক দেশগুলির সাথে এই সামাজ্যবাদী একনায়কতান্ত্রিক ভাবধারার সংঘাত শুরু হয়।

রোম – বার্লিন – টোকিয় জোট

একনায়কতান্ত্রিক জার্মানি এবং ইতালি ইউরোপে ক্রমশ কুটনৈতিকভাবে একা হয়ে পড়লে জাপান তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। জাপান, জার্মানি এবং ইতালি এই তিন দেশ, সারা বিশ্বে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ই নভেম্বর রোম – বার্লিন – টোকিয় চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

রোম – বার্লিন – টোকিয় চুক্তির প্রধান শর্ত

ক) এই চুক্তির কার্যকাল হবে দশ বছর।

খ) অন্য কোনো দেশ এই তিনটি দেশের কোনো একটি দেশকে আক্রমণ করলে, অন্য দুটি দেশ আক্রমন প্রতিরোধে সাহায্য করবে।

গ) এই তিনটি দেশ কোনোভাবেই সাম্যবাদী রাশিয়ার সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে না।

রোম – বার্লিন – টোকিয় চুক্তির প্রভাব

ক) এই চুক্তির ফলে একনায়কতন্ত্রী শক্তি আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং এই জোট অক্ষশক্তি জোট নামে পরিচিতি পায়।

খ) এই চুক্তির ফলে সাম্যবাদের প্রসার বাঁধাপ্রাপ্ত হয়।

ইঙ্গ-ফরাসী তোষণনীতি

জাপান, জার্মানি এবং ইতালি যখন ক্রমশ তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপ নিতে শুরু করে সেই সময় বিশ্বের অন্যতম দুই গণতান্ত্রিক শক্তি ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স অক্ষশক্তিকে কোনোরকম বাঁধা না দিয়ে তাদের অহেতুক তোষণ করতে শুরু করে। এর ফলে অক্ষশক্তির সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা আরো বৃদ্ধি পায়।

কিছু ভ্রান্ত ধারণার ফলে এই তোষণনীতির উদ্ভব হয়। সেগুলি হল –

ক) ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স রুশ সাম্যবাদকে, জার্মান এবং ইতালির একনায়কতান্ত্রিক ভাবনার থেকে বেশি অপছন্দ করতো। ফলে তারা মনে করতো যে, হিটলারকে মধ্য ও পূর্ব-ইউরোপের রাজ্যগুলি দখল করতে দিলে, হিটলার ইঙ্গ এবং ফরাসী শক্তির বিরোধিতা করবেন না।

খ) ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স মনে করতেন যে জার্মানির নাৎসি অগ্রাসনের প্রধান কারণ ভার্সাই চুক্তি, তাই চুক্তির ত্রুটিগুলি সংশোধিত হলে জার্মানি নিয়ন্ত্রিত হবে।

এই তোষণনীতির ফলে জার্মানি ও ইতালি আরো শক্তিশালী হয় এবং অক্ষশক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই আবার বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে, এই ভয়াবহ যুদ্ধের অন্যতম কিছু কারণ হলো –

ক) ভার্সাই চুক্তির ত্রুটি – অনেক ঐতিহাসিকদের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তিএই চুক্তিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত জার্মানির উপর বিরাট ক্ষতিপুরনের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সামরিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল এবং জার্মানির লোহা, রবার এবং কয়লা সমৃদ্ধ বিভিন্ন অঞ্চল কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বলাই বাহুল্য যে জার্মানরা এই চাপিয়ে দেওয়া চুক্তি ভালোভাবে মেনে নেয়নি এবং এই জনরোষের কারণেই একনায়ক হিটলারের নাৎসি ভাবধারার জন্ম হয়।

খ) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অনৈক্য – ইউরোপের অন্যতম দুটি গণতান্ত্রিক শক্তি ছিল ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড। গণতান্ত্রিক শক্তির সুরক্ষার জন্য ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতির একতার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তাদের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। যেমন হিটলার ধারাবাহিকভাবে ভার্সাই চুক্তি লঙ্ঘন করে গেলেও ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের তরফে কোনো প্রতিরোধ দেখা যায় না।

গ) নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যার্থতা – ১৯৩২ সালের নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে জার্মানি ফ্রান্সের সমতুল অস্ত্র রাখার দাবী জানায়; ফ্রান্স এই প্রস্তাবে অসস্মত হলে জার্মানি সভা ত্যাগ করে এবং ক্রমশ তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করে।

ঘ) জাতিসংঘের ব্যার্থতা – জাতিসঙ্ঘের দুর্বলতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা হয়, কিন্তু জন্মের প্রথম দিন থেকেই জাতিসংঘের কিছু দুর্বলতা ছিল। প্রথমত কোন সদস্য দেশ জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য ছিল না। দ্বিতীয়ত, জাতিসঙ্ঘের নির্দিষ্ট কোন বাহিনী ছিল না। তৃতীয়ত, বিশ্বের অন্যতম শক্তি আমেরিকা জাতিসঙ্ঘে যোগদান করেনি, ফলে বিশ্বের প্রধান রাষ্ট্রগুলির সমর্থন জাতিসঙ্ঘে ছিল না। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে গোপন চুক্তি, অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং আগ্রাসন শুরু হলে জাতিসংঘ নীরব দর্শকে পরিণত হয়।


এই অধ্যায়ের ক্লাস করে নাও নীচের ভিডিও থেকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে হিটলার উপলব্ধি করেন যে ইংরেজ এবং ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানির যুদ্ধ আসন্ন। এই যুদ্ধে যাতে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড কোনভাবে রাশিয়ার সমর্থন না পায়, তাই হিটলার রাশিয়ার সাথে দশ বছরের অনাক্রমণ চুক্তি করেন।

অবশেষে ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মানি পোলান্ড আক্রমণ করে। ৩য় সেপ্টেম্বর ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড পোলান্ডের সমর্থনে যুদ্ধে যোগ দিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি

জার্মানির আক্রমণে পোল্যান্ড সেনা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, এরপর ১৭ই সেপ্টেম্বর রাশিয়া পূর্ব-পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এই দ্বিমুখী আক্রমণে পোল্যান্ড সরকারের পতন ঘটে।

জার্মানির শক্তিবৃদ্ধিতে চিন্তিত রাশিয়া তার সীমান্ত রাজ্যগুলিতে সামরিক নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে। ফিনল্যান্ড রুশ সামরিক শাসন অস্বীকার করলে, রাশিয়া ফিনল্যান্ড আক্রমণ এবং অধিকার করে।

১৯৪০ সালে জার্মানি ডেনমার্ক এবং নরওয়ে দখল করে।

ইউরোপে জার্মানির অগ্রাসন ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে ব্যপক জনরোশ তৈরি করে, ফলত দুটি দেশেই সরকার বদল হয়। ফ্রাসের নতুন প্রধানমন্ত্রী হন রেনো এবং ইংল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী হন উইনস্টন চার্চিল। সরকার বদলের পর ইঙ্গ – ফ্রান্স আক্রমণের গতি বৃদ্ধি পায়।

উত্তর ইউরোপে আধিপত্য বিস্তার করার পরে, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে হিটলারের নাৎসিবাহিনী একসাথে পশ্চিম ইউরোপের বেলজিয়াম, লাক্সেমবার্গ এবং হল্যান্ড আক্রমণ করে। লাক্সেমবার্গ এবং হল্যান্ডের খুব সহজেই পতন হয়। বেলজিয়াম, ইংল্যান্ডের সহায়তায় কঠিন প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলেও, দুসপ্তাহের মধ্যে বেলজিয়াম জার্মানির দখলে আসে।

বেলজিয়ামের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন, জার্মানি ফ্রান্স আক্রমণ করে এবং ফ্রান্সের একটি বৃহত্তর অংশ দখল করে।

ইতালি, জার্মানির সাথে যুদ্ধ যোগদিলে অক্ষশক্তি শক্তিশালী হয়।

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৮ই আগস্ট, হিটলার ইংল্যান্ডের উপর বিমান আক্রমণ করেন।

ইংল্যান্ডের Royel Airforce, বার্লিনের উপর এর পাল্টা আক্রমণ চালায়। ইংল্যান্ডের আক্রমণে জার্মানি পিছু হঠে এবং ইংল্যান্ডের উপর আক্রমণ কমিয়ে দেয়।

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২২শে জুন অপ্রত্যাশিত ভাবে জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করে…

পরবর্তী পর্ব → দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

IX-His-6-a