shikkha-sonogskar-boishistho-porjalocona
Madhyamik

উনিশ শতকের বাংলা- শিক্ষা সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

ইতিহাসদশম শ্রেণি – শিক্ষা সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা (পর্ব – ২)

আগের পর্বে আমরা সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্য সম্পর্কে জেনেছি এই পর্বে আমরা উনিশ শতকের বাংলা- শিক্ষা সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা সম্পর্কে আলোচনা করবো।

প্রাচ্য শিক্ষা -পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ

ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতীয়দের শিক্ষার প্রসারের জন্য ইংরেজ শাসকরা প্রথম দিকে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেননি, পরে 1813 খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য এক লক্ষ টাকা ধার্য হলে ইংরেজ সরকার নড়েচড়ে বসে৷

ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য প্রথম উদ্যোগ নেয় খ্রিস্টান যাজকরা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বাড়ানো, অন্যদিকে ভারতীয়রা ভেবেছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার হলে ভারতবাসী আধুনিকভাবে চিন্তা ভাবনা করতে সক্ষম হবে৷ বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কুসংস্কার, জাতপাতের বিভেদ , উঁচু-নিচু বৈষম্য এগুলো দূর হবে৷


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

ভারতীয়দের মধ্যে রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সমর্থন করেছিলেন তবে ইংরেজদের মধ্যে ভারতীয়দের শিক্ষাদানে কোন ধারাকে গ্রহণ করা হবে তাই নিয়ে মতবিরোধ ছিল৷

পরবর্তীকালে 1835 খ্রিস্টাব্দে 7 ই মার্চ উইলিয়াম বেন্টিং-এর আইন সচিব ও শিক্ষা বিভাগের প্রধান টমাস ব্যাবিংটন মেকলে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে জোরালো সওয়াল করে যে প্রতিবেদন পেশ করেন ,তাকে বলা হয় মেকলে মিনিট এবং এরজন্যই ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ঘটে৷


jump magazine smart note book


ইংরাজি শিক্ষার প্রসার

জোড়াসাঁকো ,আমড়া তলায় দুটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন শেরর্বোন ও মার্টিন বোলস নামে দুই ব্যক্তি৷

এই প্রতিষ্ঠান দুটির ছাত্র ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ ,মতিলাল শীল ইত্যাদি বিখ্যাত মানুষেরা৷ তবে এইসব বিদ্যালয় কোনরকম নির্দিষ্ট সিলেবাস অনুসরণ করা হতনা, বরং বলা যায় ডেভিড ড্রামন্ডের ধর্মতলা একাডেমীতে একটা পাঠক্রম অনুসরণ করে পড়ানো হত আর সেখানকারই অন্যতম ছাত্র ছিলেন ডিরোজিও৷

খ্রিস্টান যাজকরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেননি এনাদের মধ্যে উইলিয়াম কেরি ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত। তিনি ও মার্শম্যান একাধিক ইংরেজি বিদ্যালয় ও ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন৷ যাজক রবার্ট মে চুঁচুড়াতে এরকম ধরনের কতকগুলি বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

এছাড়াও রামমোহন রায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমূখ স্ত্রী শিক্ষা বিস্তার বা ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন৷

ভারতীয়দের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য 1800 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ৷

1817 খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় হিন্দু কলেজ, এছাড়া খ্রিস্টান মিশনারীদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন৷ হিন্দু কলেজ পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন স্কটিশ চার্চ নামে পরিচিত হয়৷ 1818 খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় হেয়ার স্কুল এবং এই সময়েই তৈরি হয় রামপুর কলেজ৷ প্রতিষ্ঠাতা হলেন মার্শম্যান ,ওয়ার্ড ও উইলিয়াম কেরি৷

এই সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা স্কুল সোসাইটি৷ এর উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র ছাত্রদের মধ্যে বই বিতরণ করা এবং স্কুলগুলোর দেখাশোনা করা৷

উডের এডুকেশনাল ডেসপ্যাচ (Wood’s despatch)

1854 খ্রিস্টাব্দে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল উডের এডুকেশনাল ডেসপ্যাচ৷

ডেসপ্যাচ অনুযায়ী কতগুলো সুপারিশ তৈরি হয়৷ সেগুলো হল-

1 .কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন,
2. একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা দপ্তর গঠন করা,
3 .বিদ্যালয় স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বিদ্যালয় স্থাপন করা,
4. বিদ্যালয়গুলোকে সরকারি অনুদানের আওতায় নিয়ে আসা,
5. শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা,
6. স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ঘটানো,
7. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা,

আর এই সকল নির্দেশনানামার ফলেই কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে 1857 থেকে 1858 সালের মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়৷


এই পর্বের ভিডিও আলোচনা ↓

স্ত্রী শিক্ষার প্রসার

স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর৷ সেইসঙ্গে স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে ব্রাহ্মসমাজ, রামমোহন রায়ের ভূমিকাও অনস্বীকার্য৷ বিদ্যাসাগর 1849 খ্রিস্টাব্দে 7 মে ব্রিটিশ সরকারের আইন সচিব জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের সহযোগীতায় কলকাতায় গড়ে তোলেন হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়৷

ব্রিটিশ আমলের বেথুন কলেজ

বিভিন্ন জেলায় প্রায় 35টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
স্ত্রী শিক্ষা প্রসার বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সঙ্গে রামমোহন রায়ের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, রামমোহন রায় মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুরাগী ছিলেন৷ রামমোহন রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।

এছাড়াও বেথুন সাহেব নেটিভ ফিমেল স্কুল নামে সাধারণ বালিকাদের জন্য একটি স্কুল তৈরি করেন৷


নারীশিক্ষার বিস্তার সম্পর্কে আরও পড়ুন ঊনবিংশ শতকে নারীশিক্ষার বিস্তার ও বিদ্যাসাগরের অবদান এই লিঙ্ক থেকে

ডেভিড হেয়ারের সাথে রামমোহন রায় ও আরো কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মিলে 1817 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু কলেজ (যদিও পরবর্তীকালে হিন্দু কলেজ থেকে রামমোহন রায় নিজেকে সরিয়ে নেন ধর্মীয় কারণে)৷ কেশব চন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন৷

এই ঊনবিংশ শতকেই স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা পরিচালিত বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়৷ ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত কলেজ, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈদান্তিক দর্শন , পাশ্চাত্য সমাজবিদ্যা ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষাদান৷

কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত বংশের মহান ব্যক্তিত্ব হলেন রাধাকান্ত দেব৷ শোভাবাজার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সি রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের প্রপৌত্র রাধাকান্ত দেব ছিলেন কলকাতায় 1817 সালের 4 জুলাই প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্কুল বুক সোসাইটির পরিচালন সমিতির অন্যতম সদস্য৷

তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একজন অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি 1818 খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্য হন৷


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

jump magazine smart note book


1850 খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতি থেকে সরে আসেন এবং 1853 খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, এটি ছিল বাংলার প্রথম জাতীয় কলেজ যদিও পরবর্তীকালে অর্থাভাবে কলেজটি স্কুলে পরিণত হয়৷

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কলকাতায় আধুনিক শিক্ষা প্রচলনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেখানে স্কটল্যান্ড নিবাসী ডেভিড হেয়ার সাহেবের কথা না বললেই নয়৷ তিনি ছিলেন যথেষ্ট বিত্তশালী মানুষ এবং পরবর্তীকালে বহু স্কুল তিনি গড়ে তুলেছিলেন৷ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সিমলা, আরপুলি ও পটলডাঙা স্কুল(পরবর্তীকালে এটি হেয়ার স্কুল নামে পরিচিত হয়েছে)৷ এছাড়াও কলকাতা মেডিকেল কলেজের উন্নতিতে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে৷

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার বুকে শিক্ষাক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছিল, সেটি মূলত দুইভাবে। প্রথমটি কলকাতা মেডিকেল কলেজ স্থাপন এবং দ্বিতীয়টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা৷

ঊনবিংশ শতকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ

প্রথমদিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সংস্কৃত কলেজে ও কলকাতা মাদ্রাসায়৷ পরবর্তীকালে উইলিয়াম বেন্টিং একটি আদেশ জারি করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ৷

এই কলেজ নির্মাণের জন্য জমি দান করেছিলেন মতিলাল শীল।

1865 খ্রিস্টাব্দের 20 ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজের ক্লাস শুরু হয়৷প্রথমে শিক্ষার্থী ছিল মাত্র 50 জন।পরবর্তীকালে একাধিক জায়গায় মেডিক্যাল কলেজ এবং একাধিক হাসপাতাল স্থাপিত হয়৷

এই সময়েই চার্লস উডের নির্দেশনামা অনুসারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ শুরু হয়৷ শুধু কলকাতা নয় উডের নির্দেশনামা অনুসারে বোম্বাই এবং মাদ্রাজেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়৷

1857 খ্রিস্টাব্দের বিশ্ববিদ্যালয় বিল গৃহীত হওয়ার পরই ঐ বছর 24শে জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়৷

উডের নির্দেশনামা অনুসারে নির্মিত তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জেমস উইলিয়াম কোলভিল৷

1858 খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিএ পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম গ্র্যাজুয়েট হন যদুনাথ বোস ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ উনবিংশ শতাব্দী শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন জোয়ার নিয়ে আসে। শুধুমাত্র সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় বা চিকিৎসা ক্ষেত্রের জন্য মেডিকেল কলেজ নয় সেইসময় কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্যও শিক্ষাক্ষেত্র স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়৷

যার ফলস্বরূপ 1974 সালে বিহারের পুসায় ভারতের প্রথম কৃষি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়৷

এছাড়া ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির সংরক্ষণের জন্য লর্ড কার্জন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এবং কলকাতার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন৷ যেটি এখন ন্যাশনাল লাইব্রেরি নামে পরিচিত৷ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়৷

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → উনিশ শতকের বাংলা – সমাজ সংস্কার


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-His-2-b