ইতিহাস – দশম শ্রেণি – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন (পর্ব – ৩)
বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন নিয়ে আলোচনা↓
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন কিছু বিষয়।
বামপন্থী কাকে বলে?
এই ধারণাগুলি মূলত ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। আইনসভার যে সব সদস্য গণতান্ত্রিক ভাবাধারার প্রসারতা চাইতেন, যারা সমাজের বিভিন্ন বৈষম্য দূর করে সকলের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন, তারা সাধারণত কক্ষের বামদিকে বসতেন, তাই তাদের বামপন্থী বলা হয়।
অন্যদিকে যারা বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সচেতন তাদেরকে দক্ষিণপন্থী বলা হয়।
ভারতের জাতীয় আন্দোলনে কংগ্রেসের প্রভাব ছিল সর্বাধিক, কিন্তু এর পাশাপাশি বাম্পন্থীরাও ধীরে ধীরে তাদের ভাবধারা নিয়ে বামপন্থী আন্দোলনে প্রকট হয়েছিল।
সময়ের নিরিখে বিষয়টিকে আমরা কিছু পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করবো।
বামপন্থী আন্দোলন 1920 – 1925
এই সময়টি বামপন্থী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা বা সূচনাকাল হিসাবেই পরিচিত। 1920 খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ভারতের বাইরে তাসখন্দে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জী সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করেন। আবার, পরে 1925 এ ভারতের অভ্যন্তরে কানপুরে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়া ও অন্যান্য ব্যাক্তিবর্গ ভারতে কমিউনিস্ট দল গঠন করেন।
প্রথম থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেসের নীতিগুলির সাথে তারা সহমত ছিলেন না। অসহযোগ আন্দোলন যখন সবথেকে জোরালো হয়ে ওঠে সেই সময় গান্ধীজীর এই আন্দোলন প্রত্যাহারের বিষয়টি তারা সমর্থন করেননি।
বামপন্থী আন্দোলন 1925 – 1929
এই পর্যায়ে কংগ্রেসের সাথে কিছুটা সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। বামপন্থীরা “ওয়ারকার্স অ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি” গড়ে তোলেন। 1928 এর সাইমন বিরোধী আন্দোলনেও কংগ্রেস ও বামপন্থীদের একযোগে যোগদান করতে দেখা যায়। বামপন্থীরা বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে দেশবাসীর সাথে সংযোগ রক্ষায় সচেষ্ট হয়। এদের মধ্যে বাংলার ‘লাঙল’ ও ‘গণবাণী’ এবং মহারাষ্ট্রের ‘ক্রান্তি’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বামপন্থী আন্দোলন 1929 – 1934
এই সময় থেকে ভারতীয় কমিউনিস্টদের সাথে কংগ্রেসিদের আবার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। 1929 সালে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় বামপন্থী বহু বড় নেতা গ্রেপ্তার হয়, কংগ্রেস তাদেরকে আইনী সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও আইন অমান্য আন্দোলনের কারণে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। যারফলে বামপন্থীরাও আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেয়নি (যদিও পরবর্তীকালে তারা এই ভুল স্বীকার করেছে)। এরপরে 1932 সালের পর থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে এই দুটি দলের আবার সম্পর্কের উন্নতি হয়।
বামপন্থী আন্দোলন 1934 – 1939
1934 সালে কমিউনিস্টদের কিছু ট্রেড ইউনিয়নকে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করলে, বামপন্থীরা কংগ্রেসের সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আন্দোলনে সামিল হয়। জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। 1936 সালে কৃষক আন্দোলনগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সারা ভারত কিষাণ কংগ্রেস (1938 সালে নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় সারা ভারত কিষাণ সভা) গড়ে ওঠে, স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর মত বহু কৃষক নেতাদের সাথে বামপন্থীদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
বামপন্থী আন্দোলন 1939 – 1945
বিশ্ব তথা ভারতের ইতিহাসে এই সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন মিত্রশক্তিতে এবং জাপান, জার্মানি ও ইতালি অক্ষশক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই বিশ্বযুদ্ধকে ভারতের কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের তকমা দিয়েছিল। 1941 সালে বিশ্বের একমাত্র কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে জার্মানি আক্রমন করলে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক বিরাট পরিবর্তন আসে, তারা ভাবতে শুরু করে জার্মানরা বামপন্থীদের আন্দোলনকে সারা বিশ্ব থেকে মুছে দেবার চেষ্টা করছে, তাই তারা ভারতের শত্রু ব্রিটিশদেরকে সমর্থন করতে শুরু করে জার্মানিকে পরাজিত করার জন্য (যেহেতু ব্রিটেন জার্মানির শত্রুপক্ষ বা মিত্রশক্তির অংশ ছিল)।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
ভারতে তাই 1942 এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কংগ্রেসের বিরোধিতা করে বামপন্থীরা। কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা এই আন্দোলন শুরু হলেই গ্রেপ্তার হন, তাও ভারতীয় কমিউনিস্টরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি তাই বহু ঐতিহাসিক মনে করেন এই সময়ে বামপন্থীরা ভারতীয় রাজনীতির নিরিখে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল।
বামপন্থী আন্দোলন 1945 – 1947
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় জার্মানির চূড়ান্ত পরাজয় নিয়ে। ঠিক সেই সময় থেকে বামপন্থী নেতারা পুনরায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। এই সময় 1946 এর নৌবিদ্রোহে বামপন্থীদের সমর্থন হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির সৃষ্টি করেছিল।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাপতি রশিদ আলি গ্রেফতারের প্রতিবাদে তারা 12ই ফ্রেব্রুয়ারি “রশিদ আলি দিবস” পালন করে।
দেশভাগের কিছু আগে যখন মুসলিম লিগ ভারত ব্যাবচ্ছেদ করায় ব্যাস্ত এবং যখন কংগ্রেসও ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অপেক্ষা করছে, সেই সময় ভারতের কমিউনিস্টরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষিপ্ত কিছু কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তেভাগা থেকে শুরু করে হায়দ্রাবাদের তেলেঙ্গানায় কমিউনিস্টরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
তবে সবক্ষেত্রেই আন্দোলনের শেষ অবধি লড়ে যাবার সাহস তারা দেখাতে পারেনি। তারা কংগ্রেসের গণতান্ত্রিক আদর্শের বিকল্প হিসাবে সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে অসফল হয়। ফলে ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়।
সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র
লেখিকা পরিচিতি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_hist_6c