শ্রেণি – দশম বিষয়: ইতিহাস । অধ্যায়: ইতিহাসের ধারণা (পর্ব -৩) |
এই অধ্যায়ের আগের পর্বগুলিতে আমরা সমাজের এবং নারী ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছি।
এই পর্বে আমরা যানবাহন – যোগাযোগের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবো।
মানবজাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তোমরা আগেই জেনেছ যে, প্রাচীন যুগের মানুষ পায়ে হেঁটে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যেত; তখন না ছিল গাড়ি-ঘোড়া, না ছিল কোনো যানবাহন।
ধীরে ধীরে নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ যখন স্থায়ী বসতি গড়ে তুলল, চাষবাস শিখলো এবং সাথে সাথে পশুপালনও শুরু করল; তখন তারা গৃহপালিত পশু যেমন – গরু, গাধা, ষাঁড়, উট, ঘোড়ার পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যেত।
এরপর চাকা আবিষ্কার হল; যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতির পথ খুলে গেল। যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সময়ের সাথে উন্নতি ঘটে মূলত তিনভাবে – ১. জলপথ, ২. স্থলপথ, ৩. আকাশপথ।
‘যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস’ ভিডিওটি দেখুন। ↓
চাকা আবিষ্কারের পরবর্তী সময়ে চাকা দিয়ে তৈরি হল গাড়ি।
ফলে স্থলপথে যাতায়াতের খুব সুবিধা হল। আবার কাঠের গুঁড়িকে জলে ভাসতে দেখে তার সাহায্যে ভেলা বানিয়ে মানুষ জলপথে বহুদুর যেতে শুরু করল। এছাড়া প্রথমে চামড়ার নৌকা এবং পরবর্তীকালে কাঠের নৌকা বানিয়ে যাতায়াত মানুষের জন্য খুব সহজ হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে বন জঙ্গল কেটে নতুন নতুন রাস্তাঘাট তৈরি হল, ফলে যাতায়াত আরো দ্রুত ও নিরাপদ হল।
চাকার ঠেলা গাড়ির সাথে ঘোড়া, উট, গরু-বলদকে জুড়ে তৈরি হল জুড়িগাড়ি।ফলে যানবাহনের এই বিবর্তন মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দিক হিসেবে নির্দেশ করল।
পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের হাত ধরে রাস্তাঘাট ও যানবাহন আরো উন্নত হল।
যেমন শিল্প বিপ্লবের যুগে 1811 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের টেলফোর্ড ও ম্যাকডম পাথরকুচি দিয়ে রাস্তা তৈরি করার কৌশল আবিষ্কার করেন। এই নতুন ধরনের রাস্তাই আমরা বর্তমানে দেখে থাকি।
আবার 1814 খ্রিস্টাব্দে জর্জ স্টিফেনসন বাষ্প চালিত রেল ইঞ্জিন তৈরি করলেন। 1815 সালে ফুলটন বাষ্পীয় পোত তৈরি করলেন। ফলে দেশে দেশে নতুন নতুন পাকা রাস্তা হল, তৈরি হল নানান উন্নত ধরনের যানবাহন। এই উন্নত ধরনের যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থা শুধু ইংল্যান্ডই নয় ইউরোপের বহু দেশে শিল্প বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করেছিল।
এরপর ব্রিটিশ যুগে ভারতের লর্ড ডালহৌসি 1853 সালে 15 এপ্রিল রেলপথের সূচনা করলে দেশের অর্থনীতিতে জোয়ার আসে। রেলপথের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যুদ্ধ সামগ্রী ও সেনা পাঠানোর সুবিধা হয়েছিল। এছাড়া ব্রিটিশ পণ্য যেমন কাঁচামাল, শিল্পজাত পণ্যের আমদানি ও ভারতীয় পণ্য রপ্তানিতে সুবিধা হয়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থসিদ্ধি হয়েছিল রেলপথের মাধ্যমে।
তবে আরো একটি কথা বলতেই হবে, ভারতের জাতীয়তাবাদি আন্দোলনও কিন্তু এই রেলপথের মাধ্যমেই প্রসস্থ হয়েছিল। কারণ আন্দোলনকারীরা রেলপথকে ব্যবহার করে তাদের ভাবধারা ও কর্মকান্ডকে ভারতের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই রেলপথের মাধ্যমেই।
সম্পদের বহির্গমনের জন্য এই রেলপথই দায়ী ছিল।
ভারতীয়দের থেকে অর্থ নিয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলিতে লগ্নি করা হয়েছিল। তা থেকেই গ্যারান্টি প্রথার মাধ্যমে মাত্র 5% হারে সুদ দেওয়া হয়েছিল ভারতীয়দের। এটি থেকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের আরও একটি দিক উঠে আসে। বর্তমানে জাপানে বুলেট ট্রেন চালু হয়েছে, যা যোগাযোগ ব্যবস্থার এক যুগান্তকারী সৃষ্ট।
কিন্তু এগুলো সব স্থলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা।
বর্তমানে যেটি যোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ উন্নত ব্যবস্থা হল বিমান ব্যবস্থা। গোটা পৃথিবীকে এক সুত্রে বেঁধেছে বিমান পরিবহণ। আজ কোনো কিছুই আর দূরে নয়, দুর্গম ও নয়, খুব দ্রুত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আনায়সে পৌঁছে যাওয়া যায়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও একটি উন্নত দিক হল ডাক ব্যবস্থা ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা।
1851 সালে ভারতের টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা চালু হয়। 1854 সালে ডাক ব্যবস্থা চালু হয়। পেনি পোস্ট কার্ডের প্রচলন ও হয়েছিল। তোমাদের মধ্যে কেউই হয়তো টেলিগ্রাম (ফোনের অ্যাপ নয় কিন্তু) দেখোনি, কিন্তু এই দীর্ঘকাল ধরে জরুরী খবর এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা পৌঁছাবার জন্য টেলিগ্রামের কোনো বিকল্প ছিল না। এমন কি আশির দশকেও বছরে প্রায় ছয় কোটি টেলিগ্রাম পাঠানো হত।
বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত ও দ্রুত হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, যোগাযোগ ব্যবস্থার জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
এইভাবে যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতির ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব ক্রমান্বয়ে ঘটে চলেছে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান |
1960 থেকে 70 সালে এই বিষয়ের ইতিহাস চর্চা শুরু হয়।
নটিংহাম ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পিটারলিথ বলেছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস চর্চার সাথে জাতীয়তাবাদের বিকাশে একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তোমরা জন আর্মস্ট্রংয়ের ‘ট্রান্সপোর্ট হিস্ট্রি’ বা ‘পরিবহন ইতিহাস’ প্রবন্ধটি পড়লে উপকৃত হবে।
সুনীল কুমার মুন্সির ‘জিওগ্রাফি অফ ট্রানস্পর্টেশন ইন ইন্ডিয়া আন্ডার ব্রিটিশরাজ’, নীতিন সিনহার লেখা ‘পূর্বভারতের পরিবহন ও যোগাযোগ বিষয়ের গ্রন্থগুলি ও ইয়ান কের (Ian J. Kerr) এর ‘ইঞ্জিন অব চেঞ্জ- দ্য রেলরোডস দ্যাট মেড ইন্ডিয়া’ বইগুলি যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস চর্চার গবেষণা করা গ্রন্থ।
তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – খেলার ইতিহাস
লেখিকা পরিচিতিঃ
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের (স্নাতকোত্তর) প্রাক্তন ছাত্রী কাজল মণ্ডলের পেশা এবং নেশা ইতিহাস চর্চা। অন্য কাজের অবসরে গান শুনতে এবং দাবা খেলতে ভালোবাসেন কাজল।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_Hist_1c