khelar-itihash
Madhyamik

খেলার ইতিহাস

শ্রেণি – দশম বিষয়: ইতিহাস । অধ্যায়: ইতিহাসের ধারণা (পর্ব -৪) |

এই অধ্যায়ের আগের পর্বগুলিতে আমরা সামাজিক ইতিহাস, নারী ইতিহাস এবং যোগাযোগ – যানবাহন ব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা খেলার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবো।

তোমরা হয়তো ভাবছো যে ইতিহাস পড়তে গিয়ে খেলাধুলার ইতিহাস কেন পড়তে হবে। আসলে মানব জীবনের একটি অংশ হল, তার অবসর জীবন ও আমোদ-প্রমোদ। আর তা থেকেই এই খেলাধুলার জন্ম। আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরণের খেলা প্রচলিত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেমন – কোনো দেশে ফুটবল, তো কোনো দেশে ক্রিকেট, আবার অন্য কোনো দেশে টেনিস, হকি, সাঁতার, কুস্তি বিভিন্ন। আর এই সব খেলার পিছনে নানা ইতিহাস ও প্রচলিত আছে। আর এই সকল ইতিহাস নিয়ে বহু বইও লেখা হয়েছে। তাই বর্তমানে ক্রীড়া ইতিহাস ও ক্রীড়া সাহিত্য ইতিহাস চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।

আমাদের প্রাচীন বাংলাতেই অনেক রকমের খেলা প্রচলিত ছিল।

আর তার ইতিহাসও সব বিচিত্র! যেমন প্রাচীন যুগের রাজা-মহারাজারা তাদের বন্ধুবান্ধব, সামন্ত-মহাসামন্তদের নিয়ে শিকারে বা মৃগয়ায় যেতেন। এটাই ছিল তাদের আমোদ বা খেলাধুলা। আবার সেই সময়কার বিভিন্ন অরণ্যবাসী উপজাতিরা যেমন – ব্যাধ, শবর, চন্ডাল, পুলিন্দ প্রভৃতিদের প্রধান জীবিকা ছিল শিকার। অর্থাৎ সমাজের নিচু তলার মানুষের কাছে যেটা তার রুজি রোজগার সমাজের ওপর তলার মানুষের কাছে সেটাই আমোদ। কি অদ্ভুত এই ইতিহাস!

আবার কিছু শারীরিক কসরতের খেলাও আছে।

যেমন কুস্তি বা মল্লযুদ্ধ। কিছু ঘরোয়া খেলাও প্রচলিত ছিল, যেমন পাশা খেলা এবং দাবা খেলা। তোমরা মহাভারতের পাশা খেলা দেখেছো। শকুনি মামা পাশা খেলায় পান্ডবদের হারিয়ে তাদের রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। অর্থাৎ একটা খেলার সাথে রাজনীতি, সিংহাসন দখলের লড়াইও যুক্ত থাকে।

কুস্তি লড়ছেন কিংবদন্তী কুস্তিবিদ গামা পালোয়ান ।

এছাড়াও আরো কিছু দলবদ্ধ খেলাও ছিল সবাই দল বেঁধে খেলতে পারতো।

যেমন – হা-ডু-ডু, নৌকাবাইচ, কানামাছি, লাঠিখেলা, ডাংগুলি, গরু মোষের লড়াই, লাঠি খেলা, দাড়িয়াবান্ধা প্রভৃতি। আবার মহরম এর সময় মুসলিমরা নানা ধরনের লাঠিখেলা, তরোয়াল খেলা আরো অনেক খেলা প্রদর্শন করে থাকে। সুলতানি যুগে অনেক সুলতান পোলো খেলতেন, যেমন কুতুবউদ্দিন আইবক।

বহু বিপ্লবীর আঁতুড়ঘর

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বহু সমিতি গড়ে উঠেছিল।

যেমন – অনুশীলন সমিতি। এই সমিতিগুলিতে যে শুধু শরীরচর্চা হত তাই নয়, শরীরচর্চার আড়ালে চলত সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের প্রস্তুতি। 1867 সালে ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় মল্লযুদ্ধ, লাঠিখেলা, ব্যায়াম প্রদর্শিত হতো। এই সময়ের দুজন বিখ্যাত মল্লযোদ্ধার নাম জানা যায়। তারা হলেন – ফনিন্দ্রকৃষ্ণ গুহ ও যতীন্দ্রপ্রসাদ গুহ।

বর্তমানে ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, হকি, আর্চারি, জিমনাস্টিক, অ্যাথলেটিকস-এর মত বহু খেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ফুটবল কিন্তু আমাদের দেশের খেলা নয়।

বিলেত থেকে এই খেলা ভারতে আসার পর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাবিকরা এই খেলা ভারতে আমদানি করে। কলকাতা, দমদম, ব্যারাকপুর অঞ্চলের মিলিটারি ও ইউরোপিয়ানরা এই খেলা খেলত। বাঙ্গালীদের মধ্যে সর্বপ্রথম ফুটবল প্রচলন করেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। 1854 সালের আগস্ট মাসে এসপ্ল্যানেড ময়দানে প্রথম ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালিদের দ্বারাই এই খেলা ভারত তথা সমগ্র এশিয়াতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

IFA শিল্ড জয়ী সেই দল

1911 সালে ব্রিটিশদের হারিয়ে মোহনবাগান দল যখন IFA শিল্ড জেতে তখন সকলেই মেনে ছিল যে এটা 1905 এর বঙ্গভঙ্গের জবাব। ফুটবল নিয়ে যদি পড়াশোনা করতে চাও তাহলে কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা গ্রন্থ পড়তে পারো। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ বলেছেন, IFA শিল্ড জয়ে বাঙালিদের বাঁধনছাড়া উচ্ছ্বাস দেখে ব্রিটিশরা 1911 সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করেছিল। এও ছিল এক জাতীয়তাবাদের প্রকাশ।

ক্রিকেট খেলার সূচনা হয় ইংল্যান্ডে।

ইংরেজদের হাত ধরে ভারতে এর প্রচলন হয় এবং প্রথমে এই খেলা তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। 1792 সালে তারা ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব (C. C. C.) নামে প্রথম ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠিত করে। সেখানে শুধু ইংরেজরাই খেলত। ভারতীয়রা ছিল কেবলমাত্র দর্শক। এই খেলাকে ‘জেন্টেলমেন গেম’ বলা হত।

কৃষ্ণাঙ্গ ভারতীয়দের জন্য এই খেলার অনুমতি ছিল না।

তখন ধনী ইংরেজরা শুধু ব্যাট করতো আর গরিব মানুষরা শুধু বল ও ফিল্ডিং করতো, তাদের ব্যাট করার অধিকার ছিল না। এ থেকে বোঝা যায় যে একটা খেলার মাধ্যমে কিভাবে সামাজিক শ্রেণী বিভাজন ফুটিয়ে তোলা যায়।

গড়ের মাঠে ক্রিকেট খেলা চলছে

পরে বাঙালিরাও এই খেলার প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রথমদিকে বাঙালিরা আন্ডার আর্ম বল করতো। নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী প্রথম ওভারহেড বল করেছিলেন। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ সারদা রঞ্জন রায়, দুখিরাম মজুমদার বাঙ্গালীদের মধ্যে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তারা ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের অনুকরণে ‘টাউন ক্লাব’ তৈরি করেন। ক্রিকেট সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক বোরিয়া মজুমদার-এর লেখা ‘টোয়েন্টি টু ইয়ার্ড টু ফ্রিডম: এ সোশ্যাল হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট’ বইটি পড়ে দেখতে পারো।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

একটা খেলা কিভাবে অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে তা আমরা সিনেমায় দেখতে পাই। যেমন আমির খান অভিনীত ‘লগান’ সিনেমায়। দরিদ্র কৃষকদের কর মুকুব হিসেবে ক্রিকেট খেলাকে নির্বাচন করা হয়। যদি তারা জেতে তাহলে কর মুকুব না হলে তিনগুণ কর দিতে হবে। এই ঘটনা যদিও কাল্পনিক তবুও তা মানুষের চিন্তা ধারার পরিবর্তন ঘটায়।

হকি বর্তমানে ভারতের জাতীয় খেলা।

কিন্তু এই খেলাও আসে বিদেশ থেকে। ব্রিটিশ সামরিক অফিসার এই খেলা ভারতে চালু করেন। কলকাতা রেঞ্জার্স ক্লাব এই খেলার প্রচলন করে। এই প্রসঙ্গে হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদের অবদানের কথা অনস্বীকার্য।

হকির মাঠে ‘হকির যাদুকর’ ধ্যানচাঁদ

প্রাচীন যুগের মেয়েদের খেলা বলতে ছিল কেবল জল ক্রিরা ও বাগান চর্চা।

‘পবনদূত’ কাব্যে এই দুই খেলারই উল্লেখ আছে। তখনকার দিনে মেয়েদের আউটডোর গেমস বলে কিছুই সেরকম ছিল না। এখন মেয়েরাও ছেলেদের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। খেলাধুলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ নারী-স্বাধীনতাকে সূচিত করে। আগেকার দিনে মেয়েদের খেলা বলতে বোঝাত ঘর-সংসারের খেলা। তারা পুতুলকে তাদের ছেলে মেয়ে বানিয়ে তাদের সাথে খেলত এবং রান্নাবাটি খেলা খেলত। খেলাধুলার মাধ্যমে এদের বুঝিয়ে দেওয়া হতো সংসারে তাদের অবস্থান। মেয়েরা খেলাধুলা করে পরিবারের তথা দেশের নাম উজ্জ্বল করতে পারে সেক্ষেত্রে অনেক বড় উদাহরণ হলেন টেনিসে সানিয়া মির্জা, ব্যাডমিন্টনে পি.ভি. সিন্ধু, সাইনা নেহওয়াল, কুস্তিতে সাক্ষী মালিক  ক্রিকেটে ঝুলন গোস্বামী, মিতালি রাজ, আর্চারিতে দোলা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

ভারতের তিন বিখ্যাত খেলোয়াড়; মেরি কম, পি ভি সিন্ধু এবং সাক্ষী মালিক

খেলা শুধু আজকের দিনে বিনোদন নয় জীবিকা হিসেবে খেলা বেশ জনপ্রিয়।

খেলার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন, খ্যাতি বেশ ভালোই পাওয়া যায়। সরকারি চাকরিতে এখন খেলোয়ারদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে (স্পোর্টস কোটা)।

খেলার মাধ্যমে জাতির আত্মপরিচয় পাওয়া যায়। আবার খেলাধুলা জাতীয়তাবাদকেও উদ্বুদ্ধ করে। যেমন বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা হলে সকল ভারতীয় একজোট হয়ে খেলা উপভোগ করে। জিতলে উদযাপন করে বাজি ফাটিয়ে। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই তখন এক হয়ে ওঠে।

ক্রিকেট বিশ্বকাপ বিজয়ী ভারত

খেলায় একসময় আর্য জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিল। জার্মানির রাষ্ট্রনায়ক আডলফ হিটলার আর্য জাতিকে সব দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। কিন্তু ১৯৩৬ সালে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলেটিক জেসি অয়েলেস চারটি গোল্ড মেডেল জিতলে হিটলারের জাত্যাভিমান চূর্ণ হয়ে যায়। এইভাবে খেলার সাথে বর্ণ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ও জড়িয়ে আছে।

বর্তমানে খেলাধুলা সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাস আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই হবসবম বলেছেন,

বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের জীবনধারায় অন্যতম প্রধান সামাজিক অভ্যাস হল খেলাধুলা।

মানুষের জীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রোমান কবি জুভেলান বলেছেন মানুষ দুটো জিনিসের জন্য আকুল হতে পারে; ১. রুটি ২. খেলাধুলা।

ব্রিটেনে খেলার ওপর গবেষণা পত্রিকা ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব দ্য হিস্ট্রি অব স্পোর্টস’ ইউরোপ খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৮ সালে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ব বিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র সৌমেন মিত্র ভারতের খেলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন প্রথম। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘ঔপনিবেশিক বাংলায় ফুটবল, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা’।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

1982 তে “ব্রিটিশ সোসাইটি অফ স্পোর্টস হিস্ট্রি” গড়ে উঠেছে। খেলাধুলার ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন রিচার্ড হোল্ড, জে. এ. ম্যাসন, আশিস নন্দী, মিহির বোস, অর্জুন আপ্পাদুরাই, রূপক সাহা, গৌতম ভট্টাচার্য্য, মারিও রডরিগেজ, প্রমুখ। আশিস নন্দীর লেখা ‘ডেস্টিনি অফ গেমস’ গ্রন্থটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

খেলার ইতিহাস পর্বটি দেখো↓

চতুর্থ পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – শিল্পচর্চার ইতিহাস


লেখিকা পরিচিতিঃ

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের (স্নাতকোত্তর) প্রাক্তন ছাত্রী কাজল মণ্ডলের পেশা এবং নেশা ইতিহাস চর্চা। অন্য কাজের অবসরে গান শুনতে এবং দাবা খেলতে ভালোবাসেন কাজল।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –