ইতিহাস – দশম শ্রেণি – ইতিহাসের ধারণা (পর্ব – ৬)
আমরা এর আগের পর্বগুলিতে নতুন সামাজিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা কিছু ইতিহাস চর্চার উপাদান নিয়ে আলোচনা করবো।
আচ্ছা বলো তো, ইতিহাস ও কাল্পনিক গপ্পোর ফারাকটা কোথায়?
ইতিহাসে বর্ণিত প্রত্যেকটি ঘটনার তথ্যের সাহায্যে প্রমাণ দেওয়া আবশ্যক, গালগল্পের ক্ষেত্রে সেই বালাই নেই। কিন্তু একটি বিশেষ সময়ের সমস্ত দিককে ধরতে গেলে, যে বিপুল তথ্যভান্ডারের প্রয়োজন তা তো সবসময় একটি উৎস থেকে পাওয়া যায় না। তখন লেখ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক, মৌখিক ইত্যাদি নানাবিধ সূত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঐতিহাসিকেরা কোন ঐক্য মতে এসে পৌঁছান।
স্বাধীনোত্তর যুগে ভারতের ইতিহাসচর্চা
স্বাধীনতার পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার জন্য ঐতিহাসিকেরা শুধুমাত্র সরকারি নথিপত্রের উপর নির্ভর করতেন। সরকারী নথিপত্র বলতে মূলত সরকারি প্রতিবেদন, গোয়েন্দা বা পুলিশের প্রতিবেদন এবং সরকারি কর্মচারীদের চিঠিপত্র বোঝায়। এগুলি কিন্তু তুমিও দেখে নিতে পারো, তবে এগুলির নাগাল পেতে তোমাকে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের লেখ্যাগারে যেতে হবে। কারণ সরকারী নথিপত্র, সরকারের লেখ্যাগারে সংরক্ষণ করা হয়।
১৯৬০-৭০ এর দশক থেকে যখন নতুন সামাজিক ইতিহাসের হাত ধরে ইতিহাসচর্চার এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়।
সেই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ভারতীয় ইতিহাসবিদদের কাছে শুধুমাত্র লেখ্যাগারে রক্ষিত উপাদানগুলি অসম্পূর্ণ ও অপ্রতুল ঠেকতে থাকে। প্রশ্ন উঠতে থাকে যে ঔপনিবেশিক আমলের লেখ্যাগারও ঔপনিবেশিকদের একটি সাংস্কৃতিক হাতিয়ার নয় কি? কারণ, সেই সময়ের সরকারী নথিপত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাসক অর্থাৎ ব্রিটিশদের প্রাধান্য দিয়ে রিপোর্ট লেখা হতো। তাই এই সময় থেকেই লেখ্যাগারের সরকারি নথির বাইরে গিয়ে অতীতস্মরণের বিচিত্র পন্থা ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে।
এই বিকল্প উপাদানগুলির মধ্যে আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও চিঠিপত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা
সরকারি নথিপত্র যেমন রচিত হয় শাসকের বা আরও নির্দিষ্ট করে শাসকশ্রেণীর প্রয়োজনে, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ইত্যাদির অনুপ্রেরণা কিন্তু ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নিখাদ আবেগ। ফলে সাহিত্য ও ইতিহাস উভয় দিক থেকেই এগুলি মূল্যবান।
তবে ইতিহাস রচনার সময় ইতিহাসবিদদের কিন্তু এগুলিকে খুব সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হয়। মনে করো, ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণারত কোন ঐতিহাসিকের হাতে এসে পড়েছে জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন কয়েকজন নেতার আত্মজীবনী। এদের মধ্যে কেউ আপাত অর্থে তুচ্ছ কিছু বিষয় নিয়ে কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে একটু বেশি শব্দব্যয় করেছেন। কারো বা রচনাশৈলী তুলনামূলকভাবে একটু নেতিবাচক। ঐতিহাসিককে প্রত্যেকটি লেখার মধ্যে এই জোরের জায়গাগুলো চিনতে হবে এবং এগুলোর মধ্যে থেকে তাঁর জ্ঞাতব্য বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ অংশটি বেছে নিতে হবে।
বুঝতেই পারছ, কাজটা বেশ কঠিন!
শুধু তাই নয়, আত্মজীবনীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচারের ক্ষেত্রে লেখকের দেশকাল বিচার করা অত্যন্ত জরুরি।
উদাহরণ হিসেবে জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের আত্মজীবনী ‘মেইন ক্যাম্ফ’ বা ‘আমার জীবনসংগ্রামে’র কথা উল্লেখ করা যায়। পন্ডিতমহলে বইটি নাৎসি মতাদর্শের অদ্বিতীয় দলিল হিসেবে সুবিদিত।
জেনে রাখো, 1923 সালে তদানীন্তন জার্মানির ভাইমার প্রজাতন্ত্রকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করতে গিয়ে কারারুদ্ধ হওয়ার পর কারাবাসের অবসরে হিটলার বইটি লেখেন।
কিন্তু এই বইতে তিনি তৃতীয় রাইখ গঠনের যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানির ফুয়েরার বা দেশের প্রধান হিসেবে তাঁর আগ্রাসী বৈদেশিক নীতির সম্পর্ক খুঁজতে না যাওয়াই শ্রেয়। এর কারণ, এই গ্রন্থ রচনা ও বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে সময়ের ব্যবধান প্রায় 20 বছর। আবার হিটলারের জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গৃহীত অনেক সিদ্ধান্তই মেইন ক্যাম্ফের বক্তব্যের পরিপন্থী যেমন ইহুদি অধ্যুষিত রাশিয়ার সঙ্গে স্বাক্ষরিত 1939 সালের গোপন সন্ধি।
সুতরাং স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, আত্মজীবনীতে লিখিত সকল তথ্য কিন্তু অন্ধভাবে ইতিহাসে ব্যবহার করলে চলবে না।
কংগ্রেস পূর্ববর্তী বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ সম্পর্কিত রচনা
আমরা আবার ভারতে ফিরে আসি, আবার কংগ্রেস পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনার যে উন্মেষ ঘটেছিল তার ইতিহাস স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনী ‘সত্তর বৎসর’- এ আলোচিত হয়েছে। এখানে বিপিনচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম 22 বছরের (1858-1880) একটি চিত্র পাওয়া যায়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
তবে 1885 সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর উপনিবেশবিরোধী রাজনীতিতে পট পরিবর্তন ও তাতে বিপিনচন্দ্রের ভূমিকার ইতিহাস আবার এই বইতে মিলবে না। রক্তক্ষয়ী হিংসার উর্ধ্বে রাজনৈতিক ইতিহাস যে চেতনার বিবর্তনের ইতিহাসও বটে, এই বই পড়লে তা বোঝা যায়।
আসলে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির বাইরে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যেও কিন্তু এক ধরনের রাজনীতি বিদ্যমান থাকে, যেমন উচ্চবিত্ত/নিম্নবিত্ত, বর্ণহিন্দু/দলিত, নারী/পুরুষ ইত্যাদি। সমাজের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্র সমাজের এই বিদীর্ণ চেহারাটা স্বীকার করতে চায় না। আর রাষ্ট্রযন্ত্র সমাজের উচ্চশ্রেণির করায়ত্ত হওয়ায় স্বভাবতই সরকারি নথিপত্রেও এর হদিস মেলে না। তবে সমাজের এই অবহেলিত অংশের কাছে স্মৃতিচারণ অনেক সময় রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
নারী ইতিহাস চর্চায় আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার গুরুত্ব
নারী ইতিহাস সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে করেছি। আরও একবার পড়ে নিতে পারো এই লিঙ্ক থেকে- নারী ইতিহাস
বাংলার ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লববাদী রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের ইতিহাস যেমন পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের বোন লেখিকা স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী চৌধুরানীর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’য়।
তিনি সমকালীন বাঙালি তরুণদের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের প্রতি আকৃষ্ট করতে বীরাষ্টমী উৎসব, প্রতাপাদিত্য উৎসব এবং উদয়াদিত্য উৎসব চালু করেছিলেন।
সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতিতে নারী ও পুরুষের অধিকারের ব্যবধান সম্পর্কে তার সচেতনতাও এই আত্মকথনে প্রকাশিত হয়েছে। নারীদের আত্মজীবনীর প্রতি আগ্রহ থাকলে রাসসুন্দরী দাসীর ‘আমার জীবন’ বইটিও পড়ে দেখতে পারো। এটি প্রথম বাংলা ভাষায় লেখা কোন নারীর আত্মজীবনী।
তোমাদের তো লেখাপড়া নিয়ে অনেক অভিযোগ। কিন্তু উনবিংশ শতকে ঘরের মেয়েদের লেখাপড়া শেখা নিয়েই অনেকের আপত্তি ছিল। রাসসুন্দরী সেই যুগে লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলের শ্লেটে বা উনুনের কাঠকয়লা দিয়ে রান্নাঘরের কোণে লিখে লিখে লেখাপড়া শিখেছিলেন। ভাবতে পারো!
প্রকৃত ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার ভূমিকা
কখনও কখনও স্মৃতিকথা থেকে প্রকৃত ইতিহাস রচনা কঠিন হয়ে যায়। বিশেষ করে সেই স্মৃতিকথা যখন হয় সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার কোন মানুষের। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথা জীবনস্মৃতির প্রথম দুটি লাইন উল্লেখ করা যায় –
‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে।’
কোনো পেশাদার শিল্পীর ছবি দেখলে বুঝতে পারবে নৈসর্গিকতা, রোমান্টিসিজম প্রভৃতি অনুভূতিগুলি রংতুলির ছোঁয়ায় কিভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আতঙ্কের স্মৃতি এভাবেই হয়ে উঠতে পারে ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ফরাসি বাহিনীর আচম্বিত আক্রমণে সৈনিকদের হতচকিত ও বিহ্বল অবস্থার কথা পাওয়া যায় তাদের স্মৃতিকথায়।
তেমনই দেশভাগের সময় মানুষের অসহায় অবস্থার কথা জানা যায় খুশবন্ত সিংয়ের ‘এ ট্রেন টু পাকিস্তানে’র মত স্মৃতিকথামূলক রচনা থেকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সতর্কবার্তা থেকে এটা মোটেই ভেবো না ‘জীবনস্মৃতি’র ঐতিহাসিক মূল্য কিছু কম। মূলতঃ একটি নিঃসঙ্গ বাচ্চা ছেলের কবি হয়ে ওঠার কাহিনী হলেও এই বইয়ের ‘স্বাদেশিকতা’ নামক অধ্যায়ে স্বদেশি আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আছে।
রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি স্বাদেশিক সভা গড়ে তুলেছিলেন। স্বদেশি দেশলাই, স্বদেশি কাপড়ের কল তৈরীতে এই সভার সদস্যরা অর্থসাহায্য করতেন।
আধুনিক ভারতের প্রেক্ষাপটে রচিত স্মৃতিকথামূলক রচনাসমূহ
কেশবচন্দ্র সেনের ‘জীবনবেদ’, আশালতা সরকারের ‘আমি সূর্য সেনের কন্যা’, মণিকুন্তলা সেনের ‘সে দিনের কথা’, সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডাইরী’ প্রভৃতি স্মৃতিকথামূলক রচনা উল্লেখযোগ্য।
আরো পড়ো – ইতিহাস চর্চায় চিঠিপত্রের গুরুত্ব
এই স্মৃতিকথাগুলি থেকে একাধারে যেমন উঠে আসে ব্যক্তির স্বতন্ত্র স্বর, তেমনই সেই ব্যক্তির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা তাঁর শ্রেণিগত, জাতিগত, ধর্মীয়, দেশজ ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচিতিসত্তাও ফুটে বেরোয়।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → আধুনিক ইতিহাস চর্চায় সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের গুরুত্ব
লেখক পরিচিতি
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র রাতুল বিশ্বাস। ইতিহাসচর্চার পাশাপাশি লেখা-লিখিতেও সমান উৎসাহী রাতুল।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-His-1f